জনবান্ধব প্রশাসন গড়তে চাইছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এই প্রশাসনে দুর্নীতিবাজ কারও ঠাঁই হবে না। সুশাসন নিশ্চিতে প্রত্যেককে কাজের ক্ষেত্রে সৎ থাকতে হবে। সরকারি কেনাকাটায় পরিচয় দিতে হবে নৈতিকতা ও সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের।
নিজের পাশাপাশি অধীনস্থদের দুর্নীতিমুক্ত রাখতে না পারার দায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ঘাড়েও বর্তাবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রের দাবি, কর্মচারীদের প্রতি ইতোমধ্যে এমন কড়া বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে হবে দুর্নীতিবিরোধী সমন্বিত অভিযান।
দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গঠনের অংশ হিসেবে কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়া, গাড়িবিলাস পরিহার ও অনিয়ম-দুর্নীতি করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান সমকালকে বলেন, ‘সরকারি কর্মচারী কাজ করবেন আইন ও বিধি মেনে। এর বাইরে কিছু করলে তা দুর্নীতি। এটি আর হতে দেওয়া হবে না। সবাইকে বলে দিয়েছি– আমরা আর দুর্নীতি দেখতে চাই না, শব্দটিও শুনতে চাই না।’ তিনি বলেন, ‘এতদিন দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ জিরো টলারেন্স, হাতি-ঘোড়া বহুকিছু শুনেছে। এসবে কোনো লাভ নেই, বলতেও চাই না। যেখানে যা করা দরকার, তা করতে আমরা পিছপা হবো না। আমরা সাহসের সঙ্গে বিধি অনুযায়ী কাজ করব।’
সিনিয়র সচিব ও সচিব পদমর্যাদার সব কর্মকর্তা দুর্নীতিবিরোধী ‘বার্তা’ পেয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুরুত্বপূর্ণ এক মন্ত্রণালয়ের সচিব জানান, তাদের বলে দেওয়া হয়েছে– অধীনস্থদের দুর্নীতি ঠেকাতে না পারলে দায় ঊর্ধ্বতনের। অন্যের অপকর্মের দায় কেউই নিতে চাইবে না। ফলে প্রত্যেকে নিজ অবস্থান থেকে কঠোর থাকবে।
দুর্নীতিবিরোধী একগুচ্ছ পদক্ষেপ
১ সেপ্টেম্বর সব কর্মচারীর সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে বলেছে সরকার। বর্তমানে জনপ্রশাসনে এটিই সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বেশির ভাগ কর্মকর্তা এটিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তারা বলছেন, ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অপকর্মে জড়িত গুটি কয়েক। তাদের কারণে সবার দুর্নাম হয়। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের মর্যাদা সমুন্নত হবে। অতীতে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কিংবা বিভাগীয় মামলায় শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে ভয় কাজ করছে। যদিও প্রকাশ্যে সরকারের পদক্ষেপকে তারাও সাধুবাদ জানাচ্ছেন।
বিদ্যমান আইনে সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে
প্রবেশের সময় স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা দিতে হয়। এর পর পাঁচ বছর অন্তর সম্পদের বৃদ্ধি-কমার বিবরণী নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে জমা দেওয়া নিয়ম। দুর্নীতি রোধ ও চাকরিজীবীদের জবাবদিহি নিশ্চিতে আচরণবিধিতে এ নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না। এ বিষয়ে মোখলেস উর রহমান বলেন, ‘নানা প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি। কেউ বলছেন, এতদিন দিতে হয়নি কিংবা দিলেও নামমাত্র। এবারের ঘোষণাও কাজে দেবে না। করযোগ্য আয় যাদের, তারাই শুধু আয়কর বিবরণী জমা দেন। কিন্তু এখন সবাইকে জমা দিতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এটি সতর্ক বার্তা। দিন শেষে আবারও প্রমাণিত হলো– যার সম্পদ কম, স্বচ্ছতা আছে, লোভ নেই, সেই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন।’
জানা যায়, এরই মধ্যে ফরম তৈরি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অনুমোদনের পর সেটি পূরণ করতে হবে সরকারি কর্মচারীদের। সিনিয়র ওই সচিব বলেন, দুদক সচিবকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি আগামী সাত দিনের মধ্যে এক পাতার বাংলা ফরমেট তৈরি করবে। স্থাবর-অস্থাবরসহ অন্যান্য সম্পত্তির তথ্য এতে উল্লেখ করে মন্ত্রণালয় ও বিভাগে একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে জমা দিতে হবে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এটি ফাংশনাল হবে। এ সময়ের মধ্যে ফরমগুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পৌঁছে দেব এবং কবে দাখিল করতে হবে, তাও জানানো হবে।
সূত্রের দাবি, সম্পদের মতো সরকারি কর্মচারীর যথেচ্ছ গাড়ি ব্যবহারের লাগাম টানা হচ্ছে। বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ের সচিব অধীনস্থ দপ্তরগুলোর একাধিক গাড়ি, জ্বালানি ও চালক ব্যবহার করেন। স্ত্রী, ছেলে-মেয়েও একাধিক গাড়ি ব্যবহার করেন। এতে সরকারের ব্যয় বেড়ে যায়। অনেকে প্রকল্পের গাড়িও ব্যবহার করেন। এ অবস্থায় গত সোমবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং আওতাধীন দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তাদের প্রাধিকারবহির্ভূত গাড়ি ব্যবহার বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, কোনো সরকারি কর্মচারী নিজ পদপদবির ব্যবহার করে প্রভাব খাটিয়ে আগামীতে দুর্নীতি বা অপকর্মে জড়ালে, তাকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, সুশাসন বিঘ্নকারী এসব কার্যকলাপের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মুখ চিনে কোনো সিদ্ধান্ত দেবে না সরকার।
কেউ বাদ পড়বে না হিসাব বিবরণী থেকে
সরকারি বেতনভুক্ত কোনো পেশার লোকজন বাদ পড়বে না সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেওয়া থেকে। বিশেষ করে প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস ও কর ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব আগে নেওয়া হবে। বিচারকদের সম্পদের হিসাব নেওয়া এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।
গত ১৪ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার পর বিচার বিভাগীয় সব কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের দেশে-বিদেশে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব বিবরণী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এর পর ২২ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব বিবরণী ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে সম্পদের হিসাব বিবরণীর একটি ফরম দেওয়া হয়। জানা যায়, এরই মধ্যে সবাই আদেশ প্রতিপালন করে সম্পদের হিসাব জমা দিয়েছেন।
নিবন্ধন অধিদপ্তর ও এর অধীন মাঠ পর্যায়ে কর্মরত রেজিস্ট্রেশন বিভাগের কর্মকর্তা (সাব-রেজিস্ট্রার ও জেলা রেজিস্ট্রার) এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরও সম্পদের হিসাব জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। চিঠি পাওয়ার ১০ কার্যদিবসের মধ্যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব এবং ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিতে বলা হয়েছে।
নিবন্ধন অধিদপ্তরের অধীনে সারাদেশে রেজিস্ট্রার ও সাব-রেজিস্ট্রার কাজ করেন। সাব-রেজিস্ট্রার দলিল নিবন্ধন করেন। চিঠিতে বলা হয়, নিবন্ধন অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশন বিভাগের কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের স্বামী-স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এবং মা-বাবার দেশে ও বিদেশে থাকা সম্পদের হিসাব নির্দিষ্ট ফরম অনুযায়ী দাখিল করার জন্য বলা হলো। ফরমে জমি, বাড়ি-গাড়ি, ফ্ল্যাট, অলংকার, শেয়ার, বীমাসহ বিভিন্ন সম্পদের তথ্য, সম্পদের অবস্থান, কেনা সম্পত্তির অর্থের উৎস দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বিগত বছরের টিআইএনের কপি সংযুক্ত করতে বলা হয়েছে। তবে শ্বশুর-শাশুড়ির সম্পদের হিসাব দেওয়া নিয়ে রেজিস্ট্রেশন বিভাগের কর্মকর্তারা জোরালো আপত্তি জানালেও গা করেনি আইন মন্ত্রণালয়।
সূত্র:সমকাল।
তারিখ: সেপ্টম্বর ০৬, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,