এশিয়া টাইমসের নিবন্ধ
ইউক্রেনের খারকিভসহ বিভিন্ন অঞ্চলে দেশটির সামরিক বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতে ৩ লাখ রিজার্ভ সেনা নিযুক্তির রাশিয়ার চেষ্টা সামরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। তবে মস্কোর এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাশিয়ার জ্বালানি খাতের হিসাব-নিকাশ।
সেনা নিযুক্তির এ আহ্বানে রাশিয়ার নেতৃত্ব বিশেষভাবে নিশানা করেছে তেল ও গ্যাস খাতের কর্মীদের। এতে যে কেউ মনে করতে পারেন যে রাশিয়ার ভীষণভাবে প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও রপ্তানি রাজস্বের জোগানদাতা এই কর্মীদের দেশটির যুদ্ধ পরিচালনায় খুব দরকার হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিস্ময় জাগানো এ পদক্ষেপ এমন সময় নেওয়া হচ্ছে, যখন রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে জ্বালানি নিয়ে দ্বন্দ্ব বাড়ছে।
গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম ১ ও নর্ড স্ট্রিম ২–এ ছিদ্র দেখা দেয়। এটা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড হতে পারে। জ্বালানি নিয়ে রাশিয়া-ইউরোপের সম্পর্কে জটিলতা ও অস্থিরতা চলার মধ্যেই ঘটল এ ঘটনা।
বৈশ্বিক জ্বালানি নীতির একজন বিশ্লেষক হিসেবে এ ধারণা করা যায়, সামনে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধের ঘটনা আরও ঘটতে পারে। তা হতে পারে ইউরোপের দেশগুলোর সরকারের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়াতে ক্রেমলিনের সরাসরি নির্দেশে কিংবা নতুন নাশকতার ঘটনার ফলাফল হিসেবে। সেনা নিযুক্তিতে তেল-গ্যাসকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করায় এ খাতে প্রশিক্ষিত রুশ জনবলের সম্ভাব্য ঘাটতির কারণেও ঘটতে পারে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধের আরও ঘটনা।
কমছে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ
ইউক্রেন যুদ্ধে দেশটির পাশে রয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। এ অবস্থায় তাদের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা হিসেবে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে রাশিয়া। নর্ড স্ট্রিম ১ ও নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইন ছিদ্র হওয়ার আগে গত মে মাসে রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত জ্বালানি কোম্পানি গাজপ্রম বেলারুশ ও পোল্যান্ডের মধ্য দিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়।
গত জুনে গাজপ্রম জার্মানিতে নর্ড স্ট্রিম ১ পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাসের সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়। প্রতিদিন ১৭ কোটি কিউবিক মিটার গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে এই পাইপলাইনের। কিন্তু জার্মানিতে সরবরাহ কমিয়ে করা হয় দৈনিক মাত্র ৪ কোটি কিউবিক মিটার। কয়েক মাস পরই প্রতিষ্ঠানটি ঘোষণা দেয়, পাইপলাইনটি সংস্কার করা প্রয়োজন। এ জন্য পুরোপুরি বন্ধ থাকবে এটি।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় নেতাদের অভিযোগ, ইউরোপের দেশগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ আরও বিঘ্নিত করতেই রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে এই পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কেননা, নরওয়ে থেকে পোল্যান্ডে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহে এক গুরুত্বপূর্ণ নতুন পাইপলাইন চালুর উদ্যোগের মধ্যেই নর্ড স্ট্রিম ১–এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
গ্যাস রপ্তানির ক্ষেত্রে রাশিয়ার অবকাঠামোগত বিকল্প খুবই সীমিত। দেশটির এমন বিকল্প নেই, যার মাধ্যমে তারা সাইবেরিয়া অঞ্চলের প্রাকৃতিক গ্যাস চীনের মতো গ্রাহক দেশগুলোতে পাঠাতে পারে। স্বাভাবিকভাবে রাশিয়াকে তার অধিকাংশ গ্যাস অন্য বাজারের পরিবর্তে ইউরোপে বিক্রি করতে হয়। রাশিয়া ইউরোপে গ্যাসের সরবরাহ না করলে বা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে দিলে সাইবেরিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের কূপগুলোতে উৎপাদন বন্ধ করা প্রয়োজন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে গ্যাস খাতের কর্মীরা সেনা নিযুক্তির জন্য উপযুক্ত হবেন।
তেল থেকে আসা মুনাফায় লাগাম
রাশিয়ার সেনা নিযুক্তিতে বিভিন্ন তেল কোম্পানির কর্মীরাও রয়েছেন মনোযোগের কেন্দ্রে। তাই রাশিয়া থেকে জ্বালানি সরবরাহের বিঘ্ন এবার তেলের ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়ে কি না—কিছু বিশ্লেষক সেই প্রশ্ন তুলেছেন। বাস্তবে সেটি হলে, তা হতে পারে দুর্ঘটনাবশত কিংবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে।
রাশিয়া থেকে বিদেশে তেল সরবরাহে বিঘ্ন শুরুর একটি সম্ভাব্য তারিখ ৫ ডিসেম্বর, ২০২২। দেশটির বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপ করা জ্বালানি নিষেধাজ্ঞার ষষ্ঠ ধাপ শুরুর চূড়ান্ত সময়সীমা এটি। নিষেধাজ্ঞার বিস্তারিত বিষয়াবলি ও নিষেধাজ্ঞার ফলস্বরূপ রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের ক্রেতাদের যে মূল্য চোকাতে হবে, সেটি কীভাবে সমন্বয় করা হবে—তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। এ কারণে এখন পর্যন্ত তেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়নি। কিন্তু ওই নিষেধাজ্ঞা যখন কার্যকর হবে, তখন বিশ্ববাজারে নতুন করে তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে।
নতুন ধাপের ওই নিষেধাজ্ঞার অধীন ইউরোপের দেশগুলো সমুদ্রপথে রাশিয়া থেকে অশোধিত জ্বালানি তেল কেনা পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে। এই পদক্ষেপ যতটা ক্ষতির বলে মনে হচ্ছে, আসলে ততটা নয়। কেননা এরই মধ্যে ইউরোপের অনেক দেশ তেল কিনতে বিকল্প উৎস বেছে নিয়েছে।
ইউক্রেনে অভিযান শুরুর আগে রাশিয়া কৃষ্ণসাগর ও বাল্টিক সাগর হয়ে ইউরোপে দৈনিক গড়ে ১৪ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করত। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউরোপের এই তেল কেনা দিনে ১০ লাখ ব্যারেলের নিচে নেমেছে। কিন্তু রাশিয়া ওই পথে ইউরোপের বদলে চীন, ভারত ও তুরস্কে তেল রপ্তানি করে তার প্রকৃত সরবরাহ বাড়িয়ে চলেছে।
তেলের ট্যাংকার, ইনস্যুরেন্স সুবিধা ও জাহাজের মাধ্যমে তেল সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে রাশিয়ার সুযোগ সীমিত। রাশিয়া সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত এসব সেবা প্রধানত ইউরোপ থেকে নিয়ে আসছিল। ষষ্ঠ ধাপের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে চীন, ভারত, তুরস্কের মতো দেশগুলোকে সমুদ্রপথে রুশ মালিকানাধীন বা চার্টার্ড জাহাজ থেকে সংগৃহীত তেলের অংশবিশেষ অন্য দেশের পতাকাবাহী জাহাজে স্থানান্তর করতে হবে; যেসব জাহাজ নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে। এটি একটি সাধারণ প্রক্রিয়া ও সব সময় অবৈধ নয়। নিষেধাজ্ঞা এড়াতে প্রায়ই এ পন্থা অবলম্বন করা হয়ে থাকে।
ব্যয়বহুল এ প্রক্রিয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে রাশিয়া তার ব্যারেলপ্রতি তেলের রপ্তানিতে ৪০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে। পর্যবেক্ষকেরা সাধারণভাবে অনুমান করছেন, ইউরোপীয় ক্রেতারা রাশিয়ার কাছ থেকে অপরিশোধিত তেলের আমদানি কমিয়ে দিলেও মস্কো ঠিকই সেই তেলের বিকল্প ক্রেতা খুঁজে নেবে।
রাশিয়ার তেল কোথায় যাচ্ছে
রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের এই বাড়তি বিক্রিবাট্টায় লাগাম টানার লক্ষ্যে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির ইউরোপীয় মিত্ররা। মস্কোর জন্য নৌপথে পণ্য পরিবহনের বিভিন্ন পরিষেবা নেওয়ার সুযোগ কমিয়েছে তারা। এর মধ্যে রয়েছে তেলবাহী ট্যাংকার ভাড়া, বিমা ও ট্যাংকারগুলোতে কাজ করেন—এমন নাবিক পাওয়ার মতো পরিষেবা। পশ্চিমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর বাইরে তৃতীয় পক্ষ—যারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে অপরিশোধিত তেল কিনবে, তাদের কাছে তেল বিক্রির সময় এই পরিষেবাগুলো পাবে না রাশিয়া।
গত ৯ সেপ্টেম্বর নতুন একটি নির্দেশনা জারি করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ফরেন অ্যাসেট কন্ট্রোল অফিস। নির্দেশনাটি ছিল রাশিয়ার তেলের ওপর ৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞাকে সামনে রেখে। এর মধ্য দিয়ে মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় চাচ্ছে, রাশিয়ার তেল বিক্রি চলবে, তবে এ থেকে দেশটির আয় হবে কম। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, রাশিয়া থেকে কম দামে তেল কেনা হয়েছে—এটা নিশ্চিত করতে না পারলে ওই ক্রেতাকে ইউরোপের নৌপথে পণ্য পরিবহনের পরিষেবাগুলো নিতে দেওয়া হবে না।
তবে বাস্তবে এই কৌশল ব্যর্থ হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। ডেনমার্কের প্রণালিগুলো দিয়ে তেলবাহী জাহাজ চালাচ্ছেন দেশটির নাবিকেরা। এই প্রণালিগুলো রাশিয়ার পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পথ। আর তেল পরিবহনের জন্য ইউরোপের আওতার বাইরে থাকা জাহাজ জোগাড় করেছে মস্কো। মনে করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে এ জাহাজের সংখ্যা আরও বাড়বে।
আর ব্যবসায়ীরাও তেলের ওপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা ঘাড়ে নিয়েই দশকের পর দশক ধরে কাজ করছেন। নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দিয়ে তেল বেচাকেনা চালাতে নানা কারসাজির আশ্রয় নেন তাঁরা। এসব কৌশলের মধ্যে রয়েছে এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে তেল পাঠানোর সময় অবস্থান শনাক্ত করা এড়াতে জাহাজগুলোর রেডিও সিগন্যাল বন্ধ রাখা, নথিপত্রে ভুয়া তথ্য দেওয়া এবং বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সংরক্ষণাগারে তেল মজুত করা ও পরে সেখান থেকে বিক্রি ইত্যাদি।
চালকের ভূমিকায় পুতিন
তবে পুতিনের অন্য কিছু পরিকল্পনাও থাকতে পারে। জি-৭ তেলের দাম বেঁধে দিলে আরও বড় পরিসরে তেল সরবরাহ বন্ধ করা হবে বলে ইতিমধ্যে হুমকি দিয়েছেন তিনি। একটি রুশ রূপকথার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ইউরোপ ‘নেকড়ের লেজের মতো (ঠান্ডায়) জমে যাবে।’
অপরদিকে মার্কিন কর্মকর্তারা এখনো এই ধারণা নিয়ে আছেন যে, সরবরাহ বন্ধ করে নিজেদের তেলক্ষেত্রগুলোর ক্ষতি করবে না মস্কো। কিন্তু নানা কারণে এ ধারণার ভিত্তি নড়বড়ে। কারণগুলোর একটি, ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিতে বাধবে না পুতিনের।
২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের চাহিদা পড়ে যায়। সে সময় তেলের উত্পাদন কমিয়েছিল রাশিয়া। এবার ইউরোপের দেশগুলোতে রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করা হচ্ছে। এর জেরে ইতিমধ্যে গাজপ্রমের বাণিজ্যিক ভবিষ্যৎ হুমকিতে পড়েছে। এসব পদক্ষেপ থেকে এটাই বোঝা যায়, ক্রেমলিনের হিসাব-নিকাশে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়গুলোকে বড় অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না।
অনেকে আবার এটাও বলছেন যে, পরিস্থিতি সামলাতে বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে তেল সরবরাহ চালিয়ে যেতে চাইবেন পুতিন। এ ক্ষেত্রে সফলতাও পেয়েছে মস্কো। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এক দিনে সর্বোচ্চ ২০ লাখ ব্যারেল রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে চীন। বিপুল পরিমাণে রুশ তেল কিনছে ভারত ও তুরস্কও।
এদিকে ডিজেলের মতো রাশিয়ার পরিশোধিত জ্বালানিগুলো আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে। বর্তমানে ইউরোপের চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ ডিজেল আসে রাশিয়া থেকে। এতে উল্টো চাপে পড়তে পারে ইউরোপের অর্থনীতি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানে, তাদের রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা শূন্যের কোঠায় আনতে হবে। তবে বিষয়টি অত সহজ নয়। একই সঙ্গে অনেক বিষয় সামাল দেওয়ার পুতিনের যে প্রচেষ্টা, তা তাঁকে চালকের আসনে বসিয়ে রেখেছে।
*****অনুবাদ: মো. আবু হুরাইরাহ্ ও শেখ নিয়ামত উল্লাহ।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:অক্টোবর ১১, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,