ইউক্রেন যুদ্ধ ভারতের কাছে উভয় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে গণতন্ত্র ও তার আদর্শ রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তাদের মিত্রশক্তিদের চাপ, অন্যদিকে ভারতের কাছে দীর্ঘদিনের মিত্র রাশিয়ার প্রত্যাশা। এই দুইয়ের মধ্যে কোনো এক পক্ষকে বেছে নেওয়া ভারতের পক্ষে যতটা কঠিন, ঠিক ততটাই কঠিন ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এত দিন ধরে আপাতনিরপেক্ষতা অবলম্বন করে আসা ভারত শেষ পর্যন্ত সেই অবস্থানে অটল থাকতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের ভারত সফর ঘিরে এটাই হয়ে উঠেছে মূল আকর্ষণ।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার কোনো নেতার এটাই প্রথম ভারত সফর।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লাভরভ দিল্লিতে আসেন। শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে তাঁর বৈঠক। প্রায় একই সময়ে ভারতে আসছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস। এই দুই গুরুত্বপূর্ণ সফরের প্রাক্কালে তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী জিনা রাইমন্ডো।
বুধবার ওয়াশিংটনে তিনি বলেন, এটা এমন এক সময়, যখন ইতিহাসের সঠিক পক্ষে অবস্থান করতে হবে। সেই সঠিক পক্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ, যারা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে ইউক্রেনের জনসাধারণের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের আগ্রাসী মনোভাবের বিরোধিতা করছে।
জিনা রাইমন্ডোর সঙ্গে একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী ড্যান টেহান। তিনিও বলেন, আইনের শাসন রক্ষায় গণতান্ত্রিক দেশগুলোর একজোট হয়ে কাজ করা জরুরি।
যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সঙ্গে ভারতও ‘কোয়াড’ অক্ষের অংশীদার। ভারত ছাড়া বাকি তিন দেশই ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ। একমাত্র ভারত নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে চলছে। লাভরভের এই সফরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষাসংক্রান্ত এক প্রস্তাব বিবেচিত হওয়ার কথা।
ভারত ইতিমধ্যেই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সস্তায় রাশিয়া থেকে তেল কেনার চুক্তি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এই সময়ে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করার অর্থ যুদ্ধবাজ রাশিয়াকে সাহায্য করা।
লাভরভের সফরের প্রায় একই সময়ে দিল্লিতে এসে লিজ ট্রাস রাশিয়ার বিরোধিতার জন্য ভারতকে চাপ দেবেন। তিনি কী বলবেন, তার একটা ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে দেওয়া হয়েছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় ট্রাস বলবেন, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বুঝিয়ে দিচ্ছে আগ্রাসন রুখতে ও বিশ্বের নিরাপত্তার স্বার্থে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কতটা জোটবদ্ধ হওয়া জরুরি। ট্রাস ওই বিবৃতিতে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে প্ররোচনাহীন বলেছেন।
বস্তুত, ইউক্রেন নিয়ে ভারতের এই মুহূর্তের অবস্থান ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’র মতো।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে চীনের প্রভাব খর্ব ভারতের জন্য যতটা জরুরি, ততটাই প্রয়োজনীয় রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা বজায় রাখা। বৈশ্বিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ঠেকাতে চীন ও রাশিয়ার কাছাকাছি আসাও ভারতের কাছে উদ্বেগজনক। রাশিয়া-ভারত বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। সেই সোভিয়েত আমল থেকে রুশ-ভারত মৈত্রী সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ভূমিকাও অনন্য। ভারতের প্রতিরক্ষাসম্ভারের ৭০ শতাংশ রাশিয়ানির্ভর।
স্বাভাবিক স্বার্থজনিত কারণেই ভারত এই সংকটে রাশিয়ার সরাসরি বিরোধিতা করতে চায় না। সেই কারণে জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা কোনো প্রস্তাবেই ভারত পক্ষ নেয়নি। ভোটদানে বিরত থেকেছে। যুদ্ধ বন্ধ রেখে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মধ্য দিয়ে মীমাংসার কথা বলে আসছে। ভারতের এই মনোভাব মেনে নিতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য গণতান্ত্রিক মিত্রশক্তি। প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজেই ভারতীয় অবস্থানকে ‘নড়বড়ে’ বলে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
ভারতকে চাপ দিয়েছেন জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীরাও। এই পরিস্থিতিতে লাভরভ ও ট্রাসের সফর কূটনীতির সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি ঘিরে আগ্রহের জন্ম দিয়েছে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মার্চ ৩১, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,