লেখক:শওকত হোসেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘কলস যত বড়ই হউক না, সামান্য ফুটা হইলেই তাহার দ্বারা আর কোনো কাজ পাওয়া যায় না। তখন যাহা তোমাকে ভাসাইয়া রাখে তাহাই তোমাকে ডুবায়।’ দেশের অর্থনীতিকে একটি কলসির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে ফুটো একটা নয়, অসংখ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম মূল্যস্ফীতি। প্রায় দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। আক্ষরিক অর্থেই বাজারদরের চাপে গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে সাধারণ মানুষ, নাকটা সামান্য একটু উঁচিয়ে কোনোরকমে টিকে আছে তারা
নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গতকাল (জুন ০৬) বৃহস্পতিবার যে বাজেট দিলেন, তাতে নতুন অর্থবছরে অনেক আশার কথা শুনিয়েছেন। বলেছেন, মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। যদিও স্বীকার করে নিয়েছেন, বিগত দুটি বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেও তা অনমনীয়ভাবে ৯ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে। এ জন্য নতুন অর্থবছরে আগে নেওয়া দুই নীতিই অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। যেমন বাজেট–ঘাটতি কমানো এবং কৃচ্ছ্রসাধন। এই দুই পথে এবারও মূল্যস্ফীতি কমবে—এই ভরসা অর্থমন্ত্রী বাজেটে দিয়েছেন। তবে তা কাজে দেবে, এটা বলা যাবে না। বরং বাজেটে বিনিয়োগ কমানোর কথা আছে। আর আছে অনেক অনুমান আর ‘যদি’র ওপর ভরসা। ফলে এই বাজেট অনেকটাই এখন ইচ্ছাতালিকার বাজেট।
বাড়বে করের বোঝা
বরং মানুষের ওপর করের চাপ আরও বাড়বে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে কর-জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাত বাড়াতেই হবে। এ জন্য অর্থমন্ত্রী বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়ানোর সুযোগটি দুই হাত ভরে নিয়েছেন। তবে নতুন কোনো সংস্কার করে নয়, যাঁরা কর ফাঁকি দেন, তাঁদের ওপর চাপ বাড়িয়ে নয়, বরং যাঁরা নিয়মিত কর দেন, তাঁদের কাছ থেকেই বাড়তি কর আদায়ের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটে মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) দিকেই অর্থমন্ত্রী গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। ভ্যাটের মতো পরোক্ষ কর মানে এর বোঝা সাধারণ মানুষের ওপরই পড়বে। অথচ আয়করে কোনো ছাড় পাননি তাঁরা। ধান, চাল, গম, আটা, ময়দাসহ নিত্যপণের ওপর উৎসে কর ২ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করার কারণে খানিকটা স্বস্তি হয়তো আসবে, যদি বাজারের ওপর সরকারের নজরদারি থাকে; যা গত দুই বছর ছিল না।
আবারও কালোটাকা সাদা
তবে যাঁরা কর দেন না, সেই কালোটাকার মালিকদের কিন্তু অর্থমন্ত্রী দুই হাত ভরে দিয়েছেন। বৈধ আয় হলে কর দিতে হবে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ, আয় অবৈধ হলে তা কমে আসবে ১৫ শতাংশে। দেশে সর্বোচ্চ কালোটাকা সাদা হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছরে—প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। তখন বিশ্বজুড়ে ছিল কোভিড অতিমারি। অর্থ পাচারের জায়গা ছিল না। সুতরাং বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া কালোটাকা সাদা হয় না—এটা জেনেও অর্থমন্ত্রীরা কেন কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেন, সেই রহস্য ২০০৯ সালেই ফাঁস করেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘পলিটিকস ইজ হাইয়েস্ট আর্ট অব কম্প্রোমাইজ। রাজনীতিতে সব ধরনের মানুষ ও সব ধরনের স্বার্থকে সমন্বয় করে চলতে হয়।’ মাত্রই একটি একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। সুতরাং রাজনীতিতে আপস করার কথাই আবার মনে করিয়ে দিলেন নতুন অর্থমন্ত্রী।
শঙ্কা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নিয়ে
একদিকে করের বোঝা, অন্যদিকে বিলের বোঝা। এই বিল বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি তেলের। আইএমএফের চাপে এসব পণ্যের দর বাড়িয়েই চলেছে সরকার। এবারের বাজেটে মুঠোফোনে কথা বলার বিল বাড়ানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এমনকি বাড়বে মেট্রোরেলের ভাড়াও। ফলে চাপে থাকবে মানুষ। চাপ থেকে বের হওয়ার পথ একটাই—আয় বৃদ্ধি। এ জন্য চাই বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। যদিও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এবার তিনি কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি নিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি সংকোচনমূলক নীতি গ্রহণ করছেন। লক্ষ্য, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। যদিও অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে দীর্ঘ মেয়াদে এর ফলে প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যেতে পারে। তবে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আগামী অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে সরকারি ব্যয় ধীরে ধীরে বাড়ানো হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য একটি ‘যদি’ আছে। তিনি বলেছেন, এটি সম্ভবপর হবে, যদি রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়।
বাজেটের আকারে সংযত অর্থমন্ত্রী
আইএমএফই বলে দিয়েছিল বাজেটের আকার খুব বেশি না বাড়াতে। অর্থমন্ত্রী কথা শুনেছেন। নতুন অর্থবছরের জন্য তিনি ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে আয়ের প্রাক্কলন হচ্ছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এতে সামগ্রিক ঘাটতি হবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় ঘাটতি ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাজেট–ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রী বৈদেশিক উৎস থেকে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ পাবেন বলে আশা করছেন। বাকি ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিতে হবে সরকারকে। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রির মতো ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে বাকি ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে মূলত ব্যাংকব্যবস্থার ওপর ভর করেই বাজেট–ঘাটতি মেটাবেন অর্থমন্ত্রী। এই খাত থেকে সরকারই এ পরিমাণ অর্থ নিলে বেসরকারি খাতে ভাগ কমে যাবে। তাতে ব্যাহত হবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ: জুন ০৭, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,