মানুষের মুখে মুখে ফেরা আয়নাঘরখ্যাত গোপন বন্দিশালার অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে এসব বন্দিশালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুমের শিকার ব্যক্তিদের আটকে রাখা হতো। ভুক্তভোগীরা গোপন কারাগারগুলো সংরক্ষণ চাইলেও বাহিনীগুলো এরই মধ্যে কাঠামোতে পরিবর্তন এনেছে।
গুম-সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, ৪০০ অভিযোগ পাওয়া গেছে। গোপন বন্দিশালার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে। দেয়ালের লেখাগুলো রং করে মুছে দেওয়া হয়েছে।
চিলির স্বৈরশাসক অগাস্টো পিনোশের ১৬ বছরের শাসনামলে ৩ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা এবং দেড় হাজারের বেশি রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বীকে গুম করা হয়। তাঁর পতনের পর সন্ধান মেলে ১৭টি নির্যাতন কেন্দ্রের। পিনোশের গোপন পুলিশখ্যাত ডিইএনএ পরিচালিত বন্দিশালাগুলো স্বৈরশাসনের দুঃসহ স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ রয়েছে, যা বাংলাদেশে হচ্ছে না।
২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রামকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমাকে। তাঁর দাবি, ঢাকা সেনানিবাসের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কার্যালয়ের বন্দিশালায় তাঁকে রাখা হয়েছিল। পাঁচ বছরের বেশি সময় বন্দি থাকার পর ৬ আগস্ট মুক্তি পান। সাবেক ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহিল আমান আযমী জানিয়েছেন, তাঁকেও আটকে রাখা হয়েছিল একই বন্দিশালায়। এতদিন এসব অভিযোগের পর্যায়ে থাকলেও কমিশনের মাধ্যমে এই প্রথম সরকারি ভাষ্যে আয়নাঘরের অস্তিত্ব সামনে এলো। যদিও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সমর্থকরা আয়নাঘরকে সব সময় কথিত বলে এসেছেন।
কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘পরিদর্শনের সময়ে ডিজিএফআইর যে আয়নাঘর দেখেছি, এর সঙ্গে ভুক্তভোগীদের বর্ণনার মিল পেয়েছি। তবে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ তারা নষ্ট করেছে। বিশেষ করে দেয়ালের লেখাগুলো পেইন্ট করে মুছে দেওয়া হয়েছে। মৌখিকভাবে তাদের বলেছি এবং লিখিতভাবেও জানিয়েছি– যে অবস্থায় আয়নাঘর দেখে এসেছি, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কোনো পরিবর্তন যেন না হয়।’
মাইকেল চাকমা সমকালকে বলেছেন, যদি গোপন বন্দিশালার পরিবর্তন আনা হয়ে থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলো অপকর্মের দায় নিজেদের ওপর নিচ্ছে, সরকারের দোষ আড়ালের চেষ্টা করছে। তারা বলতে পারত– আমরা নই, শেখ হাসিনা গুম করেছে। গোপন কারাগার ভেঙে ফেলা মানে আলামত ধ্বংস, যা আরেকটি অপরাধ।
গোপন বন্দিশালাগুলো সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের সরকারগুলো এ থেকে শিক্ষা নেয়; স্বৈরাচারী না হয়।
একাধিক সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, গুমের সঙ্গে অতীতে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা স্বীকার না করলেও, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভাবমূর্তি রক্ষায় গোপন বন্দিশালাগুলো রাখতে চায় না বাহিনীগুলো। কমিশনকেও এ কথা জানানো হয়েছে। শেখ হাসিনার আমলে ডিজিএফআইয়ের যে বন্দিশালা ছিল তা শুধু বন্ধ নয়, অপসারণ করতে চায়। ভেতরের কুঠুরিগুলো ভেঙে একতলা ভবনটির অভ্যন্তরে পরিবর্তন আনতে কাজ চলছে। এ জন্য নতুন ইট আনা হয়েছে বলে সমকাল জানতে পেরেছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যানুযায়ী, শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনকালে অন্তত ৬৭৭টি গুমের ঘটনা ঘটেছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ। সমকাল অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন, যারা সাত দিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত গুম ছিলেন।
শেখ হাসিনার শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে গত ২৭ আগস্ট কমিশন গঠন করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। ১৫ সেপ্টেম্বরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা, তদন্ত সংস্থাসহ সরকারি মদদে গুমের তথ্য সংগ্রহ করবে কমিশন। দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা এবং গুম প্রতিরোধে করণীয় বিষয়েও সুপারিশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের।
গুলশান কার্যালয়ে কমিশনের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৩ কর্মদিবসে ৪০০ অভিযোগ জমা পড়েছে। কমিশনের সভাপতি বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ অনুযায়ী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা ডিজিএফআই কার্যালয়ে গিয়ে গোপন বন্দিশালার সন্ধান মিলেছে। ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলটি (জেআইসি) ডিজিএফআইয়ের সদরদপ্তরেই। ওই আয়নাঘরে বন্দি রাখার ২২টি সেল রয়েছে।
সমকাল জানতে পেরেছে, ২২টি কুঠুরির দুটি ছিল ‘ভিআইপি’। এর একটিতে রাখা হয়েছিল আমান আযমীকে। তিনি ও অন্য ভুক্তভোগীদের বর্ণনা অনুযায়ী, আয়নাঘরের কুঠুরিগুলো ৬-৭ ফুট প্রশস্ত, উচ্চতা ১৫-১৬ ফুট, বন্দিদের শব্দ লুকাতে চারটি অ্যাগজস্ট ফ্যান রয়েছে, দুটি শৌচাগারেই হাই-কমোড এবং প্যান রয়েছে। পরিদর্শনেও এসব তথ্যের মিল পাওয়া গেছে।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেছেন, আলামত মামলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে কমিশনের প্রতিবেদনে যেহেতু গোপন বন্দিশালাগুলোর বর্ণনা এসেছে, তাই এগুলো নষ্ট করলেও অপরাধ প্রমাণে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। কিন্তু এগুলো যেভাবে রয়েছে, সেভাবেই রাখা উচিত।
কমিশনের সভাপতি জানান, সবচেয়ে বেশি গুমের অভিযোগ এসেছে র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি ও সিটিটিসির বিরুদ্ধে। ২৫ সেপ্টেম্বর ডিজিএফআইয়ের আয়নাঘর পরিদর্শন করেছি। ১ অক্টোবর ডিবি ও সিটিটিসি কার্যালয় পরিদর্শন করেছেন কমিশনের সদস্যরা। সেখানে কোনো বন্দিকে পাওয়া যায়নি। সম্ভবত ৫ আগস্টের পর সেখান থেকে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ডিজিএফআইয়ের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। র্যাবের বিভিন্ন কার্যালয়ে গোপন বন্দিশালা রয়েছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এমন চারজন সমকালকে জানিয়েছেন, রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় র্যাব-১ কার্যালয়ে মসজিদের কাছাকাছি আয়নাঘরে তাদের ৮৮ থেকে ১৯২ দিন পর্যন্ত চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল।
৫ আগস্টের পর র্যাব গোপন বন্দিশালার বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দেয়নি। পুলিশের এ ইউনিটটির মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস গতকাল সমকালকে বলেছেন, গুম-সংক্রান্ত কমিশনের সদস্যরা র্যাব কার্যালয়ে আসেননি। তদন্তে কমিশনকে যে কোনো সহায়তা করবে র্যাব।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের দুই নেতা শাহ মো. ওয়ালীউল্লাহ এবং মোকাদ্দেস আলীকে ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে তুলে নিয়ে যায় র্যাবের পোশাক পরা এবং সাদা পোশাকধারী কয়েকজন। উচ্চ আদালতে রিটেও সন্ধান মেলেনি তাদের।
পিরোজপুর সদরের মোকাদ্দেস পড়তেন তখন অনার্স শেষ বর্ষে। কুষ্টিয়া যেতে সহপাঠী ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে ঢাকার গাবতলী থেকে হানিফ পরিবহনের বাসে চড়েছিলেন। মোকাদ্দেসের বাবা আবদুল হালিম সমকালকে বলেছেন, গাড়ির নম্বর ছিল ৩৭৫০। বাসটি নবীনগর পৌঁছার পর র্যাবের গাড়ি থামার সংকেত দেয়। র্যাব সদস্যরা বাসে উঠে মোকাদ্দেস ও ওয়ালীউল্লাহকে নামিয়ে নিয়ে যান। সুপারভাইজার আমাদের পরে জানান, একজন র্যাব সদস্যের বুকের নেমপ্লেটে লেখা ছিল জামান। গাড়িতে লেখা ছিল র্যাব-৪।
আবদুল হালিমও চান গোপন বন্দিশালাগুলো সংরক্ষণ করা হোক। তাঁর আর্জি পুলিশ, ডিজিএফআই, এনএসআইসহ বিভিন্ন সংস্থার যেসব গোপন কারাগার ছিল, সেগুলো ভুক্তভোগী স্বজনকে দেখতে দেওয়া হোক। তিনি বলেছেন, ‘আমি একটু দেখতে চাই, আমার ছেলেটাকে কোথায় রেখেছিল, তার সঙ্গে কী করেছিল।’
গুমের সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে– তা এখনও নিশ্চিত নয়। শেখ হাসিনার পতনের পর কয়েকজন ভুক্তভোগী আদালতে মামলা করেছেন। কয়েকজন অভিযোগ দিয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
সংবাদ সম্মেলনে মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যারা গুম হয়েছেন, তাদের অভিযোগ নিয়ে কাজ করেছি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদেরও ডাকা হবে। বক্তব্যের জন্য সমন দেওয়া হবে। অভিযুক্তরা না এলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভিযোগ জমার সময় ছিল। ১০ অক্টোবর পর্যন্ত তা বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে সভাপতি বলেন, ৭৫ জন সশরীরে এসে অভিযোগ দিয়েছেন। বাকিরা ডাকযোগে ও ই-মেইলে পাঠিয়েছেন। তিন মাসে তদন্ত শেষ হবে কিনা– তা আগামী দিনে বোঝা যাবে। অভিযোগ জমার সময় আরও বাড়ানো হবে।
কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, ভুক্তভোগীর পরিচয় দিয়ে তাঁকে আলাদা করব না। প্রতিটি অভিযোগ আমরা শুনতে চাই। কী হয়েছিল জানতে চাই। কীভাবে আইন না মেনে বন্দি রাখা হয়েছিল, তা বুঝতে চাই।
৪০০ অভিযোগের মধ্যে অনেকগুলো ঘটনা প্রথম সামনে এসেছে বলে জানান কমিশনের আরেক সদস্য নাবিলা ইদ্রিস। তিনি বলেন, তারা এর আগে কথা বলেননি। থানায় তাদের জিডিও নেওয়া হয়নি। ঢাকার বাইরে থেকেও অনেক অভিযোগ আসছে। কেউ আসতে না পারলে ডাকযোগে, ই-মেইলে অভিযোগ পাঠাতে পারেন। সেগুলোও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। ফোন করে তাদের কথাগুলো শুনব আমরা।
সূত্র:সমকাল।
তারিখ: অক্টোবর ০৪, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,