নতুন ইতিহাস গড়ল ব্রিটেন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক। তিনিই প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত, যিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসলেন।
ইতিহাস এখানেই শেষ নয়। আরেকটি বড় বিষয় হলো, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত তিনিই সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। এমনকি যুক্তরাজ্যের রাজা চার্লসের চেয়েও তাঁর সম্পদ বেশি। রাজা চার্লস ও ক্যামিলার সম্পদের মূল্য ৩৫ কোটি পাউন্ড আর ঋষি সুনাকের সম্পদমূল্য ৭৩ কোটি পাউন্ড। ফলে তাঁর মতো ধনী ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খবরে সবাই নড়েচড়ে বসবে, এটাই স্বাভাবিক।
ঋষি ও তাঁর পরিবারের এই বিপুল সম্পত্তির উৎস কী? তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার ব্যবসা ও হেজ ফান্ড (বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের একটি সীমিত অংশীদারিত্বের ব্যবসা)। ওয়েবসাইটে নিজের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, বড় এক বিনিয়োগ ফার্মের সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি ব্যবসায়িক জীবনে সফলতা অর্জন করেছেন। এই ফার্ম সিলিকন ভ্যালি থেকে শুরু করে বেঙ্গালুরু পর্যন্ত অনেক কোম্পানির সঙ্গে কাজ করেছে। এই ফার্ম ছোট ছোট ব্রিটিশ ফার্মগুলোকে সহায়তা করেছে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি এতকিছুর মালিক হননি।
ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন জেনারেল হাসপাতাল থেকে কিছুটা দূরে এক ব্যস্ত লোকালয়ে ছিল এক ওষুধের দোকান। নাম ‘সুনাক ফার্মেসি’। ভাগ্যান্বেষণে ঋষির দাদু-দিদার বিদেশযাত্রা থেকে মায়ের ফার্মেসি তৈরি করা, কঠোর পরিশ্রম ও পড়াশোনা-এই ছিল ব্রিটেনের হবু প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের মূল পুঁজি ও বনিয়াদি শিক্ষা।
যেভাবে উঠে এলেন
ঋষির পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের বাসিন্দা। স্বচ্ছন্দ জীবিকার খোঁজে সুনাক পরিবারের সদস্যরা পূর্ব আফ্রিকায় পাড়ি দেন। কিন্তু সেখানে প্রবল ভারতবিরোধী মনোভাবের কারণে তাঁরা ব্রিটেনে চলে যান। ঋষির মা ঊষার পরিবারের কাহিনিও তেমনই সাহসের। ঊষার মা, অর্থাৎ ঋষির দিদা ছিলেন তানজানিয়ার বাসিন্দা, নাম ‘স্রাক্ষা’। সেখানে বাস করতেন পাঞ্জাবিরা। বিয়ের পর ঋষির দিদা নিজের গয়না বিক্রি করে সেই টাকায় ব্রিটেন যাওয়ার টিকিট কেনেন-একটিই টিকিট। এবং সেটিও শুধু যাওয়ার, ফেরার নয়। ১৯৬৬ সালে স্বামী, সন্তানকে বাড়িতে রেখে রোজগারের উদ্দেশে একেবারে একা বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডের লেস্টারে গ্রন্থাগারিকের কাজ নেন। পরভূমে একা একা এক বছর কঠিন পরিশ্রম করে যা উপার্জন করেছিলেন, তা দিয়ে পরিবারের খরচ চালানোর ক্ষমতা তৈরি করে ফেলেছিলেন স্রাক্ষা। পরে পরিবারের বাকিরাও চলে যান তাঁর কাছে। ঋষির মা ঊষা অস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসি পড়তেন। সেখানেই ডাক্তারিপড়ুয়া যশবীরের সঙ্গে তাঁর দেখা ও পরিচয়। অতঃপর প্রেম ও বিবাহ।
বিয়ের পর যশবীর-ঊষা সাউদাম্পটনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁদের তিন সন্তান। ঋষি জ্যেষ্ঠ পুত্র। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন ঋষি। আবার দারুণ আগ্রহ খেলাধুলায়ও। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি-সবই খেলতেন। ব্রিটেনের ভাবী প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষিকা জুডি গ্রেগরির কথায়, ‘ক্লাসে ঋষিকে দেখেছি সবচেয়ে শান্তশিষ্ট অথচ সবার খেয়াল রাখা এক ছেলে। ভিড়ের মাঝেও কীভাবে যেন আলাদা করে সবার নজর কাড়ত ও।’
কিশোর বয়সে ছুটির দিনে সাইকেল চালিয়েই বেশি সময় কেটেছে ঋষির। ফার্মেসি থেকে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসতেন। তাতে বাড়তি কিছু রোজগার হতো। পরিবারকে সাহায্য করা হতো। একসময় সাউদাম্পটনে একটি রেস্তোরাঁয় ওয়েটারেরও কাজ করেছেন।
সাফল্যের মূলমন্ত্র কী? ঋষি বলেন, ‘অবশ্যই পরিশ্রম।’ ছাত্রাবস্থায় কখনো নেশা করেননি তিনি। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে সিগারেটে সুখটানও দেননি, অন্য কোনো মাদক তো দূরের কথা। ‘স্টার ওয়ার’ ও ‘জেমস বন্ড’ সিরিজের ভক্ত ছিলেন একটা সময়। আর শখ বলতে নিত্যনতুন ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম কেনা। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা শেষ করে ‘গোল্ডম্যান স্যাকস’-এ বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেছেন অর্থনীতির এই ছাত্র। সাউথ কেনিংটনে নিজের টাকায় সেই প্রথম বড় বাড়ি কিনেছিলেন ঋষি। কিছুটা অর্থসাহায্য অবশ্য মা-বাবাও করেছিলেন। চাকরির পাশাপাশি চলছিল এমবিএ। ২০০৬ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ঋষির আলাপ অক্ষতার সঙ্গে। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণমূর্তির কন্যা অক্ষতা অর্থনীতির পাশাপাশি ফরাসি ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়েও ডিপ্লোমা রয়েছে তাঁর। শোনা যায়, মেয়ের সঙ্গে ঋষির সম্পর্ক জানার পর নাকি প্রথমে খুশি হননি নারায়ণমূর্তি। তবে পরে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ঋষির সঙ্গে মুখোমুখি আলাপের পর মনোভাব বদলে গিয়েছিল তাঁর। জীবনে সফলতার পেছনে তাঁর স্ত্রী অক্ষতা মূর্তি ও শ্বশুরের বড় ভূমিকা আছে বলেই জানা যায়।
যত সম্পদ
মধ্য লন্ডনে বিলাসবহুল বাড়ি আছে ঋষির। নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে সেই বাড়িতে। শোনা যায়, সেই বাড়িতে পাঁচটি বেডরুম ও চারটি স্নানঘর আছে। পাশে বিশাল বাগানও। বলা বাহুল্য, ঋষির এই বিলাসবহুল বাড়ির দামও অনেক। বাড়িটি প্রায় ৪৫ কোটি টাকায় কিনেছিলেন ঋষি-অক্ষতা। এখন এই বাড়ির বাজারমূল্য ৭০ কোটি টাকারও বেশি। গত এপ্রিল মাসে বাড়িটি নতুন রূপে সাজানো হয়েছে। শোনা যায়, স্ত্রী-র মনের মতো করেই ঋষি তাঁদের বাড়ি সাজিয়েছেন।
লন্ডনের ওল্ড ব্রম্পটন রোডে দক্ষিণ কেনসিংটনে আরও একটি বাড়ি রয়েছে দম্পতির। বন্ধুদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে এই বাড়িতে যান তাঁরা। এ ছাড়াও নর্থ ইয়র্কশায়ারে ঋষির খামারবাড়িও রয়েছে। ওই বাড়িটিও অত্যন্ত বিলাসবহুল।
প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশকে গভীর আর্থিক সমস্যা থেকে বের করা তাঁর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন ঋষি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, দেশের আর্থিক মন্দা এড়াতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার। যদিও অর্থনীতির ছাত্র ঋষির সম্পত্তি নিয়ে ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যমে একাধিক বার লেখালেখি হয়েছে। একটি সংবাদমাধ্যম তো কটাক্ষ করে শিরোনামই করেছিল ‘ঋষি রিচ’ (কমেডি সিরিজ ‘রিচি রিচ’-এর অনুকরণে)। সেই প্রতিবেদনে ঋষি ও তাঁর ফ্যাশন ডিজাইনার স্ত্রীর বিলাসবহুল জীবনযাত্রা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। ৪ হাজার ৩০০ পাউন্ডের স্যুটের প্রতি ঋষির আকর্ষণ, কোন বিশেষ ব্র্যান্ডের জুতো পরতে ভালোবাসেন, সে সব নিয়েও বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। প্রশ্নের মুখেও পড়েছেন তিনি।
ধনী শ্বশুর
ঋষি সুনাকের শ্বশুর নারায়ণ মূর্তি ভারতের অন্যতম শীর্ষ ধনী। তিনি বিখ্যাত সফটওয়্যার ফার্ম ইনফোসিসের সহ–প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ফরচুন ম্যাগাজিনের এ সময়ের শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তাদের একজন। তাঁর সম্পদমূল্য ৪০০ কোটি ডলারের বেশি।
**** সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, ইকোনমিক টাইমস, বিবিসি।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:অক্টোবর ২৫, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,