এবার ভারতের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি বিপুল বিজয়ের প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু ৪ জুন ফলাফল ঘোষণার পর দেখা যায়, এনডিএ জোট সরকার গঠন করার মতো প্রয়োজনীয় আসন পেলেও বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে ব্যর্থ হয়েছে। অপর দিকে এক্সিট পোল এবং সংবাদমাধ্যমগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া’ জোট আশাতীত ভালো ফল করেছে। ভারতের রাজনীতি ও নির্বাচনে প্রায় ‘অজেয়’ হয়ে ওঠা মোদির জন্য এটা একটা বড় আঘাত হলেও অনেকেই এ ঘটনাকে ‘ভারতীয় গণতন্ত্রের জয়’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। নির্বাচনের ফলাফল এবং ভারতের রাজনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে লিখেছেন শশী থারুর।
—————————–
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নিরঙ্কুশ জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না বলে যে পণ্ডিত আর নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, আদতে তাঁদেরই সবচেয়ে বড় হার হয়েছে।
এসব ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবতা থেকে এতটাই দূরে ছিল যে ফল ঘোষণার পর ভারতের একজন শীর্ষস্থানীয় নির্বাচনবিশেষজ্ঞ দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় ইংরেজি ভাষাভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।
হ্যাঁ, এটি ঠিক যে মোদির বিজেপি আবার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু তার পরও তাদের এবারের জয়কে হারের চেয়েও বেশি গ্লানিময় বলে মনে হচ্ছে।
গতবার লোকসভায় বিজেপির আসন ছিল ৩০৩টি। নির্বাচনের আগে মোদি ও তাঁর প্রধান সেনাপতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এবার বিজেপির আসনসংখ্যা ৩০৩ থেকে একলাফে ৩৭০ পেরিয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেল, বিজেপি গতবারের চেয়ে ৬৩টি আসন কম পেয়েছে।
একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যেখানে ২৭২টি আসনের দরকার, সেখানে বিজেপি পেয়েছে মাত্র ২৪০ আসন।
বিজেপিকে ক্ষমতায় থাকতে তার এনডিএ জোটের এমন কিছু আঞ্চলিক দলের মন জুগিয়ে চলতে হবে, যাদের সঙ্গে বিজেপির আদর্শিক বনিবনা একেবারেই কম। যেকোনো নতুন আইন পাস করতে হলে এখন বিজেপিকে এই শরিক দলগুলোর দ্বারস্থ হতে হবে।
এরপর এই নির্বাচনে যাঁর সবচেয়ে বড় হার হয়েছে, তিনি হলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
আমাদের ভাগ্য ভালো, এই প্রবণতা এখন বিপরীতমুখী হতে শুরু করেছে। ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’, বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অমর বাণীকে ধারণ করে বিরোধী রাজনীতিকেরা ভারতের শতাব্দী প্রাচীন বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি পুনরুদ্ধারে লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রয়েছে।
মোদি নির্বাচনী প্রচারণায় নিজের দল বিজেপিকে সামনে না এনে লাগাতারভাবে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। বছরের পর বছর তিনি আত্মপ্রচারের মোহে ডুবেছিলেন। এ ব্যাপারে বলা যায়, তাঁর কোনো ধরনের সংকোচ বা লজ্জা–শরমের বালাই ছিল না।
কোভিড-১৯–এর টিকার সনদে টিকা নেওয়া ব্যক্তির ছবি থাকা সংগত ও স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সে জায়গায় মোদি নিজের ছবি ছেপেছেন।
৮০ কোটি ভারতের নাগরিককে ত্রাণ হিসেবে যে চাল-আটা দেওয়া হয়েছিল, সেই চাল-আটার বস্তায় পর্যন্ত তিনি নিজের ছবি ছেপেছেন।
■ এই নির্বাচনে যাঁর সবচেয়ে বড় হার হয়েছে, তিনি হলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
■ মোদির মহিমা-লালসা এতটাই স্ফীত হয়েছিল যে তা তাঁকে দেবত্ব দাবির কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল।
■ এবারের ভোটের একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো, বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী মতবাদ ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
■ বিরোধী রাজনীতিকেরা ভারতের শতাব্দী প্রাচীন বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি পুনরুদ্ধারে লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রয়েছে।
ভারতবর্ষের প্রায় সব বড় রেলস্টেশনে ‘সেলফি পয়েন্ট’ খোলা হয়েছে। সেখানে প্রমাণ সাইজের মোদির ছবি দিয়ে বানানো কাটআউট রাখা হয়েছে, যাতে সেই কাটআউটের পাশে দাঁড়িয়ে যাত্রীরা সেলফি তুলতে পারেন।
মোদির মহিমা-লালসা এতটাই স্ফীত হয়েছিল যে তা তাঁকে দেবত্ব দাবির কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল।
নির্বাচনী প্রচারণাকালে প্রধানমন্ত্রী মোদি একজন সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বলেছিলেন, জৈবিকভাবে তিনি জন্মগ্রহণ করলেও, তিনি নিশ্চিত, তিনি আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো নন; ভারতের সেবা করার জন্য পরমেশ্বর সরাসরি তাঁকে মনোনীত করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।
আরও পড়ুন
যেসব কারণে মোদির জনপ্রিয়তা ধাক্কা খেল
যেসব কারণে মোদির জনপ্রিয়তা ধাক্কা খেল
কেউ কেউ মোদির ওই মন্তব্যকে আপত্তিকর বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ জনগণ এটিকে খারাপভাবে নিয়েছে বলে মনে হয়নি। কারণ, নির্বাচনের আগে চালানো এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, ৭৫ শতাংশ লোক মোদির এই কথাকে অনুমোদন দিয়েছে।
মোদির এসব কৌশল এত দিন ভালোই কাজে দিচ্ছিল। কিন্তু এখন তিনি তাঁর নিজের কৌশলের নেতিবাচক প্রভাবের জালে নিজেই ফেঁসে গেছেন।
এই যে পার্লামেন্টে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে বিজেপি ব্যর্থ হলো, সেই ব্যর্থতা মোদির সুনামকে শুধু যে ভারতীয় ভোটারদের চোখেই ক্ষুণ্ন করেছে, তা নয়। যে ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও প্রভাবের জোরে তিনি দীর্ঘদিন ধরে দলের মধ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য খাটিয়ে গেছেন, সেই প্রভাবকেও আজকের নির্বাচনী ব্যর্থতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
মোদি তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতাচর্চার অংশ হিসেবে মন্ত্রিসভার সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা না করেই ২০১৬ সালে নোট বাতিলের এবং ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর এই দুটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের কারণে জনজীবনে কঠিন বিপর্যয় নেমে এসেছিল। কিন্তু কোনো সমালোচনাই তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি। এ বিষয়ে দলের ভেতরের ও দলের বাইরের কোনো সমালোচনাকে তিনি পাত্তা দেননি।
তবে সেই অবস্থা এখন বদলাতে শুরু করেছে। কারণ, বিজেপির শীর্ষ নেতারা এবং সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য শরিক দলগুলোর নেতারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ় অবস্থান নেবেন। এটি মোদির ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী প্রবণতার লাগাম টেনে ধরতে পারে।
আসলে বিজেপির জয়কে যেভাবে পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে, অনেকটা সেভাবেই পুনরায় জেগে ওঠা বিরোধীদের পরাজয়কে অনেকের কাছে জয়ের মতো ঠেকছে।
এ অবস্থায় বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টি (আমি যে দলের একজন সদস্য) এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বে গঠিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (ইন্ডিয়া) নামের জোটের শরিকদের উদ্যাপন করার মতো অনেক কিছু আছে।
গত পার্লামেন্টে কংগ্রেস পার্টির মোট আসন ছিল ৫২টি। দলটি সেই সংখ্যাকে প্রায় দ্বিগুণ করে ৯৯-তে উন্নীত করেছে।
ইন্ডিয়া জোটের অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলোও গতবারের চেয়ে অনেক ভালো করেছে। যেমন উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী (সমাজতান্ত্রিক) পার্টি ৩৭টি আসন পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২৯টি আসন।
আরও পড়ুন
ভারতের ভোটাররা অবশেষে জেগে উঠছেন
ভারতের ভোটাররা অবশেষে জেগে উঠছেন
২৩২টি আসনের মালিক ইন্ডিয়া জোট পার্লামেন্টে এখন একটি ক্ষমতাধর শক্তি। এখন যে কেউ নিশ্চিত হতে পারবেন, লোকসভা এখন থেকে আর নিছক মোদির এজেন্ডা বাস্তবায়নের রাবার স্ট্যাম্প হিসেবে কাজ করবে না।
এবারের ভোটের একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো, বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী মতবাদ ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
এবার বিজেপি তার নির্বাচনী এলাকায় এমন অনেক ‘নিরাপদ’ আসন হারিয়েছে, যেখানে মোদির প্রচারণার বক্তব্য ছিল সবচেয়ে হিন্দুকেন্দ্রিক ও উসকানিমূলক। এসব আসনের মধ্যে অযোধ্যাও রয়েছে, যেখানে গত জানুয়ারিতে তিনি একটি জমকালো নতুন মন্দিরের
উদ্বোধন করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে ২০১৯ সালে যে রাজ্যগুলোতে বিজেপি বিরোধী জোটকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, সেই রাজ্যগুলোসহ উত্তর ভারতের ‘হিন্দুত্ববাদের প্রাণকেন্দ্রে’ এবার বিরোধীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র এখন নানা রঙে সেজে একেবারে বর্ণিল হয়ে উঠেছে।
নিঃসন্দেহে এই নির্বাচনে সবচেয়ে বড় জয় পেয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্র, যা কিনা মোদির ক্ষমতায় থাকার পুরোটা সময় ক্রমবর্ধমানভাবে চাপের মধ্যে রয়েছে। ভারতের গণতন্ত্র যে একের পর এক আঘাতের শিকার হয়েছে, বৈশ্বিক সূচকে তার প্রতিফলন দেখা গেছে।
ফ্রিডম হাউস এখন ভারতকে ‘মুক্ত’ থেকে ‘আংশিকভাবে মুক্ত’ দেশের ক্যাটাগরিতে নামিয়ে দিয়েছে। ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্রেসি (ভি-ডেম) ইনস্টিটিউট ভারতকে আবারও ‘নির্বাচনী স্বৈরাচার’-এর কাতারে ফেলেছে।
বিজেপির অধীনে থাকা ভারত এখন বিশ্বজুড়ে ‘গণতান্ত্রিক অসংহতির’ একটি বড় উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
একইভাবে ভারত এখন বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে ১১১তম এবং ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫৯তম স্থানে রয়েছে।
জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গুজরাটে ২০০২ সালে মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে সেখানকার মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় তাঁর কী ভূমিকা ছিল, তা নিয়ে বিবিসির বানানো প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ভারতে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য সরকার প্রশ্ন তুলেছে।
অন্যরাও এসব বিষয় নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আরও বিস্তৃতভাবে সতর্কতা জারি করেছে।
বিজেপি সরকার কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃত্যুর যে অবাস্তব পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিল, সেটিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভালোভাবে নেয়নি। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের মানবসম্পদ সূচককে ভারত খারিজ করায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ভারতের নিন্দা করেছে।
আমাদের ভাগ্য ভালো, এই প্রবণতা এখন বিপরীতমুখী হতে শুরু করেছে। ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’, বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অমর বাণীকে ধারণ করে বিরোধী রাজনীতিকেরা ভারতের শতাব্দী প্রাচীন বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি পুনরুদ্ধারে লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রয়েছে।
আমি গত মাসে একটি লেখায় লিখেছিলাম, ভারতের ‘বাতাসে পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।’
এখন দেখা যাচ্ছে, সত্যিই এখন পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে এবং সেই হাওয়ায় এখন থেকে বেশির ভাগ ভারতীয় আগের চেয়ে বেশি স্বাধীনভাবে শ্বাস নিতে পারবে।
● স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস পার্টির পার্লামেন্ট সদস্য, যিনি টানা চতুর্থ মেয়াদে লোকসভায় পুননির্বাচিত হয়েছেন। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ: জুন ০৯, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,