মরিয়ম সুলতানা বিবিসি নিউজ বাংলা, ঢাকা
৫ ডিসেম্বর ২০২৪
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার প্রায় চার মাস পর বিদেশে বিভিন্ন স্থানে জনসম্মুখে বক্তব্য দিচ্ছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত সপ্তাহে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়েছেন এবং আগামী আটই ডিসেম্বর তিনি লন্ডনে আরও একটি অনুষ্ঠানে টেলিফোনে অংশগ্রহণ করবেন ।
বিবিসি বাংলাকে এটি নিশ্চিত করেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী।
এর আগে ইউরোপের দুটি দেশে একইভাবে বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি।
এসব বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে শেখ হাসিনা ‘রাজনীতিতে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন’ বলে মনে করছে বিএনপি।
মূলত, গত পাঁচই অগাস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কিছু ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিলো। যদিও সেগুলো সত্যিই তার কথোপকথন কি না, তা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে সেই রেকর্ডগুলোতে তার দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে নানা ধরনের রাজনৈতিক নির্দেশনা দিতে শোনা গেছে তাকে।
কিন্তু ওইসব ফাঁস হওয়া কল রেকর্ডগুলোকে বাদ দিলে শেখ হাসিনা এবারই জনসম্মুখে বক্তব্য দিতে দেখা যাচ্ছে। তার এই বক্তব্যের অর্থ কি এমন যে শেখ হাসিনা আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন?
শেখ হাসিনা রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া প্রসঙ্গে
বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে বর্তমানে যেধরনের টানাপোড়েনমূলক সম্পর্ক চলছে, এর মাঝে হঠাৎ করে শেখ হাসিনার সরাসরি বক্তব্য দেওয়ার বিষয়টিতে অনেকেই মনে করছেন যে শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগ বিরতি ভেঙে ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছে।
যদিও আওয়ামী লীগের নেতা খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী বলেছেন, “আওয়ামী লীগ বরাবরই রাজনীতিতে আছে। তার নতুন করে ফিরে আসার তো কিছু নাই।”
নিউ ইয়র্কে শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে যেসব দাবি করেছেন, সেসবের অন্যতম ছিল– বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চলছে, এবং তিনি ও তার বোন শেখ রেহানাকে খুন করার চক্রান্ত করা হয়েছিলো ইত্যাদি।
“শেখ হাসিনা যা যা বলছেন, তা দেশের স্বার্থে বলছেন” উল্লেখ করে মি. চৌধুরী আরও বলেন, “দেশ এখন দুর্বৃত্তদের হাতে চলে গেছে। দেশকে, দেশের মানুষকে, দেশের সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করা আওয়ামী লীগের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ আওয়ামী লীগ এই দেশের সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত।”
এদিকে আজ বৃহস্পতিবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “বিদ্বেষমূলক বক্তব্য” গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সব ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিলো। যদিও চলতি বছরের অগাস্টে সেই আদেশ প্রত্যাহার করেছে হাইকোর্ট।
যদিও শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারের বিষয়ে আদেশের সমালোচনা করে মি. চৌধুরী বলেছেন, এটি “বাক স্বাধীনতা হরণ”।
তিনি বলেন, জন্মলগ্ন থেকেই আ’লীগ এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করে আসছে।
শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে সবরকম প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার দাবি করা হলেও লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করছেন, “শেখ হাসিনা বা তার দলের লোকেরা কে কী করছেন – না করছেন, এই পুরো বিষয়টা একটি খেলার অংশ।”
“এগুলো সব ফাঁকা আওয়াজ” বলছিলেন তিনি।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে শেখ হাসিনার বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, “শেখ হাসিনা যেখানে যা-ই বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য বিদ্বেষমূলক কথাবার্তাই বলছেন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে, উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলছেন।”
মি. আহমেদ মনে করেন, শেখ হাসিনার এগুলোর মাধ্যমে রাজনীতিতে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।
“বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এটিকে আমরা রাজনীতি বলতে পারি না,” বলেন মি. আহমেদ।
শেখ হাসিনার ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আদালতের আদেশকে ‘সঠিক’ এবং ‘সমর্থনযোগ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেন মি. আহমেদ।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “সর্বশেষ জুলাই-অগাস্টে তিনি দেশজুড়ে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন। এইরকম হত্যাকাণ্ড চালিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে তার আর রাজনৈতিক কাজ করার কোনও অধিকারের নৈতিক জায়গা থাকে না।”
তবে ওই ঘটনার পর শেখ হাসিনা ও তার দল এখন যা-ই করুক, “কথা বলে আর বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না তারা। কারণ তার সমস্ত জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে।”
শেখ হাসিনা “হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার জন্য উস্কানি প্রদান করছেন” বলে মনে করেন মি. সাকি।
শেখ হাসিনা ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক
শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে তার যেসব বক্তব্য সামনে এসেছে, সেসব সম্বন্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিনের মাথায়ই ভারতীয় হাইকমিশনারকে বলেছেন, শেখ হাসিনা যেন ভারতে বসে রাজনৈতিক বক্তব্য না দেন।
প্রাথমিকভাবে ভারতে বসে শেখ হাসিনাকে সরাসরি কোন বক্তব্য দিতে না দেখা গেলেও, তিনি পর্যায়ক্রমে দুটি লিখিত বিবৃতি দেন। এবং সর্বশেষ নিউ ইয়র্কের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে যে বক্তব্য দিয়েছেন এবং দিতে যাচ্ছেন, এসব নিয়ে সরকারের অবস্থান জানতে তৌহিদ হোসেনসহ সরকারের একাধিক দায়িত্বপ্রাপ্ত’র সাথে যোগাযোগ করেছিলো বিবিসি বাংলা। তবে তাদের কারও সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, “বিদেশে বসে কিছু কিছু লোক নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে বাংলাদেশের বিষয়ে এসব প্রচারণা চালাচ্ছেন। পুরোটাই ভারতের তৈরি পাণ্ডুলিপি বা চিত্রনাট্য।”
শেখ হাসিনা সেই চিত্রনাট্যের কেবলই একটি অংশ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “সেই হিসাবে তিনি এখানে আছেন। ভারতের কনসার্ন হচ্ছে, মিলিটারি এ্যান্ড ইকোনমিক যে সুবিধা দিয়ে আসছিলেন, সেই পরিস্থিতি তো পরিবর্তন হয়ে গেছে। সুতরাং, একটি রাজ্য হারানোর শোক তো ভারত করবেই।”
কিন্তু শেখ হাসিনার বক্তব্য যদি কোনও চিত্রনাট্যের অংশ হয়ও, তা থামাতে বাংলাদেশের কী করার আছে এবং দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো কোনও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে কি?
জানতে চাইলে মি. আহমদ বলেন, “এক্সিস্টিং পলটিক্যাল পার্টির জন্য এটি চ্যালেঞ্জ হবে তখন, যখন তারা কাউন্টার করতে না পারে। এটি নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলোর সক্ষমতার ওপরে।”
“তারা যদি সক্ষম হতে পারে, তাহলে তারা কাউন্টার প্রোপাগান্ডা দিয়ে ওটা সামাল দিবে। তাদের যদি সেই সক্ষমতা না থাকে, তাহলে তারা কিসের রাজনীতি করে? আমার কথা হল, আওয়ামী লীগ বিরোধী যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে, তাদেরও নাকি বিদেশে শাখা আছে। এখন তারা কী কাউন্টার প্রোপ্যাগান্ডা করছে, তা আমরা দেখতে চাই। সব তো এক তরফা হওয়ার কথা না।”
তবে ভারত যদি বাংলাদেশের সাথে বৈরি আচরণ করে যায়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ দীর্ঘিমেয়াদি সমস্যায় পড়তে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সূত্র:বিবিসি বাংলা।
তারিখ: ডিসেম্বর ০৫, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,