লেখা:কায়েস আহমেদ সেলিম।
বাংলাদেশের স্বনামধন্য জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর, যিনি বিগত বছরগুলোয় ব্যাংক খাতের বিপর্যয় নিয়ে সরব ছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগ্রহে ১৩ আগস্ট তিনি ব্যাংক খাতের অভিভাবকের দায়িত্ব নেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আর্থিক খাতের সংস্কারে নানামুখী সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। এতে নিজের গতিপথ ফিরে পাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সমসাময়িক অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
যুগান্তর : বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা কেমন?
গভর্নর : বিগত দিনে আর্থিক খাত ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক রকমের লুটতরাজ, অপকর্মের মাধ্যমে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সমস্যা পরিচালনা পর্ষদেই ছিল। তারাই মালিক হয়ে ব্যাংক লুটপাট করেছিল। আমরা পর্ষদগুলো পরিবর্তন করে দিয়েছি। ভালো মানুষগুলোই এখন ব্যাংক পরিচালনা করছেন। আমি আশা করব, আমানতকারীরা তাদের আস্থা ফিরে পাবেন। ব্যাংকগুলোয় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। আগের মতোই ব্যবসা পরিচালনা করবে। বর্তমানে আর্থিক খাত নিয়ে আমি উৎসাহবোধ করছি। উদাহরণ হিসাবে বলি, ইসলামী ব্যাংক ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এখন এটি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তাদের নগদ অর্থের সংকট আগের মতো নেই। মানুষ এখানে আবার টাকা জমা দিচ্ছে, তুলতেও পারছে। তাদের সংকটটা অনেকখানি কেটে গেছে।
যুগান্তর : অনেকে বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রীলংকার পর্যায়ে গেছে, বিষয়টি কতটা সত্য?
গভর্নর : আমি বলব, এটি সঠিক নয়। আমরা শ্রীলংকার মতো ভঙ্গুর নই। আমাদের এখনো প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আছে। ন্যূনতম রিজার্ভ সংরক্ষণের সীমা অতিক্রম করিনি। দ্বিতীয়ত, আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের তুলনায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এটি একটি ভালো দিক। তৃতীয়ত, আমাদের মুদ্রার বিনিময় হার প্রায় স্থির হয়ে গেছে। তিন মাসের বেশি সময় ডলারের বিনিময় হার ১২০ টাকায়ই আছে। এই স্থিতিশীলতা আমরা ধরে রাখব। আমরা সুদহার বাড়িয়ে, অর্থপ্রবাহ আরও সংকুচিত করে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনব। গত মাসে মূল্যস্ফীতি ১ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে। এটি যদি আমরা ধরে রাখতে পারি এবং আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৭ শতাংশে নিয়ে আসতে পারি, তবে মানুষের আস্থা পুরোপুরি চলে আসবে। আমাদের প্রচেষ্টা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রাখা। বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা। মুদ্রা প্রবাহের সংকোচন নীতি বজায় রাখা। আমরা চেষ্টা করব আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার। ইতোমধ্যে পর্ষদ পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেকখানি সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। নবগঠিত পর্ষদগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রতি সপ্তাহেই সভা হচ্ছে। আমরা তাদের আশ্বস্ত করছি এবং সহায়তাও দিচ্ছি। সব মিলিয়ে আশা করি, সংকটের তলানিটা আমরা দেখে ফেলেছি। এখন আমরা উপরের দিকে নজর দেব।
যুগান্তর : ব্যাংক খাতের সংস্কারে স্বতন্ত্র পরিচালকদের একটি পুল বানানোর কথা শোনা যাচ্ছে। কী উদ্দেশ্যে এটি করা হচ্ছে এবং অগ্রগতি কেমন?
গভর্নর : ব্যাংক খাত সংস্কারের লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছি। তারা রোববার থেকে কাজ শুরু করেছে। টাস্কফোর্সের অধীনেই আমরা ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের জন্য একটি ‘পুল’ তৈরি করব। আমাদের উদ্দেশ্য, ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে যাতে কারও আত্মীয়, বন্ধু আসতে না পারে; সেজন্যই এই ব্যবস্থা। যোগ্য, সৎ এবং যাদের বিষয়ে নেতিবাচক কোনো অভিযোগ নেই-এমন ব্যক্তিদের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে আমরা নিয়োগ দিতে চাই। একটি পুল থাকবে। এর বাইরে যাওয়া যাবে না। তবে যদি খুব যোগ্য ব্যক্তি হন যিনি পুলে নেই, তাকে নিয়ে আসতে হবে, তখন তার নাম প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিবেচনা করে তাকে অনুমোদন দেবে।
যুগান্তর : বড় গ্রাহকদের বড় ঋণ দেওয়া নিরুৎসাহিত করা হবে কি না? কারণ, বড় গ্রাহককে ঋণ দেওয়া বন্ধ হলে ব্যাংকের তারল্য সংকট কেটে যাবে বলে অনেকের ধারণা।
গভর্নর : এখানে দুটি জিনিস মনে রাখতে হবে। বড় গ্রাহককে বড় ঋণও দিতে হবে। তার তো চাহিদা বেশি। কার্যক্রম অনেক বড়। আমদানি-রপ্তানি সবকিছুই বেশি হয়। কাজেই তাকে অবশ্যই বেশি ঋণ দিতে হবে। তবে এটাও ঠিক, ঋণ যাতে এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এখানে দুটি জিনিস নিশ্চিত করা দরকার ছিল, যা আগে করা হয়নি। সেটা হলো-একক গ্রাহক ঋণসীমা, যা ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি হবে না। এটি অনুসরণ করা উচিত প্রতিটি ব্যাংককে। দ্বিতীয়ত, ২৫ শতাংশ করে আমি অনেক ব্যাংক থেকে নিতে পারি। সেই ক্ষেত্রে আমাকে দেখতে হবে, মোট ঋণের পরিমাণও যাতে খুব বেশি না হয়। এ দুটি জিনিস এবং তার ঋণ পরিশোধের ইতিহাসের ওপর নির্ভর করে ঋণ দিতে হবে। ছোট প্রতিষ্ঠানের চাহিদা এবং বড় প্রতিষ্ঠানের চাহিদা এক হবে না। আবার বড় প্রতিষ্ঠানকে তো আমি মারতেও পারব না। হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী সেখানে চাকরি করে। সেক্ষেত্রে বড় প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনায় নিতেই হবে।
যুগান্তর : আমরা দেখছি বর্তমানে বড় আমানতকারীরা সরকারি ব্যাংকে টাকা রাখতে উৎসাহিত হচ্ছে। তাহলে বেসরকারি ব্যাংকে সংকট কাটবে কীভাবে?
গভর্নর : সবাই যে সরকারি ব্যাংকে টাকা রাখছে তা নয়। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশ আছে যারা আমানত পাচ্ছে। মানসম্মত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানতকারীরা যাচ্ছেন। এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আমরা নতুন বোর্ড করে দিয়েছি। যেগুলো দুর্বল, সেগুলোও সবল করার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমি গণমাধ্যমে বলেছি, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেই আমরা রক্ষা করব, প্রত্যেক বিনিয়োগকারীকেই সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করব। আমরা আশা করি, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তাদের আমানতকারীর আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে এবং সবই মানসম্মত প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠবে। সবই যদি মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হয়, তাহলে তো অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হয় না।
যুগান্তর : প্রচলিত কোনো নোট কি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে?
গভর্নর : কোনো নোটই বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে না। পরিষ্কারভাবেই বলছি, কোনো নোট বাজেয়াপ্ত করা হবে না।
যুগান্তর : ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবেন কি?
গভর্নর : ব্যাংক মার্জারের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আগে হিসাবনিকাশের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র বের করা হবে। এজন্য নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। সেজন্য বাইরে থেকে অর্থায়নের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বাইরে থেকে আন্তর্জাতিক মানের অডিটর এনে নিরীক্ষা করানো হবে, যেন কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে।
যুগান্তর : পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কি না?
গভর্নর : পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। পাচারের অর্থ ফেরাতে আলাদা একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে। সেই টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটি নিশ্চিত থাকেন, কোনো পাচারকারী কোথাও শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না।
যুগান্তর : বাংলাদেশ কি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করেন?
গভর্নর : আমরা আশা করছি, বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। ইতোমধ্যে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর পর্যায়ে চলে এসেছি। আমাদের নিচের দিকে যাওয়ার আর কোন শঙ্কা দেখছি না।
যুগান্তর : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
গভর্নর : আপনাকেসহ যুগান্তরকে ধন্যবাদ।
সূত্র: যুগান্তর।
তারিখ: সেপ্টম্বর ১৮, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,