বিবিসি অবলম্বনে ফাহমিদা আক্তার
সম্প্রতি টুইটারে কিছু ছবি প্রকাশ করে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী। একটি ছবিতে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া একটি রুশ ট্যাংকের ধ্বংসাবশেষ আবর্জনার মধ্যে পড়ে আছে।
আরেকটি ছবিতে দেখা গেছে এক ইউক্রেনীয় সেনার কাঁধে একটি অস্ত্র। দাবি করা হয়, এ অস্ত্র দিয়েই ধ্বংস করা হয়েছে রুশ ট্যাংকটি। টুইটারে প্রকাশিত ছবির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ইউক্রেন বাহিনীর বিজয় অর্জনের কথা। বলা হচ্ছে, এটি রাশিয়ার সামরিক যানে ‘জ্যাভেলিন অস্ত্রের আঘাতের ফল’।
জ্যাভেলিন হলো কাঁধে বহনযোগ্য ট্যাংক–বিধ্বংসী অস্ত্র। এখান থেকে ছোড়া রকেট চার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। বহনযোগ্য যে যন্ত্রের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তা ভিডিও গেমের ডিসপ্লের চেয়ে খুব বেশি আলাদা কিছু নয়। তবে এটি সরাসরি সাঁজোয়া যানের পাশে বা ওপর এক মিটার দৈর্ঘ্যের প্রজেক্টাইল নিক্ষেপ করতে পারে।
ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক অস্ত্র থাকায় রুশ সেনাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এমন হাজারো অস্ত্র পাঠিয়েছে।
বিভিন্ন সামরিক সহায়তা প্যাকেজের আওতায় ইউক্রেনে যেসব অস্ত্র পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর এখন পর্যন্ত ৩০০ কোটির বেশি সামরিক সহায়তা পেয়েছে কিয়েভ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত বৃহস্পতিবার নতুন করে ইউক্রেনের জন্য ৮০ কোটি ডলার সমমূল্যের সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এ প্যাকেজের আওতায় পূর্ব ইউক্রেনে ব্যবহারের জন্য ভারী গোলা বারুদ, হাউইটজার এবং কৌশলগত ড্রোন পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে রুশ পতাকাবাহী জাহাজের প্রবেশও নিষিদ্ধ করেছেন বাইডেন। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত পাঠানো অন্য অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে উড়ন্ত বোমা ও বিমান–বিধ্বংসী অস্ত্র, যার মধ্য দিয়ে হেলিকপ্টারের দিকে গুলি করা যায়।
তবে এসব অস্ত্রের চালান দিয়ে সুসজ্জিত রুশ বাহিনীকে ঘায়েল করা যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিবিসির এক বিশ্লেষণে সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য কী কী অস্ত্র পাঠিয়েছে?
ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি যে নিরাপত্তা সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি হাউইটজার কামান রয়েছে। এ প্যাকেজে ১ লাখ ৪৪ হাজার রাউন্ড গোলা ও কৌশলগত ড্রোনও পাঠানো হবে।
গত বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘আমরা এখন জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আছি, যার মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধের পরবর্তী ধাপের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে।’ তিনি আরও বলেন, দনবাস অঞ্চলকে প্রাধান্য দিয়ে এখন যুদ্ধ চলছে। এমন অবস্থায় ইউক্রেনের প্রয়োজনের কথা ভেবে তাদের অস্ত্র সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র।
এর আগের সহায়তা প্যাকেজের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র যেসব অস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছিল, তার মধ্যে আছে শরীরে পরিধেয় বিস্ফোরক, হেলমেট ও রাইফেল, সাঁজোয়া যান এবং সোভিয়েত যুগের নকশায় তৈরি হেলিকপ্টারসহ বিপুল সামরিক সরঞ্জাম। জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্র, স্টিঙ্গার বিমান–বিধ্বংসী ব্যবস্থাসহ বেশ কিছু শক্তিশালী অস্ত্রও তালিকায় রয়েছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিমান ভূপাতিত করতে স্টিঙ্গার বিমান–বিধ্বংসী ব্যবস্থা ব্যবহার করা হতো।
কয়েক শ ‘সুইচ ব্লেড’ ড্রোনও পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার আগে লক্ষ্যবস্তুকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে।
ইউক্রেনীয় বাহিনী যেসব অস্ত্র পরিচালনায় অভ্যস্ত নয়, তাদের তা সরবরাহ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা। চলতি সপ্তাহে পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, কীভাবে সুইচ ব্লেড ড্রোন ও অন্য গোলা বারুদগুলো ব্যবহার করতে হয়, তা কয়েকজন ইউক্রেনীয় সেনাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার পেন্টাগন আরও বলেছে, তারা ইউক্রেনকে ‘ভৌতিক ড্রোন (ঘোস্ট ড্রোন)’ দিচ্ছে। সুইচ ব্লেডের মতো একই রকমের সক্ষমতা রয়েছে এটির। কিরবির দাবি, ইউক্রেনের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বিমানবাহিনী দ্রুত সময়ের মধ্যে এ ড্রোন তৈরি করেছে। ঘোস্ট ড্রোনের আওতা ও সক্ষমতার কথা সুনির্দিষ্ট করে প্রকাশ করা হয়নি।
রাশিয়ায় হামলার ক্ষেত্রে এসব অস্ত্র কতটা কাজে দেবে
সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের যেসব অস্ত্র কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে, তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা ট্যাংক–বিধ্বংসী অস্ত্রও রয়েছে।
মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক কর্নেল ক্রিস্টোফার মায়েরের ভাষ্যমতে, ইউক্রেন বেশ কয়েকটি দেশ থেকে নানা ধরনের ট্যাংক–বিধ্বংসী ব্যবস্থা পেয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রুশ সামরিক যানের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় বাহিনীর সক্ষমতা বেড়েছে।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের দাবি, তাঁরা অস্ত্রগুলোর সদ্ব্যবহার করছেন। এখন পর্যন্ত রাশিয়ার ৮০০টির বেশি ট্যাংক ও ২ হাজার সামরিক যান ধ্বংস করার দাবি করেছে দেশটি। তবে তাদের দাবিগুলো স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করা যায়নি বলে উল্লেখ করেছে বিবিসি।
তবে এসব ট্যাংক–বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার বিমানবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে পারবে না ইউক্রেন। এর জন্য বিমান–বিধ্বংসী অস্ত্র প্রয়োজন হবে। ৭ এপ্রিল নাগাদ ইউক্রেনকে এ ধরনের প্রায় ২৫ হাজার অস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বহনযোগ্য ও মানুষের কাঁধের ওপর থেকে নিক্ষেপযোগ্য স্টিঙ্গার ব্যবস্থা।
১৯৮১ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় এ ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহার দেখা গেছে আফগানিস্তানে। রাশিয়ার শত শত বিমান ও হেলিকপ্টার ভূপাতিত করতে আফগানিস্তানকে স্টিঙ্গার ব্যবস্থা সরবরাহ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এটি প্রায় ১২ হাজার ৪০০ ফুট ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান ও হেলিকপ্টারকে ভূপাতিত করতে পারে। এর চেয়ে উঁচুতে উড়ে যাওয়া রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিত করতে এটি অকার্যকর। এ ধরনের বিমান ভূপাতিত করার সক্ষমতা অর্জনই এখন ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর অত্যন্ত অগ্রাধিকারের বিষয়। বিশেষ করে, যুদ্ধে নিজেদের কিছু বিমান প্রতিরোধব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর তারা তৎপর হয়ে উঠেছে।
এপ্রিলের মাঝামাঝিতে প্রতিবেশী দেশ স্লোভাকিয়া ইউক্রেনের জন্য সোভিয়েত যুগের এস-৩০০ বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র উঁচুতে উড়ে যাওয়া বিমানে আঘাত করতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক চুক্তির আওতায় এসব ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে স্লোভাকিয়া। চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রকে স্লোভাকিয়ায় একটি বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা-প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র কী পাঠায়নি?
যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে নিজেদের তৈরি ট্যাংক পাঠাতে অনিচ্ছুক। তাদের যুক্তি হলো, ইউক্রেনীয় সেনারা এসব যুদ্ধ যানের সঙ্গে পরিচিত নয়।
১৯ এপ্রিল পেন্টাগনে দেওয়া বক্তব্যে জন কিরবি বলেন, ‘যে ট্যাংকগুলোর ব্যবহার পদ্ধতি তাঁরা (ইউক্রেনীয় সেনারা) জানে সেগুলো আমাদের অস্ত্রাগারে নেই। তবে কয়েকটি দেশ তাদের জন্য কিছু ট্যাংক পাঠিয়েছে, কিছু দেশ খুচরা যন্ত্রাংশ পাঠিয়েছে যেন তারা তাদের নষ্ট হয়ে যাওয়া ট্যাংকগুলোতে আবারও ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে পারে।’
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য ১৬টি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও পাঠায়নি। পোল্যান্ডের মতো অন্য দেশগুলো থেকে ইউক্রেনে সোভিয়েতদের তৈরি মিগ-২৯ যুদ্ধ বিমান পাঠানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলো ইউক্রেনকে খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছে। এতে এখন পর্যন্ত রুশ বিমানবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে পারছে ইউক্রেনীয়রা।
২০ এপ্রিল এক জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, তিন সপ্তাহ আগের তুলনায় এখন ইউক্রেনের কাছে ২০টি বিমান বেশি আছে। মিত্রদের পাঠানো খুচরা যন্ত্রাংশের বদৌলতে তা সম্ভব হয়েছে।
***বিবিসি অবলম্বনে ফাহমিদা আক্তার।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: এপ্রিল ২৩, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,