ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ার চাপে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুদের পেছনেই সরকারের প্রায় ২৭ শতাংশ খরচ বাড়তে পারে। অর্থাৎ সুদ মেটাতেই ব্যয় হতে পারে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এদিকে মূলস্ফীতির চাপ থেকে দরিদ্র মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা ও ভাতার হার বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
এসব খরচ অন্তর্ভুক্ত করে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রায় ৭ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের খসড়া প্রস্তুত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়, যা আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১৫ শতাংশ। আজ বুধবার সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী অর্থবছরের জন্য আয়-ব্যয়ের এ খসড়া পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে পারেন।
বৈঠকে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে মূলস্ফীতি, ভর্তুকি এবং দেশি-বিদেশি ঋণে বাড়তি সুদ পরিশোধকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাধ্য হয়েই এসব খাতে বারাদ্দ বাড়ানোর কারণে বাজেটে নতুন চমক রাখার সুযোগ কম। তাই আগামী ১ জুন জাতীয় সংসদে অনেকটা গতানুগতিক বাজেট প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতার দেওয়ার বিষয়ে আলোচনার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত এলে সেটাই হবে অন্যতম চমক।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কয়েকটি মেগা প্রকল্পে নেওয়া বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ শুরু হওয়ার পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, লাইবর রেট অত্যধিক বেড়ে যাওয়া, ইউএস ট্রেজারির সুদহার বাড়ার কারণে আগামী অর্থবছর বিদেশি ঋণ ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হতে পারে ২৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া দেশের বাজারে ট্রেজারি বন্ডের সুদহার বাড়ার সঙ্গে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী আগামী জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণের সুদের ঊর্ধ্বসীমা প্রত্যাহার করা হলে সরকারের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধেও ব্যয় বাড়বে। তাই এ খাতে ৭৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রাক্কলন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী বাজেটে সুদ বাবদ ব্যয় প্রায় ২৭ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। এটি আগামী বাজেটের প্রাক্কলিত জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। চলতি বাজেটে জিডিপির ১ দশমিক ৮০ শতাংশ ধরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা।
সামাজিক সুরক্ষায় থাকছে ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা থাকবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে বিষয়ে কাজ করছে। তবে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়িয়ে দরিদ্র মানুষদের সহযোগিতা করে সরকার। এর অংশ হিসেবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুন করে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় এক দশক পর আগামী অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার পরিমাণও কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে চলতি বাজেটের চেয়ে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে নতুন বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা রাখা হয়। তবে প্রয়োজনের তাগিদে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা করা হয়। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এসব খাতে মোট বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের বকেয়া ভর্তুকির দায় মেটাতে নতুন অর্থবছরের বরাদ্দের একটি অংশ ব্যয় হবে। তবে চলতি অর্থবছরের বকেয়া বাদ দিলে আগামী অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ কম হবে।
৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা
আগামী অর্থবছরে এনবিআর, এনবিআরবহির্ভূত এবং করবহির্ভূত রাজস্ব থেকে মোট ৫ লাখ কোটি টাকা আয় করতে চায় সরকার। এই অর্থবছরে যা ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগামী বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে প্রায় ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে যা ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এনবিআরের রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া এনবিআরবহির্ভূত করের মাধ্যমে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং করবহির্ভূত রাজস্ব খাত থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা আশা করছে সরকার। চলতি বাজেটে এ দুই খাতে যথাক্রমে ১৮ হাজার কোটি ও ৪৫ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়।
বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা
আগামী বাজেটে ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় এবং বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে এ ঘাটতি মেটানোর পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় ৯৭ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন অনুদান এবং বাজেট সহায়তা বাবদ ১২ হাজার কোটি টাকা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকছে ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩০ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নেবে সরকার।
এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমছে, শিক্ষায় তেমন বাড়ছে না
সুদ ও ভর্তুকিতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এডিপিতে বরাদ্দ খুব বেশি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। চলতি বাজেটের চেয়ে এ খাতে বরাদ্দ প্রায় ৭ শতাংশ বাড়িয়ে আগামী বাজেটে মোট ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকার এডিপি নেওয়া হচ্ছে। চলতি এডিপির আকার ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি টাকা।
এডিপির খসড়ায় দেখা গেছে, আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলোর জন্য সব মিলিয়ে ১৬ হাজার ২০৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ১৯ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ কমছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে শিক্ষা খাতে ৮০০ কোটি টাকার মতো বরাদ্দ বাড়ছে। এ খাতে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে ২৯ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
সূত্র:সমকাল।
তারিখ: মে ১০,২০২৩
রেটিং করুনঃ ,