বাংলাদেশে ভারতের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। হাসিনার পতনের ঘটনায় বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব কমবে, এমনটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন সুমিত গাঙ্গুলি।
দেশব্যাপী সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার (৫ আগস্ট) পদত্যাগ করেন। একটি সামরিক বিমানে চড়ে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি যখন প্রাথমিকভাবে নয়াদিল্লির বাইরে হিন্দন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করেন, তখন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েছিলেন।
তিনি (হাসিনা) যদি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চান, দেশটির সরকার সম্ভবত তাঁকে সেই আশ্রয় দেবে—এমনকি যদি এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে টানাপোড়েন দেখা দেয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সেই সময় যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের পরিবারের জন্য সরকারি চাকরিতে (সিভিল সার্ভিস) কোটা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে কয়েক সপ্তাহ আগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল।
এই আন্দোলন পরে গণবিক্ষোভে রূপান্তরিত হয়। হাসিনা সরকারের তরফ থেকে তা কঠোরভাবে দমনের চেষ্টা করা হয়। তাঁর সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি পদত্যাগ করেন এবং দেশ ছাড়েন।
হাসিনার পদত্যাগের পর মঙ্গলবার দেশটির সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর দেশটির রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন।
বাংলাদেশে ক্ষমতার আকস্মিক এই পরিবর্তন ভারতের জন্য একটি দ্বিধা বা সংশয় হিসেবে হাজির হয়েছে। ঢাকায় নতুন একটি সরকার ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে, যা দেশটির বাণিজ্য, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে।
সোমবার (৫ আগস্ট) হাসিনার সঙ্গে দোভালের সাক্ষাৎ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, সেটারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
হাসিনা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন মোদি। হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইসলামপন্থী কট্টর গোষ্ঠীগুলোকে দমন করতে এবং যৌথ নদীর পানি ভাগাভাগির জটিল ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত মোদি হাসিনা সরকারের অনেক ভুলত্রুটি উপেক্ষা করতে প্রস্তুত ছিলেন। অপরদিকে ভারত বাংলাদেশকে যথেষ্ট অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিতে ইচ্ছুক ছিল।
ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ভারত গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেছিল। তবে দেশ দুটির সম্পর্ক সব সময় মসৃণ ছিল না। এর প্রধান দুটি কারণ হলো, নদীর পানি ভাগাভাগি ইস্যু এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে বেশ কিছু বিষয়ে ভারতের উদ্বেগ। এই উদ্বেগগুলোর একটি হলো, বাংলাদেশ থেকে ভারতে অভিবাসন।
১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশে দীর্ঘ সামরিক শাসনে ভারত সন্তুষ্ট ছিল না। ১৯৭৫ সালের একটি রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা (এবং হাসিনার পিতা) তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি নয়াদিল্লির কাছাকাছি বা ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বাংলাদেশের সামরিক সরকারগুলো ভারতের ‘বিরক্তিকর’ প্রতিবেশী পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল।
হাসিনার পদত্যাগের ফলে ভারতের এখন দুটি বাধ্যতামূলক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশে যে সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, সেই সরকারকে নিয়ে আগামী দিনগুলোকে ভারতকে উদ্বিগ্ন থাকতে হবে।
সাম্প্রতিক আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপক ক্র্যাকডাউন চালিয়েছে। এর ফলে দলটির জনসমর্থন নিয়ে সংশয়-সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে দলটি ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হবে, এমন সম্ভাবনা নেই।
হাসিনার আমলে ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লি যে ‘আরামদায়ক’ সম্পর্ক উপভোগ করেছিল, তা এখন যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সবচেয়ে ভালো যেটা হতে পারে, ভারত বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে—এই আশায় যে তারা যাতে দেশে কিছুটা প্রভাব বজায় রাখতে পারে। তবে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ঐতিহাসিকভাবে নয়াদিল্লিকে যেভাবে দেখেছে, তা বিবেচনায় নিলে এটি কোনো সহজ কাজ হবে না।
দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যৎ সরকার চীনের দিকে ঝুঁকলে ভারত বিশেষভাবে সতর্ক থাকবে। ভারত-চীন প্রতিযোগিতার একটি ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশে চীনের ভূমিকা নিয়ে ভারতের উদ্বেগগুলো বোধগম্য।
সাবমেরিন, ফাইটার জেটসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম অর্জনের জন্য বাংলাদেশ-চীনের সম্পর্ক ক্রমবর্ধমানভাবে উষ্ণতা পাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। নয়াদিল্লির দুর্ভাবনা আরও বেড়েছে, যখন তারা জানতে পেরেছে, ঢাকা সম্প্রতি বেইজিংয়ের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি ইঙ্গিত করে যে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।
আরও পড়ুন
হাসিনার ব্যাপারে ভারত কী সিদ্ধান্ত নেবে
০৯ আগস্ট ২০২৪
হাসিনার ব্যাপারে ভারত কী সিদ্ধান্ত নেবে
উপরন্তু বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে স্বাক্ষর করেছে। ভারত বাংলাদেশকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে সাহায্য করতে ইচ্ছুক হলেও চীনের আর্থিক সম্পদের সঙ্গে কার্যকরভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারেনি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সম্ভবত এই প্রতিযোগিতার খোরাক জোগাবে।
এরই মধ্যে অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন। খালেদা জিয়া একজন প্রয়াত সামরিক কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে ছিলেন। তিনি ১৯১১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভারতের প্রতি বিশেষ অনুরাগ দেখাননি। তিনি বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক জোট করেছিলেন এবং তাদের সরকারে স্থান দিয়েছিলেন। নয়াদিল্লি বিএনপির পরবর্তী পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকবে। এটা বিশেষভাবে এই কারণে যে দলটি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।
চূড়ান্তভাবে ভারতের অভ্যন্তরের হিন্দু ভোটারদের কথা বিবেচনায় রেখে মোদির সরকারকে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার দিকে নিবিড়ভাবে নজর দিতে হবে। হাসিনার সরকারের পতনের পর কিছু জায়গায় সংখ্যালঘু হিন্দু এবং তাদের উপাসনালয়গুলো আক্রমণের শিকার হয়েছে।
আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে দেখা হয়। হিন্দুদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে যদিও দলটির রেকর্ড ও ভূমিকা অনুকরণীয় ছিল না। সরকার পতনের পর হাসিনার মন্ত্রিসভার একজন সাবেক সদস্য বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির কিছু সদস্য অতীতে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্দশার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ধারণা করা যায়, শিগগিরই মোদির সরকার বাংলাদেশে সংঘটিত এ ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলতে বাধ্য হবে। এমন এক সময়ে এটা করতে হবে, যখন সংসদে দলটির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। ভারতের রাজনৈতিক বিরোধীরা, যারা এই ইস্যুতে সরকারের সম্ভাব্য দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন, তাদেরও এ বিষয়ে বেশি দিন নীরব থাকার সম্ভাবনা কম।
এরই মধ্যে ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এ বিষয়ে আলোচনার জন্য সরকারকে নোটিশ দিয়েছে। সংসদীয় অধিবেশনের পরে বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কাছে বাংলাদেশে ভারতের কূটনৈতিক কৌশল সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নৈকট্য এবং দুই দেশকে আবদ্ধ করে, এমন জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বন্ধন থাকা সত্ত্বেও মোদি সরকার ঢাকায় তার পছন্দের অংশীদার হাসিনার বিরোধীদের শক্তি ও উগ্রতা অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছে। ভারত এখন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতিসহ একটি আঞ্চলিক সংকটের মুখোমুখি।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ভারত সরকারকে ঢাকায় তার প্রভাবের ব্যাপক হ্রাস রোধ করার চেষ্টা করতে হবে। বিএনপি ও দলটির কিছু ইসলামপন্থী মিত্রদের ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে চীনের প্রভাব যাতে ভারসাম্যের মধ্যে থাকে, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
***ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদসুমিত গাঙ্গুলি ফরেন পলিসির কলাম লেখক এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হুভার ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং ফেলো
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ১১, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,