ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পরই নতুন করে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কোপে পড়েছে রাশিয়া। সে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি আর্থিক সংস্থা, শিল্পপতি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে বিধিনিষেধ জারি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তবে পৃথিবী এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের কবলে নেই—আর্থিক ব্যবস্থাও এখন আর নিছক ডলার ও সুইফট-নির্ভর নয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রবর্তিত ডিজিটাল মুদ্রার কল্যাণে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবস্থা পাশ কাটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপানসহ একাধিক দেশ ইউক্রেন সংকটের জেরে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। রাশিয়ার বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পপতির সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয়েছে। এমনকি কয়েকটি দেশ রাশিয়ান পর্যটকদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু তাতে প্রাথমিকভাবে কিছুটা অসুবিধায় পড়লেও বিটকয়েনকে হাতিয়ার করে রাশিয়ার নাগরিকদের অনেকেই সেই নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সক্ষম হবেন বলে মনে করছে ডিজিটাল মুদ্রা বিশারদদের একাংশ। আবার এই সুযোগে চীনা লেনদেনব্যবস্থা সিআইপিএস ও তাদের ডিজিটাল ইউয়ান বিকল্প মুদ্রা হয়ে উঠতে পারে—এমন সম্ভাবনাও প্রবল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
ডিজিটাল মুদ্রা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইতিমধ্যে রাশিয়ার নাগরিকদের মধ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের প্রবণতা বেড়েছে, ভবিষ্যতের ঝুঁকি এড়াতে তাঁরা বিটকয়েনের ওপর নির্ভর করছেন। যুক্তরাষ্ট্র এই সমস্যা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত। কয়েক মাস আগে সেই দেশের অর্থ দপ্তরের এক সতর্কবার্তায় বলা হয়েছিল, ডিজিটাল মুদ্রা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা হ্রাস করছে। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে প্রথাগত আর্থিক ব্যবস্থার বাইরে তহবিল সঞ্চয় ও স্থানান্তর করতে না পারে, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপের কথাও বলা হয়েছিল ওই সতর্কবার্তায়।
সুইফট থেকে বাদ পড়া
ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন শুরুর পর এই যুদ্ধের অর্থনৈতিক ফ্রন্টের সবচেয়ে বড় খবর হলো, রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থা সুইফট থেকে বাদ দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন জানান, কয়েকটি রুশ ব্যাংককে সুইফট থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর ফলে ওই ব্যাংকগুলো গোটা বিশ্বে আর কাজ করতে পারবে না। ধাক্কা খাবে রাশিয়ার আমদানি-রপ্তানি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন উরসুলা। সেই সঙ্গে রুশ ধনকুবেরদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক বাজারের সম্পদ ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
‘দ্য সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন’ বা সুইফটের যাত্রা শুরু ১৯৭৩ সালে। সদর বেলজিয়ামে। বর্তমানে ২০০টি দেশের ১১ হাজার আর্থিক প্রতিষ্ঠান সুইফটের মাধ্যমে লেনদেন করে। ২০২১ সালে দিনে গড়ে প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ বার্তা আদান-প্রদান হয়েছে সুইফটের মাধ্যমে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রুশ গ্যাস ও তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। সুইফটের মাধ্যমেই তারা রুশ কোম্পানিগুলোর পাওনা মেটায়। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেকেই রাশিয়াকে সুইফট থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করার দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও বড় বাণিজ্যিক ক্ষতি হতে পারে।
সুইফটের সদর দপ্তর ব্রাসেলসে, কিন্তু তার তথ্যভান্ডার যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায়। ফলে বিশ্বের প্রায় সব আর্থিক লেনদেন নজরদারি করার সুযোগ পায় তারা। এটাই তার হাতের তুরুপের তাস।
সুইফটের পাশাপাশি তারা হাতে থাকা আরও দুটি তুরুপের তাস হচ্ছে ডলার ও চিপস-ক্লিয়ারিং হাউস ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম। এটি বিশ্বের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্যিক ক্লাবের মতো, সদস্যসংখ্যা ৪৩। এর মাধ্যমে লেনদেন করতে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভে হিসাব খুলে আগে থেকে অর্থ রাখতে হয়। চিপসের মাধ্যমে দিনে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার লেনদেন হয়। এর সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে কার্যালয় খুলতে হয়। আর সবকিছু পরিচালিত হয় মার্কিন আইন অনুসারে। ফলে তারা যখন-তখন যাকে-তাকে ধরতে পারে। ফলে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও যারা তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন করেছে, তাদের কাছ থেকে গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্র ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার জরিমানা আদায় করেছে।
চীনের উত্থান
চিপসের এই ব্যবহার চীনের নজর এড়িয়ে যায়নি। সে জন্য তারা ক্রস বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম (সিআইপিএস) গড়ে তুলেছে। এখন রাশিয়ার ব্যাংকগুলোও সিআইপিএসকে সুইফট ও চিপসের বাস্তবসম্মত বিকল্প হিসেবে ভাবছে। সিআইপিএসের গুরুত্ব বৃদ্ধির ঘটনায় ধারণা করা যায়, আন্তর্জাতিকভাবে ডলারের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার রুবলের চেয়ে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
তবে সুইফটের বিকল্প হিসেবে গ্রহণযোগ্য স্থান দখল করতে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে সিআইপিএসকে। আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের ব্যবহার ২ শতাংশের কম, মার্কিন ডলারের ব্যবহার ৪০ শতাংশ। এমনকি ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড কিংবা জাপানি মুদ্রা ইয়েনের তুলনায়ও পিছিয়ে আছে ইউয়ান।
তবে বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, কম ব্যবহার সত্ত্বেও বর্তমান পরিস্থিতিতে সুইফটের আঞ্চলিক বিকল্প হয়ে উঠতে পারে সিআইপিএস। যেমন ইউরেশিয়া অঞ্চলে এর একক ব্যবহার শুরু হতে পারে। এ ছাড়া সিআইপিএসের ওপর রাশিয়ার নির্ভরতা বাড়ছে। সম্প্রতি রাশিয়ার ২৩টি ব্যাংক সিআইপিএস ব্যবস্থায় যোগ দিয়েছে—বিপরীতে কেবল ব্যাংক অব চায়না রাশিয়ার এসপিএফএস ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে। তাই বড় প্রশ্ন হচ্ছে, সুইফটের বিকল্প হতে চীন কি রাশিয়ার এসপিএফএসকে সঙ্গে নিয়ে এগোবে, নাকি নিজেরাই এককভাবে সিআইপিএসের প্রসার ঘটাতে চাইবে।
ডিজিটাল মুদ্রা
ডিজিটাল মুদ্রা ইন্টারনেটভিত্তিক মুদ্রা, যার সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো বিটকয়েন। তবে এটি বেসরকারি। সরকারি ডিজিটাল মুদ্রাও আছে পৃথিবীতে, যেমন ডিজিটাল ইউয়ান। এই ডিজিটাল ইউয়ানের জোরে চীন আন্তর্জাতিক লেনদেনে সুইফটের বিকল্প হিসেবে সিআইপিএসকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে পারে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
ডিজিটাল মুদ্রার যুগে গ্রাহককে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে হিসাব খুলতে হবে না, বরং তাঁরা সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করবেন। মাঝখানে থাকবে আলি পে বা ভেনমোর মতো অ্যাপ। চেক লেখা বা অনলাইনে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে অর্থ পরিশোধ করার বদলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরবরাহ করা ডিজিটাল মুদ্রায় সরাসরি লেনদেন হবে তখন। ফলে তখন আর সুইফটের প্রয়োজন হবে না।
তবে এই উত্তরণ অত সহজ হবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা–বাণিজ্য করতে হবে রাশিয়া ও চীনের মতো দেশকে। তাই পশ্চিমাদের শর্ত মানতে হবে তাদের। ফলে পৃথিবী একমেরু বা দ্বিমেরু ব্যবস্থা থেকে বহুমেরু ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা, যেখানে সুইফটের সঙ্গে সিআইপিএসের নামও উচ্চারিত হবে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ মার্চ ০৫, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,