বাংলাদেশের ঘটনাবলি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা ও অপেক্ষার নীতি গ্রহণ ছাড়া এই মুহূর্তে ভারতের তেমন কিছুই করার নেই বলে মনে করছেন দেশটির সাবেক কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষকেরা। তাঁদের মতে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনো ঘোলাটে, জটিল ও দ্রুত পরিবর্তনশীল। ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। এই অবস্থায় ভারতের উচিত ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ (অপেক্ষা করা ও দেখা) নীতির পাশাপাশি সে দেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হওয়া। ভারতের নজরও সেদিকে।
এসবের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত ভারতীয় কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষকেরা। মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বিবৃতিতেও এ নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। ভারতীয় পর্যবেক্ষকেরা অবশ্য লক্ষ করেছেন, এই আইনহীনতা ও ডামাডোলের মধ্যে ছাত্রসমাজ, জামায়াতের আমির ও বিএনপির নেতারা সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের প্রকাশ্যে নিন্দা করেছেন। বলেছেন, এ থেকে সবার বিরত থাকা উচিত। পর্যবেক্ষকদের মতে এটা সুলক্ষণ।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক কূটনীতিক দেব মুখোপাধ্যায় মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয় ঘটনাবলি যে এত দ্রুত এমন হয়ে যাবে, তা ভারত ধারণা করতে পারেনি। কিন্তু এখন অপেক্ষা করা ছাড়া দ্বিতীয় উপায় নেই।’ তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের মধ্যে অনেক ধরনের মানুষ আছেন। তাঁদের কারা কীভাবে এগোবেন অজানা। এই অবস্থায় আগ বাড়িয়ে কিছু করা একেবারেই সমীচীন নয়। এটা মানতে হবে, বাংলাদেশে এ এক নতুন পরিস্থিতি।’
অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণের নীতিতে আর এক সাবেক হাইকমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী একমত হলেও তিনি মনে করেন, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা ভারতের আছে। মঙ্গলবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৭ সালে আমি তখন ওই দেশে (বাংলাদেশে)। তখনো পরিস্থিতি জটিল ছিল। সেটা ওয়ান-ইলেভেনের সময়। ভারত সেই পরিস্থিতি সামলে উঠেছিল। এমনই পরিস্থিতির মোকাবিলা ভারত করেছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কাতেও। কাজেই এই পরিস্থিতি অপ্রত্যাশিত হলেও ভারতের দিক থেকে একে আমি বিপর্যয় বলতে রাজি নই।’
পিনাকরঞ্জনকে অবাক করেছে ঘটনাবলি মোকাবিলা। সরকার কী করে এত ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিল, মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি টের পেল না, মানুষ যে পুরোপুরি বিরুদ্ধে চলে গেছে, তা বুঝতে পারল না, সেটা তিনি এখনো ভেবে চলেছেন। তাঁর কাছে প্রথম বিস্ময় ‘রাজাকার’ মন্তব্য। দ্বিতীয় বিস্ময় ছাত্রদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেওয়া। তৃতীয় বিস্ময় ছাত্রদের ওপর পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া। পিনাকরঞ্জন মনে করেন, এখান থেকেই আন্দোলনটা ছিনতাই হয়ে যায়। এখন তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন পেছনের শক্তি কারা। কাদের কতটা লাভ।
পিনাকরঞ্জনের সঙ্গে সহমত মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের (আইডিএসএ) গবেষক ও বাংলাদেশ পর্যবেক্ষক স্মৃতি পট্টনায়ক। শেখ হাসিনার মতো আন্দোলন করা একজন নেত্রী ও টানা ১৫ বছরের বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী মাঠের বাস্তবতা বুঝতে এমন ব্যর্থ কেন, সেটা তাঁর ধারণাতীত। প্রথম আলোর কাছে বিস্ময় প্রকাশ করে স্মৃতি বলেন, ‘সামাজিক মাধ্যমগুলো তাঁর সমালোচনায় ভরে রয়েছে, এটা কী করে চোখ এড়ায়? ১৭ এপ্রিল ছাত্রদের হাত থেকে আন্দোলনের রাশ অন্যত্র চলে গেছে সেই আন্দাজও তিনি পেলেন না? এত মানুষকে মেরে ফেলা হলো কোন যুক্তিতে? কী হিসাব করে এসব তিনি করালেন? তাঁর মতো একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিকের কাছে থেকে এটা আশা করা যায় না।’
যা হওয়ার তা হয়ে যাওয়ার পর এখন পরিস্থিতি যা, ভারতের কাছে তা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ বলে এই তিনজনই মনে করেন। তবে তাঁরা কেউই মনে করেন না এটা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা। দেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ভারত ব্লান্ডার করেছে সে কথা মোটেও বলব না। অনেকে বলবে, ভারত সব ডিম এক ঝুড়িতে রেখেছিল। এটা ভুল। আমি তাদের বলব, ২০০১ সালে ভারত বিএনপির দিকে হাত বাড়িয়েছিল। কিন্তু তারা তা ধরেনি। বরং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গোলমাল বাধিয়েছিল। আওয়ামী লীগের কাছাকাছি ভারত গেছে। তারাও কাছে এসেছে। কনভারজেন্স অব ইন্টারেস্ট।’
পিনাকরঞ্জনের মতে, ‘ব্যর্থতা বলা ঠিক নয়। কূটনীতিতে কোনোটা খাটে কোনোটা খাটে না। আওয়ামী লীগ ছাড়া কাল্টিভেট করার মতো ভারতের সামনে এতকাল কেউ ছিল না। এখন নতুন শক্তির সঙ্গে মিশতে হবে। নতুন চ্যালেঞ্জ। ভারত সব সময় ক্ষমতায় যারা থাকে তার সঙ্গে কাজ করে। এ ক্ষেত্রেও তাই করবে। সহযোগিতা কমবেশি হবে। পরিস্থিতির বিচারে ব্যবস্থা নেওয়াই শাসকের ধর্ম।’
পারস্পরিক সহযোগিতা এই মুহূর্তে দূর অস্ত মনে হলেও ভবিষ্যতে তা ফলদায়ী হতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশের আরও এক নিবিড় পর্যবেক্ষক অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ১৫ বছরের একটা ধারাবাহিকতায় চিরতরে ছেদ পড়ল বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সরকারকে সব সময় সরকারের সঙ্গে কাজ করতে হয়। এটা বুঝতে হবে, আমরা কাকে চাইছি সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা দেশ কাকে চাইছে। এই ১৫ বছরের অনেকটা সময় বোঝা যায়নি বাংলাদেশের জনতা কাকে চাইছেন। সেই বাস্তবতার মুখোমুখি ভারতকে আজ হতে হবে।’
অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত আরও বলেন, ‘১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ভোট তো ভালোই হয়েছিল। পরের তিনটে নির্বাচনে হয়নি। প্রকৃত গণতন্ত্র আবার ও দেশে ফিরতে পারে। এই আন্দোলনের পর সে বিষয়ে আমার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে।’
বিশ্বাস দৃঢ় হওয়ার কারণ বাংলাদেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছাত্রসমাজ। অধ্যাপক শ্রীরাধার মতে, ‘ছাত্রদের উপেক্ষা করা এখন কঠিন। এই ছাত্রসমাজ মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেবে না বলে আমি বিশ্বাস করি। প্রাথমিক কিছু জড়তা থাকলেও ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে কাজ করতে তাদের অনাগ্রহ থাকবে না। কারণ, ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবসমাজকেও তারা কাছ থেকে দেখছে।’
শ্রীরাধা জোরের সঙ্গেই বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় মৌলবাদের সমর্থক নন। কখনো ছিলেনও না। সেই কারণে জামায়াত কখনো ৫ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম ১৯৯৬ সাল। তা-ও সেবার তাদের প্রাপ্য ভোট ছিল সাড়ে ৮ শতাংশ! আর ২০১৮-এ তা নেমে যায় ১ শতাংশেরও নিচে।’
সাবেক হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলি চিন্তিত বাংলাদেশে অরাজকতা নিয়ে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এই অরাজকতাই সবচেয়ে চিন্তার। ছাত্রসমাজ আবেদন জানাচ্ছে। আরও অনেকেই এই লুটপাট, উৎপাত, ফ্রি ফর অল, যা ইচ্ছে তাই করার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে কই? দেশটা তো সবার। প্রত্যেকের বোঝা উচিত এতে দেশেরই ক্ষতি হচ্ছে।’
রীভা গাঙ্গুলি বলেন, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের সব শ্রেণি ও সব ধরনের মানুষেরই একে অন্যকে প্রয়োজন। প্রয়োজনের এই দরজাটা যাতে খোলা থাকে, তা দুই দেশের জনগণকেই নিশ্চিত করতে হবে।
একটা করার প্রথম ধাপ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন। সেই সরকারের প্রধান হিসেবে উঠে এসেছে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম। তিনি নিজেও সম্মত হয়েছেন বলে খবর।
অধ্যাপক শ্রীরাধা মনে করেন, ‘এই পরিস্থিতিতে উনি (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) রাজি হলে ও সবাই মেনে নিলে মন্দ হবে না। ইউনূস সাহেব অভিজ্ঞ। দেশটাকে জানেন। তবে রাজনৈতিক দিক থেকে কতটা প্রাজ্ঞ, তা পরীক্ষিত নয়।’
রীভা গাঙ্গুলি ধারণা, ‘ছাত্ররা ভরসা করলে ইউনূস সাহেব তাঁর মর্যাদা রাখতে পারেন। তবে তাঁরও প্রথম কাজ হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা।’ দেব মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ‘বিষয়টি ইতিবাচক হবে। ইউনূস ভারতকে জানেন। ভারতও তাঁকে জানে। যদিও প্রাথমিক ঝড় সামলানোই হবে তাঁর বড় কাজ।’
পিনাকরঞ্জন ও স্মৃতি অবশ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে কিছুটা সন্দিহান। পিনাকরঞ্জন মনে করিয়ে দেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের সময় ইউনূস রাজনৈতিক দল খুলেছিলেন। পরে নানা কারণে দল গুটিয়ে নেন ও নিজে গুটিয়ে যান। সেই কারণে এবার ওঁর প্রস্তাব গ্রহণ করাটা আমাকে অবাক করেছে। তবে হ্যাঁ, ইউনূস সাহেব অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হলে আমেরিকা খুশি হবে।’
স্মৃতির প্রশ্ন, ‘ছাত্ররা যা চাইবে সেটাই হবে কি? তাদের চাওয়া না-চাওয়া, পছন্দ–অপছন্দই কি শেষ কথা? সন্দেহ আছে। ইউনূস সাহেবকে সবাই মেনে নেয় কি না, দেখা যাক। তবে যিনিই দায়িত্বে আসুন, ভারতের একটাই চাহিদা, দেশটা স্থিতিশীল হোক। বাকি সব পরে।’
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ০৭, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,