লেখা:দ্য ইকোনমিস্ট ও বিবিসি।
বৈঠকে বসেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভ ও প্রথম রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন। তাঁদের ওই বৈঠক ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে। বৈঠক চলছে টাকা আট ঘণ্টা ধরে। রাশিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ওই বৈঠকের ওপরে। ঘটনাকাল ১৯৯১ সালের ২৩ ডিসেম্বর। এ বৈঠকের আয়োজক গর্বাচেভের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আলেকজান্ডার ইয়াকোভলেভ। তাঁর মুখেই শোনা যাক সেদিনের ওই বৈঠকে কি হয়েছিল তা নিয়ে। ইয়াকোভলেভ বলছেন, দীর্ঘ সময় বৈঠকের পর গর্বাচেভের শরীর খারাপ করতে শুরু করল। তিনি বৈঠক থেকে বেরিয়ে তাঁর কার্যালয়ের দিকে চলে গেলেন। অন্যদিকে ইয়েলেৎসিন ছুটে গেলেন আরেক দিকে।
ইয়াকোভলেভ যখন গর্বাচেভের কাছে গেলেন তিনি দেখতে পেলেন সোফায় শুয়ে পড়েছেন তিনি। তাঁর চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। ইয়োকোভলেভকে দেখে তিনি বললেন, ‘তুমি দেখলে, এভাবেই সবকিছু চলে।’ তাঁর এই দুঃখের কারণ ইয়াকোভলেভের বুঝতে বাকি ছিল না। কারণ একটু আগেই যা ঘটে গেছে তা যথেষ্ট বেদনাদায়ক ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হারিয়েছিলেন তিনি। একই সঙ্গে হারিয়েছেন তাঁর সব ক্ষমতা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। গর্বাচেভের শাসনের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে নয়া রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন বরিস ইয়েলেৎসিন। এ পরিস্থিতিতে ইয়াকোভলেভ তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে গর্বাচেভ যেন দম নিতে পারছিলেন না। ইয়াকোভলেভের ভাষ্য, ওই সময় গর্বাচেভের অনুভূতি ছিল, তাঁর সঙ্গে এমন কিছু হয়েছিল যাতে তাঁর দম আটকে আসছিল। কিন্তু তিনি এমন এক ব্যক্তি যিনি বিশ্বে বিশাল পরিবর্তন এনেছিলেন। কিন্তু ওই মুহূর্তের জন্য তিনি ছিলেন ইতিহাসের নিষ্ঠুরতা আর ছলনার নির্দয় শিকার।
কিন্তু এই নিষ্ঠুর ইতিহাসকে গর্বাচেভ নিজেই গতিশীল করেছিলেন। কিন্তু কেন? সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানের পর থেকেই পশ্চিমা, রুশ এবং চীনাদের মনে ‘কেন’ প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। কেন একজন পরাশক্তির প্রধান ব্যক্তি তাঁর নিজের কর্তৃত্বকে খর্ব করলেন? তিনি কি তাঁর কর্মের পরিণতি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, নাকি তিনি সাহস এবং দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ কাজ করেছিলেন? কীভাবে তিনি সামান্য ব্যক্তি থেকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হয়েছিলেন? রাষ্ট্রনায়ক হয়ে জনগণকে ৭০ বছরের মিথ্যা ও ভয় থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন? স্নায়ু যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে কবর দিয়েছিলেন? তিনি কীভাবে গর্বাচেভ হয়ে উঠেছিলেন?
মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলিয়াম টবম্যান গর্বাচেভকে নিয়ে তাঁর লেখায় এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মিখাইল গর্বাচেভের আত্মজীবনী ‘গর্বাচেভ : হিজ লাইফ অ্যান্ড টাইসম’ বইটিতে গর্বাচেভের জীবনের অনেক দিক তুলে আনার চেষ্টা করেছেন টবম্যান। সেখানে টবম্যান লিখেছেন, গর্বাচেভ একবার তাঁকে বলেছিলেন যে, গর্বাচেভকে বোঝা কঠিন। টবম্যান বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে গর্বাচেভের শৈশবকাল, কিশোর ও তরুণ বয়সের বিভিন্ন দিক তুলে এনেছেন। এখানেই তিনি গর্বাচেভকে নিয়ে তৈরি সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
১৯৩১ সালের ২ মার্চ রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের স্তাভরোপোলে মিখাইল সের্গেইতিচ গর্বাচেভের জন্ম। তাঁর মা-বাবা দুজনেই যৌথ খামারে কাজ করতেন। কৈশোরে গর্বাচেভ ফসল কাটার কাজ করতেন। গর্বাচেভের জন্মের সময়টাকে রুশ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময় মনে করা হয়। স্তালিন ওই সময় তাঁর হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন এবং কঠোর সমাজতন্ত্র চালু করেন। এ সময় দেশটির কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ওই সময় দুর্ভিক্ষে স্বজন হারান গর্বাচেভ। তাঁর এক দাদা সমাজতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করেন। এ কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হয়। তাঁর আরেক দাদা সমাজতন্ত্র মেনে স্তালিন ও লেলিনের ছবি ঘরে টাঙিয়েও রক্ষা পাননি। গর্বাচেভের মনে পরিবারের প্রতি অত্যাচার ও অবিচারের একটা ছাপ পড়েছিল।
গর্বাচেভ তাঁর কৃষক বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করেছেন। টানা ২০ ঘণ্টা মাঠে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। কৈশোরে তিনি ফসল কাটার কাজ করতেন। এই কঠোর পরিশ্রমের অভ্যাস তাঁর আজীবন ছিল। ১৯৫৫ সালে মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক হন গর্বাচেভ। সে সময়ই কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হন। বিয়ের পর স্ত্রী রাইসাকে নিয়ে ভাভরোপোলে ফিরে যান গর্বাচেভ। আঞ্চলিক পর্যায়ে দল গঠনের কাজ শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে সেন্ট্রাল কমিটিজ কমিয়ে আনা সেক্রেটারিয়েট ফর এগ্রিকালচারের সদস্য হিসেবে মস্কোয় যান গর্বাচেভ। দুই বছর পর পলিটব্যুরোর পূর্ণ সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান।
গর্বাচেভ তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন কিছু মূল্যবোধ সঙ্গী করে যা পরবর্তীতে তাঁর নীতি হয়ে দাঁড়ায়। তিনি শাসনের উপায় হিসাবে শারীরিক সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, মর্যাদা এবং কঠোর পরিশ্রমে বিশ্বাস করেছিলেন এবং ব্যক্তিগত জীবনকে সম্মান করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি নানাভাবে একজন অনুকরণীয় সোভিয়েত মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন পরিশ্রমী। তাঁর মধ্যে বুর্জোয়া প্রবৃত্তি ছিল না। তিনি সমাজতন্ত্রের নীতিতে বিশ্বাস করতেন কিন্তু সোভিয়েত শাসনের ক্ষেত্রে তিনি তা অনুশীলন করেননি। তাঁর মধ্যে ছিল অদ্ভুত বৈপরীত্য।
সমাজতন্ত্রকে একটি মানবিক চেহারা দেওয়ার প্রথম প্রচেষ্টা ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় গর্বাচেভের বন্ধু জেডেনেক মিলনার ও অন্যরা শুরু করেছিলেন। দুই দশক পরে ক্ষমতায় এসে গর্বাচেভ তা আবার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তিনি এ ক্ষেত্রে তিনি ক্ষমতার জোর দেখাতে চাননি।। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন একে বাঁচানোর জন্যেই। তিনি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার বদলে দেশবাসীর জীবনযাত্রার উন্নতি করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল দেশের মানুষ। তিনি অতিরিক্ত অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পশ্চিমাদের সঙ্গে দীর্ঘ দ্বন্দ্বের অবসান চেয়েছিলেন। মানবতার বিষয়টিই ছিল তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে। এ জন্যই আয়রন লেডি খ্যাত মার্গারেট থ্যাচারের প্রশংসা পেয়েছিলেন তিনি।
টবম্যান তাঁর বইয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে টক্কর দিতে গর্বাচেভের ভাবগত মত কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতার কথাও তুলে এনেছেন। অনেক সময় তাঁর এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই পশ্চিমা নেতারা তাঁকে বিশ্বাস করতে চাইতো না। জর্জ বুশ সিনিয়রের সময়কার এক উপদেষ্টা বলেন, গর্বচেভ যেসব সংস্কার করেছেন তাতে তাঁকে পূর্বসূরিদের তুলনায় বেশি বিপজ্জনক করে তুলেছে। ব্রেন্ট স্কোক্রফট নামের ওই কর্মকর্তা বলেন, গর্বাচেভ তাঁর উদারতা দিয়ে আমাদের স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
টবম্যান আরও বলেন, ওই সময় পশ্চিমে যাঁর ক্ষমতায় ছিল তাঁদের সোভিয়েত নিয়ে পরিকল্পনা প্রসারিত করার দৃষ্টিভঙ্গি ও ইচ্ছার অভাব ছিল। যাদের ছিল তাঁরা আর ক্ষমতায় ছিল না। ১৯৯১ সালে মিখাইলকে সাহায্য করার জন্য বুশকে অনুরোধ করেছিলেন থ্যাচার। তিনি বলেন, পশ্চিমা বিশ্ব যদি গর্বাচেভকে সাহায্য করতে না এগিয়ে আসত তবে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করত না।
গর্বাচেভের জীবন সোভিয়েতের অন্য নেতাদের মতো অফিসেই শেষ হয়নি। মিখাইল সের্গেয়েভিচ গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন ৫৪ বছর বয়সে, তখন তিনি ছিলেন পলিটব্যুরোর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। দেশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা থেকে বের করে আনতে তিনি পেরেস্ত্রোইকা (অর্থনৈতিক সংস্কার) এবং গ্লাসনস্ত (বাক্স্বাধীনতা) কর্মসূচি চালু করেন। পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত কমিয়ে আনতে ওয়াশিংটনে প্রথম চুক্তি স্বাক্ষর করেন গর্বাচেভ ও ডোনাল্ড রিগ্যান। ১৯৯০ সালে ‘ছয় শক্তির’ নিবিড় আলোচনার পর পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি আবার একত্রীকরণ হয়। এ আলোচনায় গর্বাচেভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান গর্বাচেভ।
১৯৯১ সালের জুনে বরিস ইয়েলেৎসিন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ওই বছরের ডিসেম্বরে গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নেরও বিলুপ্তি ঘটে।
রুশ সংবাদ সংস্থাগুলো জানায়, মারাত্মক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগে গত মঙ্গলবার গর্বাচেভ ৯১ বছর বয়সে মারা গেছেন। গর্বাচেভ কিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠেন বা কিভাবে তিনি গর্বাচেভ হয়ে ওঠেন রাজনীতি থেকে তাঁর মর্যাদাপূর্ণ অবসরের বিষয়টিই সেটি ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
**** ইকোনমিস্ট ও বিবিসি অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: সেপ্টম্বর ০১, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,