তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা।
তীব্র গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতার সব রাগ-ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তু হয় পুলিশ। অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, নির্বিচারে গুলি ও হত্যার কারণে দেশের প্রায় সবগুলো থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও পুলিশ হত্যার ঘটনাও ঘটে। প্রাণ ভয়ে পালাতে থাকে পুলিশ সদস্যরা। যার ফলে পুলিশশূন্য হয়েছে সবগুলো থানা।
একযোগে সব থানা ফেলে পুলিশ সদস্যদের পালিয়ে যাবার ঘটনা অতীতে বাংলাদেশে কখনো দেখা যায়নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ ধরণের ঘটনা বিরল বলে উল্লেখ করছেন বর্তমান ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, অনেক সময় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এ ধরণের ঘটনা দেখা যায়। পুলিশের জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন সেটি এক বড় প্রশ্ন।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি থানা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সবগুলো থানা ধ্বংসস্তূপ হয়েছে আছে। এর মধ্যে ভাটারা থানায় গিয়ে দেখা গেল, অগ্নিসংযোগের কারণে চারিদিকে এখন শুধু ধ্বংসস্তূপ। থানার ডিউটি করছেন কয়েকজন আনসার সদস্য।
ভেতরে ঢুকতেই দেখা মিললো একদল ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে। তারা জানালেন, থানার বাইরে যেসব ধ্বংসস্তূপ পড়ে আছে সেগুলো পরিষ্কার করতে এসেছেন তারা। তবে পুলিশ নিয়ে কথা বলতে গেলে তাদের সবাই ব্যাপক ক্ষোভ ঝাড়লেন।
যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ রয়েছে সেটি কাটিয়ে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এটা কাটবে জনগণের সঙ্গে সংহতিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে, নরম ব্যবহারের মাধ্যমে।
ঢাকার নিউ মডেল কলেজের ছাত্র শাহজালাল পাটোয়ারি বলেন, পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গেলে ভয় পাইতাম। পুলিশ খারাপ ব্যবহার করতো। তাছাড়া ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ বর্বর আক্রমণ করেছে। যখন মন চাইছে গুলি চালাইছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ নিয়ে অবগত আছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে ‘চরম অনাস্থা’ তৈরি হয়েছে ২০১২ সালে থেকে, যখন পুলিশ ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ করা শুরু করে।
তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগ দেবার জন্য বলা হয়েছে। যতদ্রুত সম্ভব কাজে যোগ দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো যায়, তত দ্রুত পুলিশের ওপর আস্থা ফিরে আসবে।
তিনি স্বীকার করেন, পুলিশের আচরণগত সমস্যার কারণেও মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এসব কিছুর বহিঃপ্রকাশ একসঙ্গে হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি পুলিশের জন্য বেশ জটিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বৃহস্পতিবার ঢাকার কয়েকটি থানায় গিয়ে দেখা গেল, ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ করছেন সিটি কর্পোরেশনের কিছু কর্মী। এদের মধ্যে একজন রয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাজ্জাদ হোসেন।
তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা থানায় আসতে পারছেন না। সেজন্য স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ তো লাগবে। ওনারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
এদিকে পুলিশ সদস্যরা সাদা পোশাকে গিয়ে বিভিন্ন থানায় ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা করছেন। সেখানে কথা হচ্ছিল সাব-ইন্সপেক্টর আব্দুল লতিফের সাথে।
তিনি বলেন, মিরপুর অঞ্চলে যতগুলো থানা আছে সবগুলোতে গিয়ে তারা ক্ষতি নিরূপণ করছেন। বিভিন্ন থানায় পুলিশের যানবাহন কিছু অবশিষ্ট নেই। সব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সাবেক পুলিশ প্রধান নুরুল হুদা বলছেন, পুলিশের উপস্থিতি দৃশ্যমান করতে হবে। তারা বিভিন্ন স্থাপনায় গিয়ে সেগুলোর নিরাপত্তা বিধান করতে পারে। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে। তাহলে পুলিশের ওপর আস্থা রাখবে সাধারণ মানুষ।
তিনি বলেন, পুলিশ নিয়ে সার্বিকভাবে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ আছে সেগুলো নিরসনের জন্য পুলিশের সংস্কার করা জরুরী। এই সংস্কার খুব দ্রুততার সাথে করা সম্ভব হবে না।
হুদা মনে করেন, পুলিশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায় আছে। কারণ বহু বছর ধরে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
এদিকে, পুলিশ কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যাচ্ছে, পুলিশের মধ্যে একটি বড় ধরণের পরিবর্তন বেশ অবশ্যম্ভাবী।
পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সবগুলো থানার ওসি এবং প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপারদের বিষয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বিক্ষোভের সময় যেসব জায়গায় পুলিশ বেশি শক্তি প্রয়োগ করেছে সেখানে পরিবর্তন আসবে সবার আগে। এছাড়া বাকিসব পরিবর্তন ধাপে ধাপে করা হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
তিনি মনে করেন, যেসব পুলিশ কর্মকর্তা পুলিশকে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং অতীতে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তি না দিলে পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরানো কঠিন হবে। কিন্ত এসব কাজ একযোগে করা সম্ভব নয়।
পুলিশ সদস্যদের যত দাবি
দেশের থানার ওসি ও এসআইদের নিয়ে গঠিত পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন বলছে, পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা ফেরাতে কিছু কাজ অবশ্যই করতে হবে। বুধবার ঢাকায় তাদের এক সভায় কিছু দাবিও তুলে ধরা হয়।
ওই সভায় পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর মো. জাহিদুল ইসলাম বলেছেন, পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খেয়ালখুশি মতো নির্দেশ দানের কারণেই পুলিশের এই দশা হয়েছে।
তিনি আরও বলেছেন, আমরা এমন নেতৃত্ব চাই, যে নেতৃত্ব জনগণের কথা ভেবে আমাদের কমান্ড করবে, জনগণের মঙ্গলের জন্য আমাদের কাজ করাবে। কোনো রাজনৈতিক দলের দালালি করে জনগণের মুখোমুখি করে দেবে না।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, ছাত্র-জনতা যে রকম পুলিশ অফিসার চাচ্ছে, সে রকম পুলিশ অফিসার আমাদের ডিপার্টমেন্টে আছে। কিন্তু তারা ফ্রন্টে আসতে পারে না। তাদেরকে খুঁজে বের করে, তাদেরকে দায়িত্ব দিয়ে যাতে বাংলাদেশ পুলিশ পরিচালনা করা হয়।”
পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সভায় যেসব দাবি তুলে ধরা হয় সেগুলো হচ্ছে –
১. পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত হতে হবে।
২. সব পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যেসব “সিনিয়র অফিসাররা ক্ষমতা লোভী ও দালাল পুলিশ অফিসারদের কারণে আমাদের পুলিশ সদস্য ও সাধারণ ছাত্র-জনতা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদেরকে গ্রেফতার করে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বিচার করতে হবে।
৩. তাদের সব অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে বাংলাদেশ পুলিশের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে।
৪. সহিংসতায় নিহত ও আহত পুলিশ সদস্যদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৫. যেসব পুলিশ সদস্য জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
৬. বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী পুলিশ সদস্যদের জন্য আট ঘণ্টা ডিউটির ব্যবস্থা করতে হবে। অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য ওভারটাইম পেমেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. পুলিশের পোশাকের রং পরিবর্তন করে কনস্টেবল থেকে আইজিপি পর্যন্ত একই ড্রেস কোড হতে হবে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা
সূত্র: যুগান্তর।
তারিখ: আগষ্ট ০৯+, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,