ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগ গতকাল রবিবার রাজধানীর জিরো পয়েন্টে নূর হোসেন চত্বরে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছিল। দলের সভাপতি শেখ হাসিনার ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপে এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে দলটির নেতাকর্মীদের তেমন দেখা মেলেনি। পুরো এলাকায় শক্ত অবস্থানে ছিল বিএনপির নেতাকর্মীসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা।
জিরো পয়েন্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণজমায়েত থেকে বলা হয়, যত দিন গণহত্যার বিচার না হবে, তত দিন আওয়ামী লীগের জনসমক্ষে আসার অধিকার নেই।
এই পরিস্থিতির মধ্যে আওয়ামী লীগ ও মহিলা লীগের কয়েকজন নূর হোসেন চত্বরের অদূরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পৌঁছলে তাদের মধ্যে পরিচিত মুখগুলো শনাক্ত হয়ে যায়। দুজন নারীসহ অন্তত ২০ জনকে পিটুনি দিয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দলটির প্রথমবারের মতো রাজপথের কর্মসূচি ছিল এটি।
তবে রাজধানীর কিছু এলাকায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতাকর্মীকে ঝটিকা মিছিল করতে দেখা যায়। সকালে রাজধানীর জিরো পয়েন্টে নূর হোসেন চত্বরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। শ্রদ্ধা নিবেদনের পরও বিএনপি ও তাদের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। জিরো পয়েন্ট ঘিরে বিভিন্ন সময় ছাত্রদল, যুবদলের নেতাকর্মীদের মিছিল করতে দেখা যায়।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই কর্মসূচি ঘোষণার পরপরই এর বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরে শনিবার ফেসবুকে পোস্ট দেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও ফেসবুক পোস্টে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে রাজপথে কোনো মিছিল-সমাবেশ বা কর্মসূচি পালন করতে না দেওয়ার ঘোষণা দেন তাঁরা।
বিক্ষোভ কর্মসূচির এই ঘোষণা দেওয়ার পরই তৎপর হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, বিএনপি, যুবদল, যুব মহিলা দল, জামায়াত, ছাত্রশিবিরসহ ছাত্র-জনতা। শনিবার ছুটির দিনেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোর কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সেই বৈঠকে আওয়ামী লীগের অপকৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। রাতেই পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ১০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
পুলিশের বক্তব্য
ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার একটি অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়। তাতে দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনা তাঁর দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ছবি ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ব্যবহার করে অবৈধ মিছিল-সমাবেশের মাধ্যমে সেসব ছবি ও প্ল্যাকার্ড ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার নির্দেশ দেন। এই পরিস্থিতিতে সেগুলো ভাঙচুর ও অবমাননার ফুটেজ সংগ্রহের নির্দেশনা দেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র যুক্তরাষ্টের সুসম্পর্ক বিনষ্টের অপচেষ্টার অংশ হিসেবে তাঁরা এই অপতৎপরতার পরিকল্পনা করেন। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার রাতে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ পর্যন্ত এই কুচক্রীমহলের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে বিপুল পরিমাণ উসকানিমূলক পোস্টার, ছবিসহ প্ল্যাকার্ড ও নগদ অর্থ উদ্ধার করা হয়।
তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী মহলের যেকোনো চক্রান্ত রুখে দেওয়ার জন্য তৎপর রয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। এসব অপকর্মের উসকানিদাতা, অর্থ জোগানদাতা ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ মঞ্চ
গতকাল নূর হোসেন চত্বরের পাশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ মঞ্চের’ আয়োজনে গণজমায়েত কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটের মূল সড়কে এই কর্মসূচি শুরু হয়। পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিতে এ আয়োজন করা হয়। বিকেল ৩টার দিকে কয়েক শ লোক উপস্থিত ছিল গণজমায়েত মঞ্চের সামনে। সেখানে শিক্ষার্থীরা বক্তব্য দেন। মঞ্চে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বক্তব্য দেন।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নািস বাহিনীর চেয়েও বেশি নৃশংস। বাংলাদেশে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের যত দিন পর্যন্ত না বিচার নিশ্চিত হয়, তত দিন পর্যন্ত তাদের প্রকাশ্যে আসার কোনো ধরনের অধিকার নেই। আওয়ামী লীগের বিচার লগি-বৈঠা থেকে শুরু হতে হবে। তাদের নৃশংসতা দেখা গেছে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে, শাপলা চত্বরে তারা অনেক আলেমকে রক্তাক্ত করে মেরেছে। আলেমসমাজকে দাড়ি টেনে টেনে বায়তুল মোকাররম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। গত ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে গুম, খুন, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।’
সারজিস আলম বলেন, ‘গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট তো দূরের কথা, এর আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেও গুজব লীগ যেন না নামতে পারে। মাঠে নামা তো দূরের কথা, কোনো জায়গায় বিন্দুমাত্র গুজবের চেষ্টাও যদি তারা করে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করব।’
তিনি আরো বরেন, ‘আমরা আমাদের বিপ্লবী ভাইদের বলতে চাই, নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো বিভাজনগুলো এক পাশে রেখে যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি, তাহলে এ রকম খুনি সংগঠন শুধু এই গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট নয়, বাংলাদেশের কোনো জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। যত দিন আপনাদের ভোটে একটি গণতান্ত্রিক সরকার না হচ্ছে, তত দিন ওই স্বৈরাচার হাসিনার উৎপাত দেখা গেলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির আহ্বায়ক আরমানুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের মূল সমস্যা রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে। এই কাঠামোতে যে ক্ষমতায় যায় সে-ই হয়ে ওঠে ফ্যাসিস্ট। এই রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তন করব।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম মঞ্চে কবিতা আবৃত্তি করেন।
দুই নারীসহ অন্তত ২০ জনকে পুলিশে হস্তান্তর
বিকেল ৩টায় রাজধানীর গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর দিকে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিতে আসেন মুন নামের আওয়ামী মহিলা লীগের এক কর্মী। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে থাকা মহিলা দলের কর্মীরা চিনে ফেলেন মুনকে। পরে মহিলা দলের কর্মীদের কাছ থেকে মুনকে পুলিশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আরেক নারীকেও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এর আগে দুপুর ১২টার দিকে এক বৃদ্ধ আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে এসে হঠাৎ ‘জয় বাংলা’ বলে স্লোগান দেন। ছাত্র-জনতা তাঁকে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করে। মারধরের সময় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ওই বৃদ্ধের নিরাপত্তা দিতে সচেষ্ট হতেও দেখা যায়। পল্টন থানার ওসি কাজী নাছিরুল আমিন জানান, কিছু লোক আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়েছিল। ছাত্র-জনতা তাদের ধরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হয়েছে।
এ ছাড়া গতকাল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে যাকেই আওয়ামী লীগ কর্মী বলে সন্দেহ হয়েছে তাকেই হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। আগের রাতে অন্তত সাতজনকে আওয়ামী লীগের কর্মী সন্দেহে পুলিশে দেওয়া হয়। শাহবাগ থানার ওসি মোহাম্মদ খালেদ মনসুরের কাছে জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না। আমরা অভিযানে আছি।’
কিছু এলাকায় ‘ঝটিকা’ মিছিল
পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজধানীতে কিছু এলাকায় ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিল করেন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী। গতকাল বিকেল ৪টার দিকে গুলিস্তান বিআরটিসি বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ব্যানারে শতাধিক নেতাকর্মী বিক্ষোভ করেন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সামনে থেকে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের আরেকটি বিক্ষোভ মিছিলে যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেন। মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের উল্টো পাশের গলি থেকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী বিক্ষোভ মিছিল করেন।
বিজিবি মোতায়েন
গতকাল সকালে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদর দপ্তর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ১৯১ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
সূত্র:কালের কন্ঠ।
তারিখ: নভেম্বর ১১, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,