লেখক:স্লাভমির সিয়েরাকোভস্কি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের নানা দিক নিয়ে প্রতিনিয়ত অজস্র খবর বের হলেও একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ খবর উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। সেটি হলো, রাশিয়া থেকে গণহারে রুশ নাগরিকদের অন্য দেশে চলে যাওয়া। তারা সংখ্যায় কত, তা এখনই সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে একটি সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দুই লাখের বেশি মানুষ রাশিয়া ছেড়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে।
জো বাইডেন যেহেতু রাশিয়াকে ‘মেধাশূন্য’ করার পদক্ষেপ নেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং এর ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু অতি দক্ষ রুশ নাগরিকদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, সেহেতু ধরে নেওয়া যায় রুশদের এই গণদেশান্তরি আরও বেশ কিছুদিন অব্যাহত থাকবে। রাশিয়ায় যখন আর ভ্লাদিমির পুতিনের শাসন থাকবে না, তখন এই প্রবাসী রুশ নাগরিকেরাই এক নতুন রাশিয়া গড়ায় ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু রাশিয়া থেকে পুতিনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে যে রুশ নাগরিকেরা ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছেন, তঁাদের যে উষ্ণ আলিঙ্গনে স্বাগত জানানো হচ্ছে তা মোটেও নয়।
ইউক্রেনে পুতিনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযানে’ রুশ নাগরিকদের কত শতাংশের স্বতঃস্ফূর্ত সায় আছে, তা অবশ্য মোটেও পরিষ্কার নয়। রাশিয়ার প্রোপাগান্ডা যন্ত্রের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে এ–সংক্রান্ত যেসব জরিপের ফল দেখানো হচ্ছে, তার ওপর ততটা ভরসা করা যায় না। কিন্তু তারপরও নিরপেক্ষ জরিপ করার জন্য সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃত রুশ জরিপ প্রতিষ্ঠান লেভাদা সেন্টার যে ফল প্রকাশ করেছে, তা লক্ষ করার মতো।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক নেতাদের জনপ্রিয়তা জরিপ করার জন্য সাধারণ মানুষকে তিন–চারজন নেতার নাম দেওয়া হয়। সবচেয়ে সমর্থনযোগ্য নেতা কে? তার পরে কে? তার পরে কে? সেইমতো তাঁরা জরিপ করেছিলেন। সেখানে দেখা গেছে ৮৩ শতাংশ উত্তরদাতা পুতিনের নামের পাশে টিক চিহ্ন দিয়েছেন। এ ছাড়া কাউকে তাঁরা সমর্থন করেন না বলে জানিয়েছেন। তাঁদের জবাবের মধ্যেই এই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মনস্তত্ত্ব ধরা পড়ে। আন্দাজ করা হয়, পুতিনের বিরুদ্ধে যায়, এমন যেকোনো মতামত দিতে সাধারণ রুশ নাগরিকেরা একেবারেই প্রস্তুত নন। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, তাঁরা পুতিনকে সমর্থন করে থাকেন।
যদিও জরিপে দেখা যায় পুতিনকে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ রুশ নাগরিক সমর্থন করেন, তবে অনুমান করা যায়, আসল সংখ্যা অত নয়। তবে তাঁর সমর্থকদের সংখ্যা ৫০ শতাংশের আশপাশে হবে বলেই ধারণা করা যায়। যদি সত্যিকার অর্থে ২০ শতাংশ লোকও পুতিনের বিরোধিতা করে থাকেন, তাহলেও তাঁদের সংখ্যা ২ কোটি ৮০ লাখ হবে। সুতরাং ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিনের বিরোধিতা করতে গিয়ে গোটা রুশ সমাজের বিরোধিতা করলে সেটি এই বিশাল জনগোষ্ঠীরই বিরোধিতা করা হবে। সেটি রাজনৈতিকভাবে সঠিক হবে না। ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনের জয় হোক বা পরাজয় হোক, তাঁর প্রতি বিরুদ্ধবাদীদের মনোভাব বদলাবে বলে মনে হয় না। এই বিরুদ্ধবাদীদের একটি বিরাট অংশ দেশান্তরি হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের দেশ নিয়ে সব সময়ই চিন্তিত। তাঁরা তাঁদের মেধাকে দেশের কল্যাণে খাটাতে চান।
রাশিয়ার মূল সমস্যা হলো দেশটির রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বাইজেন্টাইন অর্থোডক্সি ও মোঙ্গল আধিপত্যের ওপর ভিত্তি করে; আর দেশটির অর্থনীতির ভিত্তি হলো প্রাকৃতিক উৎস থেকে তোলা শিল্পের কাঁচামাল। এই বিষয়গুলো সব সময়ই গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যায়। একটি দেশের মানুষের আয়রোজগার যদি উৎপাদন খাতের বদলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে আসে এবং তা যদি ক্ষমতাসীনেরা জনগণের মধ্যে বিলিবণ্টন করার দায়িত্ব নেয়, তাহলে সেখানে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বাইরে আর কী আশা করা যেতে পারে?
এই আদল থেকে দেশটির সরকার ও সমাজব্যবস্থাকে বের করে আনতে হলে লম্বা সময় দরকার। এর জন্য পশ্চিমা ইউরোপ সমাজকে রাশিয়া সম্পর্কে একটি নতুন মানসিক অবস্থার পর্যায়েও যেতে হবে। রাশিয়া থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়া সুদক্ষ রুশ অভিবাসীরা এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিতে পারেন। অতীতে যাঁরা রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পালিয়েছিলেন, তাঁরা তৎকালীন রুশ শাসনকে ঘৃণা করতেন; কিন্তু তঁারা বিশ্বাস করতেন, রাশিয়া সত্যিকার অর্থেই মহান হতে পারে এবং হওয়া উচিত। আলেকসান্দর সোলঝেনেৎসিন এবং জোসেফ ব্রদস্কির মতো ভিন্নমতাবলম্বীরাও এভাবে চিন্তা করেছিলেন।
আজকে রাশিয়া থেকে যেসব মেধাবী স্রোতের মতো রাশিয়া থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন, তাঁরাই হয়তো পুতিনমুক্ত রাশিয়ায় এক নতুন সমাজ বিনির্মাণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন। রাশিয়া থেকে যে মেধাবী জনশক্তি এখন বেরিয়ে যাচ্ছে, তা যাতে শেষ পর্যন্ত এক পরিবর্তিত রাশিয়ার কাজে লাগে, তা নিশ্চিত করার দায় এই দেশান্তরিদের ঘাড়েই বর্তায়।
**** ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
স্লাভমির সিয়েরাকোভস্কি ক্রিতিকা পলিতিকজানা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা এবং জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের একজন সিনিয়র ফেলো:
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: জুন ১৫; ২০২২
রেটিং করুনঃ ,