লেখক: শুভজিৎ বাগচী।
ভারতে উচ্চ ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি স্বাধীনতার পরের সাত দশকে একটা ‘মতবাদ’ প্রতিষ্ঠা করেছে—আর যা–ই হোক, ভারতে কখনো অন্য অনেক দেশের মতো গণতন্ত্র বাঁচানোর তিন প্রধান প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়বে না। প্রতিষ্ঠান বলতে এখানে ‘এক্সিকিউটিভ’ বা সরকার ও সরকারি কার্যনির্বাহক, ‘লেজিসলেচার’ বা জাতীয় আইনসভা এবং রাজ্যের বিধানসভা এবং বিচারব্যবস্থাকে বোঝানো হচ্ছে। গত আট বছরে বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) বুঝিয়ে দিয়েছে, কোন মূর্খের স্বর্গে ভারতের জনসংখ্যার হারে ক্ষুদ্র সুশীল সমাজ, কংগ্রেস ও বামমনস্ক প্রগতিশীল, গান্ধীবাদী তাত্ত্বিক, পশ্চিমি গণতন্ত্র ও প্রগতিশীল দর্শনে বিশ্বাসী সমাজবোদ্ধারা বাস করছিলেন। সমাজের একেবারে নিচের অংশে বা তার সামান্য ওপরে ভেসে থেকে রোজ কোনোক্রমে বেঁচে থাকার লড়াই চালানো সংখ্যাগরিষ্ঠের যে ভারতের গণতন্ত্র, সংবিধান বা বিচারব্যবস্থার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এবং সেই কারণে তা বাঁচানোর দায়বদ্ধতাও নেই, এটা বুদ্ধিজীবীরা গত কয়েক বছরে বুঝেছেন। এর জন্য নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ।
বিষয়টি আরও পরিষ্কার করা যাক। ভারতের প্রশাসনিক কাজকর্ম যাঁরা দেখেন, তাঁদের একটা বড় অংশের সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট নিয়ে যদি গবেষণা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, তাঁদের অনেকেই বেছে বেছে মুসলমানবিরোধী অথবা হিন্দুত্ববাদী খবর ছড়াচ্ছেন। তাঁদের অধিকাংশই নিশ্চয়ই মনে করছেন যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা এতে খুশি হবেন এবং দ্রুত উন্নতি হবে। এটা সম্ভব হচ্ছে, কারণ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা অর্থাৎ লেজিসলেচার—যাঁরা এই প্রশাসকের ওপরে রয়েছেন—তাঁরা নিয়মিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে চলেছেন। এ অবস্থায় প্রশাসক ও জনপ্রতিনিধিদের যাঁরা মনে করিয়ে দিতে পারতেন যে দেশ শাসন করতে গেলে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া জরুরি; কারণ এখনো ভারত খাতা–কলমে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র—তাঁরা হলেন বিচারপতি।
কথাটা বিচারপতিরা হয়তো বলছেন, কিন্তু খুব জোর দিয়ে আর বলতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে যখন সর্বোচ্চ বিচারব্যবস্থার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, যা তুলছেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতিরাই। যেমন সম্প্রতি গুজরাট দাঙ্গা (২০০২) সংক্রান্ত একটি মামলা খারিজ করে অন্যতম অভিযোগকারী মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী তিস্তা সেতলবাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া বিচারব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক ও আইনবিরুদ্ধ বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মদন লোকুর।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, ‘যারা প্রক্রিয়ার অপব্যবহার করেছে (অর্থাৎ ভুয়া মামলা করেছে), তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’ রায়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেতলবাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারপতি লোকুর বলেছেন, এই রায় ‘প্রতিহিংসাপূর্ণ’ ও ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’, ‘অপ্রয়োজনীয় ও দুঃখজনক’ এবং বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর ‘মোহভঙ্গ হয়েছে’। ভুয়া মামলার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হলে ‘সীমাহীন সংখ্যায় ভারতবাসীর বিরুদ্ধে, বিশেষত পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়,’ বক্তব্য বিচারপতির। বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে এটিকে ‘ধূসর দিন’ বলে তিনি চিহ্নিত করেন। এ ছাড়া বাবরি মসজিদ রায়ের মতোই, গুজরাট রায়ের নথিতে কোনো বিচারপতি সই করেননি। বিচারপতি লোকুর বলেন, এ ঘটনায় তিনি ‘স্তম্ভিত’।
এর তিন দিন পর, চার বছর আগে করা একটি টুইটের জেরে গ্রেপ্তার করা হয় ভুয়া খবর চিহ্নিত করার কলকাতার একটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইট অল্ট নিউজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জুবাইরকে। সুপ্রিম কোর্টের আর এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দীপক গুপ্ত এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি উদ্বিগ্ন ও বিভ্রান্ত। বুঝতে পারলাম না চার বছরের পুরোনো টুইট, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আঘাত করেনি, তার ভিত্তিতে কেন জুবাইরকে গ্রেপ্তার করা হলো এবং যদিবা হলো, তাহলে আদালত তাঁকে জামিন দিলেন না কেন।’
নূপুর শর্মা নামের বিজেপির সাবেক মুখপাত্র মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর বিরুদ্ধে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা প্রথম টুইটারে ফাঁস করেছিলেন জুবাইর। বিচারপতি গুপ্তের মতে, শর্মাকে তাঁর মন্তব্যের জন্য গ্রেপ্তার না করাটা সঠিক সিদ্ধান্ত। ‘কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাহলে জুবাইরকে গ্রেপ্তার করা হলো কেন? বিশেষত, নূপুর শর্মার বক্তব্যে যখন হিংসা ছড়িয়েছে, কিন্তু জুবাইরের বার্তায় তা চার বছরে ছড়ায়নি,’ বক্তব্য বিচারপতির। একই মানদণ্ডে সবাইকে বিচার করা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন বিচারপতি গুপ্ত।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ, বিচারের চিরাচরিত রীতি—প্রথমে প্রমাণ সংগ্রহ, তার ভিত্তিতে গ্রেপ্তার এবং এরপর আদালতে পেশ করা। ভারতে এখন মাঝেমধ্যেই প্রথমে গ্রেপ্তার, তারপর হেফাজতে রেখে প্রমাণ সংগ্রহ এবং শেষে আদালতে জামিন খারিজ করে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। কিছু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এ প্রক্রিয়াকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্তালিনের ‘শো ট্রায়াল’ (১৯৩৬-৩৮) বা নাৎসি জার্মানির ‘বিচারহীন জেল’ (১৯৩৩) নীতির সঙ্গে তুলনা করলেও অবস্থা অতটা খারাপ নয়। ভারতে এখনো বাক্স্বাধীনতা এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র আছে, যদিও পরিসর ছোট হচ্ছে।
ভারতের বিরোধীরা গত আট বছরে নিজেদের মধ্যে কোনো ঐক্য তৈরি করতে পারেনি; এ কারণে বিজেপিকে হারানোর কোনো ফর্মুলা ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে তাদের কাছে নেই। মোটামুটি নিশ্চিন্তে বলা যায়, বিজেপি জিতবে। এরপর ২০২৬ সালে সংবিধান মেনে লোকসভা ও রাজ্যসভার আসনসংখ্যা বাড়াতে হবে। ভারতের লোকসভার আসনসংখ্যা ৫৫২ থেকে বেড়ে হবে ৮৮৮ এবং রাজ্যসভার ২৪৫ থেকে বেড়ে ৩৪৩। বিভিন্ন সূত্র উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যম এ তথ্য জানিয়েছে। কাদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং প্রকাশ্যে বিতর্ক না করে এ সংখ্যায় সরকার কীভাবে পৌঁছাল, তা স্পষ্ট নয়। বিষয়টিকে মাথায় রেখে আসনসংখ্যা বাড়িয়ে নতুন পার্লামেন্ট ভবন বানানো হয়েছে। আসন মূলত বাড়বে বিজেপির দুর্গ উত্তর প্রদেশে, যেখানে লোকসভায় ৮০টি আসন রয়েছে। এ পরিবর্তনের পরে আগামী বহু দশক বিজেপিকে হারানো সম্ভব হবে না।
বস্তুত, সম্পূর্ণ এককভাবে সম্প্রতি ভারতের জাতীয় পতাকার সংজ্ঞা (কোড) পাল্টে দিয়েছে সরকার। এখন থেকে জাতীয় পতাকা বানানোর জন্য পলিয়েস্টার কাপড় বিদেশ থেকে আনানো যেতে পারে। বিজেপি অবশ্য বলেছে, কংগ্রেস ২০০৫ সালেই এই পরিবর্তন করেছিল, কংগ্রেস নতুন সিদ্ধান্তের কিছু প্রতীকী বিরোধিতা করেছে। আর জুলাই মাসের মাঝামাঝি ভারতের জাতীয় প্রতীক অশোকস্তম্ভের সিংহের অবয়ব এককভাবে পাল্টে দিয়েছে সরকার। নতুন সংসদ ভবনে পূজা করে প্রতীকের উদ্বোধন করা হয়েছে। এক বিবৃতিতে সিপিআইএম (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্ট) জানিয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতীককে সরকারি স্তরে বন্দনা করা যায় না। এসবে অবশ্য বিজেপির কিছু যায়–আসে না। কারণ, তারা জানে সংখ্যাগরিষ্ঠ কাদের পেছনে আছে।
ভারতের অর্থনীতি সম্পূর্ণ মুখ থুবড়ে পড়েছে, ডলারের তুলনায় ভারতীয় রুপির বিনিময়মূল্য আশির বেশ খানিকটা ওপরে চলে গিয়েছে, যা একটা রেকর্ড। ভারতে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা দ্রুত বেসরকারি হাতে চলে যাচ্ছে, যার অর্থ ভবিষ্যতে দরিদ্র পরিবারের সন্তান কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর যেতে পারবে না। সংখ্যালঘুদের ওপরে অত্যাচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তা নিয়ে লিখতে গেলে সব খবরই একই রকম শোনাবে, ফলে কেউ আর বিশেষ লেখেন না।
ইন্দিরা গান্ধী যে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, তার আর প্রয়োজন পড়ছে না। কারণ, এক্সিকিউটিভ, লেজিসলেচার ও বিচারব্যবস্থার মধ্যে মতের পার্থক্য ক্রমে কমছে এবং এসবের ওপরে রয়েছে বিজেপির তথ্যপ্রযুক্তি বা আইটি সেল। তারা যেকোনো সময়ে বিনা প্ররোচনায় কাউকে আক্রমণ করে সামাজিক স্তরে অপদস্থ করতে পারে। যেমন এই সপ্তাহে করা হচ্ছে ভারতের সাবেক উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিকে।
এ তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। কেউই কিছু করতে পারবেন না। কারণ, ভারতের সমাজের সাংস্কৃতিক আঁধার বরাবরই ধর্মীয় ছিল এবং নানা কারণে এখন তা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়েছে। এ গোত্রের জাতীয়তাবাদের নেতা নরেন্দ্র মোদি জনপ্রিয়তার বিচারে ১০০–র মধ্যে ১০০ পেলে বাকিরা ১০ পেরোবেন কি না সন্দেহ। বস্তুত, নিজের দেশে জনপ্রিয়তার বিচারে এই মুহূর্তে বিশ্বে মোদিই সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা।
‘মর্নিং কনসাল্ট’ নামে আমেরিকার এক সংস্থা বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানদের দৈনিক জনপ্রিয়তা মাপে। তাদের ১৪ জুলাইয়ের পরিসংখ্যান বলছে, নিজের দেশে জনপ্রিয়তার বিচারে নরেন্দ্র মোদির ধারেকাছে কেউ নেই। তাঁর রেটিং ৭৬, তারপর মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল লোপেজ (৬৬), আর বাকি সবাই ২০ থেকে ৩০–এর কোঠায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের অবস্থা খুবই খারাপ, রেটিং ৩৮।
ফলে ২০২৪ সালে কে জিতবে, তা নিয়ে তর্কের প্রয়োজন নেই। সংবিধান এবং রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সংগীত কবে পাল্টায়, এখন তারই অপেক্ষা।
**** শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ: জুলাই ২৭, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,