বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার এখন পাকিস্তানের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে এ হার কিছুটা কমলেও তা দুই অংকের ঘরেই রয়েছে এখনো। গত মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
ডলারসহ অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি উসকে ওঠা দেশগুলোর একটি ছিল শ্রীলংকা। দুই বছর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটির মূল্যস্ফীতির হার ঠেকে ৭০ শতাংশে। বৈদেশিক দায় পরিশোধে ব্যর্থতায় নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করা দেশটির মূল্যস্ফীতি এখন ১ শতাংশেরও নিচে। গত আগস্টে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল দশমিক ৫ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতির হার দীর্ঘদিন ধরেই ছিল দুই অংকের ঘরে। অর্থনৈতিক সংকটে হাবুডুবু খাওয়া দেশটির মূল্যস্ফীতির হারও এরই মধ্যে এক অংকের ঘরে নেমে এসেছে। গত মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। যদিও এক বছর আগে ২০২৩ সালের আগস্টে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ২৭ শতাংশেরও বেশি।
এ অনুযায়ী গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন সর্বোচ্চে।
বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটান। এ সাত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলে সবচেয়ে কম মূল্যস্ফীতি এখন শ্রীলংকায়। আগস্টে শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতির হার ছিল মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ১ দশমিক ৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি রয়েছে মালদ্বীপে।
ভুটানে ২ দশমিক শূন্য ৪, নেপালে ৩ দশমিক ৫৭, ভারতে ৩ দশমিক ৬৫ ও পাকিস্তানে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এর মধ্যে মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটানে মূল্যস্ফীতির তথ্য জুলাই পর্যন্ত হালনাগাদকৃত। দেশগুলোর সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে সেখানে নিত্যপণ্যসহ সার্বিক দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। সে অনুযায়ী, আগস্টেও দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতির হারে খুব বেশি পরিবর্তন ঘটেনি।
বাংলাদেশে গত দুই অর্থবছরজুড়েই মূল্যস্ফীতির গড় হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। যদিও বিবিএস প্রকাশিত এ মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন রয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সংস্থাটির দেওয়া মূল্যস্ফীতির তথ্যের ব্যবধান অনেক বেশি বলে দাবি করে আসছিলেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।
তাদের ভাষ্যমতে, বিগত সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনামলে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির বর্ণনার প্রচারের কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম বিবিএস। সংস্থাটিকে ব্যবহার করে জনসংখ্যা, জিডিপির আকার-প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রতিটি খাতেই ভুল ও প্রশ্নবিদ্ধ পরিসংখ্যান তৈরি ও উপস্থাপন করা হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পরও বিবিএস থেকে মূল্যস্ফীতির যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরও আগস্টে মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক বরকত-ই-খুদা বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। বিবিএস ঘোষিত মূল্যস্ফীতির হারই ১১-১২ শতাংশ। তবে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার আরো বেশি। এ-সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরবরাহ একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। সরবরাহ থাকলে সেক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে সিন্ডিকেট, যা অনেক দিন ধরেই দেশে চলছে। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও সাধারণ মানুষ বাজারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারছে না। সিন্ডিকেট করে কৃত্রিমভাবে পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে তথ্যের যথার্থতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে।’
সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। যদিও গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যের কথা বলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশের সীমাও তুলে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে দফায় দফায় বাড়ানো হয় নীতি সুদহার। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত অর্থবছরের মধ্যেই ঋণের সুদহার ৯ থেকে বেড়ে প্রায় ১৫ শতাংশে ঠেকে। যদিও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান হতে দেখা যায়নি।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গভর্নর হিসেবে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর নিয়োগ পান। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি নীতি সুদহার (রেপো রেট) ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করেন। এর পরও মূল্যস্ফীতি না কমলে নীতি সুদহার ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর আভাস দিয়েছেন নতুন গভর্নর। বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোয় ঋণের সুদহার ১৬-১৭ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। ব্যাংক খাতের সঙ্গে খুচরা বাজারের বিনিময় হারের ব্যবধান ১ শতাংশে নেমেছে। বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোয় প্রতি ডলার লেনদেন হচ্ছে সর্বোচ্চ ১২০ টাকায়।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি কমাতে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. বিরূপাক্ষ পাল। তিনি বলেন, ‘সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার মুখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও কাজেকর্মে তার প্রকাশ ঘটাননি। এ কারণে মূল্যস্ফীতিও কমেনি। বরং তথ্য জালিয়াতি করে মূল্যস্ফীতির হার কম দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক একজন প্রকৃত অর্থনীতিবিদকে গভর্নর হিসেবে পেয়েছে। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে পদক্ষেপগুলোর সুফল পেতে হলে গভর্নর, অর্থ উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। বাজার ব্যবস্থায় সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।’
**** সূত্র : বণিক বার্তা।
সূত্র:কালের কন্ঠ।
তারিখ: সেপ্টম্বর ১৮, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,