গত দুটি নির্বাচনের মতো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে দেশের গণতন্ত্র হুমকিতে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, সামনের নির্বাচনের ওপর দেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নির্ভর করছে। বড় দুটি দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন করার জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন এবং সে বিষয়ে সমাধানের পথ বের করতে হবে।
আজ মঙ্গলবার সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) উদ্যোগে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন, সাংবিধানিক কাঠামো ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে।
বৈঠকে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তাতে তিনি বলেন, নির্বাচন এক দিনের বিষয় নয়, এটি একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হওয়ার জন্য সব দলের অংশগ্রহণ প্রাথমিক শর্ত হলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, অংশগ্রহণমূলক হলে অনেক সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয় না।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এ প্রসঙ্গে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০১১ সালের মে মাসে আদালত পরবর্তী দুই নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রেখেই তা সংস্কারের পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন। তবে আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রকাশের দেড় মাস পর ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়।
অনেক কারণে পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের প্রক্রিয়া এবং এর সাংবিধানিক বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ মন্তব্য করে সুজন সম্পাদক বলেন, গণভোটের বিধান থাকলেও পঞ্চদশ সংশোধনীর ক্ষেত্রে গণভোটের আয়োজন করা হয়নি। সংবিধান সংশোধনের গ্রহণযোগ্যতার জন্য আলোচনা–বিতর্কের প্রয়োজন হয়। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর ক্ষেত্রে বাস্তবিক অর্থে তা হয়নি। এ ছাড়া সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছিল, সেখানে তাঁদের দেওয়া মতামত উপেক্ষা করা হয়।
মূল প্রবন্ধে সুজন সম্পাদক বলেন, গত দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সংসদকে বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে ভবিষ্যতের নির্বাচনও অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। এতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র চরম হুমকির মুখে পড়তে পারে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হচ্ছে, তার ওপর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করছে।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তোলা জরুরি বলে মনে করেন বদিউল আলম মজুমদার। এ জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যের কথা বলেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল মতিন বলেন, যে দলই ক্ষমতায় আসবে, তারা ক্ষমতা ছাড়তে চাইবে না। এর স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তনের কথা বলেন তিনি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশে দুটি দল আছে, যাদের একটি অংশ না নিলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, যাতে দুই দলই অংশ নেয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, যাদের দিয়ে নির্বাচন করা হবে অর্থাৎ প্রশাসন, তাদের মানসিকতা বিবেচনায় নিতে হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিকভাবে না চললে জবাবদিহির বড় ফারাক দেখা দেয়। তখন দুর্নীতিসহ নানা অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি হয়। এ জায়গা থেকে বের হতে হবে। দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র নেই। তাদের এ কাঠামোপদ্ধতি বিদ্যমান থাকলে দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক সুশাসন আসবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রিয়াজ বর্তমান পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক সংকট উল্লেখ করে বলেন, সংবিধান পরিবর্তন করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে। পঞ্চদশ সংশোধনীর পটভূমি হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা এককেন্দ্রিক করার প্রবণতা। কারও ইচ্ছায়, ব্যক্তির কারণে অনেকবার সংবিধান সংশোধনী হয়েছে। বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধনের পথ কঠিন নয়।
আলী রীয়াজের মতে, ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশে বহুদলীয় কার্যকর ব্যবস্থা রাখতে চায় কি না, সেটা বোঝা যাবে সামনের নির্বাচনে। এখানে রাজনীতিক, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সক্রিয় হওয়া দরকার।
আগামীতে বিরোধী দল খুঁজে পাওয়া নিয়ে বড় সংকট তৈরি হবে বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, এত বছর ধরে কার্যকর কোনো বিরোধী দল সংসদে দেখা যাচ্ছে না। এটা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও সামনে দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়গুলোকে সদিচ্ছার সঙ্গে দেখার আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনের ওপর। আগামী নির্বাচন এ সরকারের অধীনে কোনোভাবেই সুষ্ঠু হবে না।
সভাপতির বক্তব্যে সুজনের সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, দলীয় সরকারের অধীনের সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এর জন্য সমাধান বের করতে হবে। বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন চার্লস ডারউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো রিদওয়ানুল হক, টেকসই উন্নয়নবিষয়ক গবেষক ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব, ইকরাম হোসেইন প্রমুখ।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:এপ্রিল ০৪, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,