লেখক: সানাউল্লাহ সাকিব।
অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমাচ্ছে বাংলাদেশ। এতে দাম বাড়ছে মার্কিন ডলারের। আমদানি দায় মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে গত দেড় মাসে কয়েক ধাপে ডলারের দাম বেড়েছে ৭০ পয়সা। গত সোমবার যা বেড়ে হয়েছে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা।
তবে ব্যাংকগুলো প্রতি ডলারের জন্য আমদানিকারকদের থেকে নিচ্ছে ৯২-৯৩ টাকা। এ কারণে খরচ বাড়ছে আমদানি পণ্যের। যার প্রভাব পড়ছে ভোগ্যপণ্যের দামে। ভোক্তাদের বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে।
এ জন্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ঋণপত্র খোলার সময় নগদ জমার হার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, দেশে যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে ভবিষ্যতের ছয় মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা যাবে না।
এদিকে ব্যাংকিং চ্যানেলের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও আরও বেশি চটেছে নগদ ডলারের বাজার। গতকাল বুধবার নগদ প্রতি ডলারের দাম ৯৩ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। করোনার পরে বিদেশে যাওয়া বেড়ে গেছে, এর ফলে চাহিদাও বেড়েছে। তবে বিদেশি পর্যটক ও নগদ ডলার দেশে আসছে কম। এতেই বাড়ছে দাম।
খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আমদানি বাড়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের দাম বাড়ছে। এ জন্য রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়াতে বড় উদ্যোগ নিতে হবে। আর খোলাবাজারে সংকট কাটাতে কেউ যাতে সীমার বেশি নগদ ডলার বিদেশে নিতে না পারে, তার তদারকি জোরদার করতে হবে।
ডলার চড়া
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য ও জাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়ায় (জুলাই-মার্চ সময়ে) আমদানি খরচ বেড়ে গেছে প্রায় ৪৬ শতাংশ। তবে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। আবার প্রবাসী আয় যা আসছে, তা গত বছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম। এর সঙ্গে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি খাতের বড় অঙ্কের বিদেশি ঋণ পরিশোধ। ফলে আয়ের চেয়ে প্রতি মাসে প্রায় ২০০ কোটি বেশি ডলার খরচ হচ্ছে। এ কারণে বাড়ছে দাম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ব্যাংকিং চ্যানেলে গত ২২ মার্চ প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এরপর কয়েক দফায় দাম বাড়ানো হয়। আর গত সোমবার তা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। তবে ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের থেকে প্রতি ডলারের বিপরীতে ৯২-৯৩ টাকা আদায় করছে। ৯৫ টাকা নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন কেউ কেউ। যদিও ব্যাংকগুলোর ঘোষিত দামে তা উল্লেখ নেই। গতকাল অগ্রণী ও ইস্টার্ণ ব্যাংকের আমদানিকারকদের থেকে ঘোষিত ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা ৭৫ পয়সা।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ও এম আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একে দাম বেড়েছে, আবার জাহাজভাড়াও বেশি। এদিকে প্রতি ডলারের জন্য ব্যাংককে ৯৫ টাকা দিতে হচ্ছে। ডলারের দামের পার্থক্য ৮ টাকা হয়ে গেছে, যা আগে কখনো হয়নি। এখন খরচ অনুযায়ী পণ্যের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। অবস্থা যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এ জন্য অনেকেই পণ্য আমদানির ব্যবসাকে ঝুঁকি মনে করছেন।’ অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ডলারের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
ব্যাংক খাতের পাশাপাশি খোলাবাজারে ও মানি চেঞ্জারে নগদ ডলারের দামও এখন চড়া, যা ৯৩ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ঈদের আগেও যা ৯১ টাকা ছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খোলাবাজারের ওপর কোনো তদারকি নেই। অনেকেই বড় অঙ্কের ডলার সংগ্রহ করছেন। আবার বিদেশে যাওয়ার চাপ বেড়েছে। সেই পরিমাণ ডলার বিদেশ থেকে আসছে না। এ কারণে সংকট। নগদ ডলারের একমাত্র উৎস বিদেশ থেকে সঙ্গে নিয়ে আসা।
২০১৭ সালে নগদ ডলারের সংকট মোকাবিলায় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ৫০ লাখ ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আমদানির অনুমতি দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ডলার আমদানিতে প্রায় ৩৭ শতাংশ কর ও শুল্ক আরোপ থাকায় ব্যাংকটি মুদ্রা আমদানি করেনি। সর্বশেষ ২০১১ সালে ৪০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আমদানি করেছিল স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।
ডলারের দাম বাড়ায় যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁদের খরচও বেড়ে গেছে। মতিঝিলের ডলার ব্যবসায়ী মো. রিপন বলেন, ‘অনেকেই এখন বিদেশে যাচ্ছেন। তবে ডলারের সরবরাহ কম। এ কারণে দাম বাড়ছে।’
রিজার্ভে টান
সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে। এতে কমছে রিজার্ভ। গতকাল বুধবার বিক্রি করেছে ২ কোটি ১০ লাখ ডলার। এতে চলতি অর্থবছরের ডলার বিক্রির পরিমাণ ৫০০ কোটি ছাড়িয়েছে। আমদানি বাবদ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধ ও ডলার বিক্রির কারণে রিজার্ভ কমে হয়েছে ৪ হাজার ১৯৫ কোটি ডলার। গত ডিসেম্বরে যা ছিল ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।
এদিকে ব্যাংকগুলো চলতি অর্থবছরে ডলার কেনার জন্য প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোতে যে অতিরিক্ত তারল্য ছিল, তা–ও কমে এসেছে। গত মার্চে অতিরিক্ত তারল্য কমে হয়েছে ১ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা। তবে প্রকৃত অলস অর্থের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকার কম।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমরানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুদ্ধ ও রমজানের কারণে আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া বাকি থাকা আমদানি দায় পরিশোধ শুরু হয়েছে। এ জন্য ডলারের দাম বাড়ছে। এখন রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। হুন্ডি বন্ধে তৎপরতা বাড়াতে হবে। তাহলেই বাজার স্থিতিশীল হয়ে উঠবে। আমরা যে দামে ডলার পাচ্ছি, সেই দামে বিক্রি করছি। এতে কোনো মুনাফা করছি না।’
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রির মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। তবে অর্থনীতিবিদেরা ডলারের দাম ধরে না রেখে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে। কারণ, এতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়বে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, রপ্তানির চেয়ে আমদানি অনেক বেশি। এ জন্য ডলারের দাম বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সারা দেশে।
আমদানি টানে উদ্যোগ
ডলারের দাম বাড়ায় ও রিজার্ভে টান পড়ায় এখন বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য গাড়ি ও ইলেকট্রনিক পণ্যের ঋণপত্র খোলার সময় নগদ জমার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, করোনার প্রভাব এবং বহির্বিশ্বে যুদ্ধাবস্থার কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় দেশের মুদ্রা ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অধিকতর সুসংহত রাখার লক্ষ্যে আমদানি ঋণপত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে নগদ মার্জিন হার পুনর্নির্ধারণ করা হলো। এর ফলে মোটর কার (সেডান কার, এসইউভি ইত্যাদি), হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক সামগ্রীর আমদানির ঋণপত্র খোলার সময় ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে।
ঢাকা ব্যাংকের এমডি এমরানুল হক বলেন, ‘অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ কাজে দেবে। এর ফলে কেউ গাড়ি এনে মাসের পর মাস ফেলে রাখবে না। দেশে উৎপাদিত হয়, এমন ইলেকট্রিক পণ্যও কম আমদানি হবে। এতে আমদানির ওপর চাপ কমে আসবে। স্থিতিশীল হবে ডলারের বাজারও।’
তবে অনেকেই এই প্রজ্ঞাপনে ডলারের ওপর চাপ কমার প্রভাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কমিউনিটি ব্যাংকের এমডি মসিউল হক চৌধুরী ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, এ প্রজ্ঞাপনে কি আসল উদ্দেশ্য সাধিত হবে? কারণ, নগদ মার্জিন যদি ১০০ শতাংশও করা হয়, তা কেবল দেশীয় মুদ্রা অর্থাৎ টাকায় রাখা যাবে। তো এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় কি সম্ভব হবে?
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মে ১২, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,