ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে বিশ্ব অর্থনীতি অস্থিতিশীল হবে—এ কথা সবাই বলছেন। এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে অন্যান্য যুদ্ধের সময় যেভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলো কোনো এক পক্ষের হয়ে যুদ্ধে জড়ায়, এবার সে রকম দেখা যাচ্ছে না। তারা বরং আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ রাশিয়ার সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে পশ্চিমা শক্তিগুলো আর্থিক হাতিয়ার দিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছে।
তবে সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে আবার অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ফলে এ বছর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ব্যাহত হবে বলেই ধারণা করছেন বিশ্লেষকেরা।
এবারের নিষেধাজ্ঞার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইউরোপ রাশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি জ্বালানিতে নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কারণটা খুব পরিষ্কার, রাশিয়ার গ্যাস না পেলে ইউরোপের শীতপ্রধান দেশগুলো বিপদে পড়বে। এই গ্যাস দিয়ে যে তাদের ঘরবাড়ি গরম করতে হয়। শিল্পকারখানাও চলে এই গ্যাস দিয়ে। তবে যুদ্ধের কারণে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় ইতিমধ্যে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ১১৩ ডলারে উঠে গেছে।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনকে শক্তিশালী করতে সব রকমের সাহায্য করবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে কোনোরকম প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়াবে না তারা। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের জোটসঙ্গীরা অন্য ন্যাটো দেশগুলোকে বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সব সময় তৎপর থাকবে বলেও তিনি জানান। ইতিমধ্যে তারা আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
যুদ্ধ শুরুর পরপরই রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের ‘সুইফট’ ব্যবস্থা থেকে বাদ দেওয়া হবে বলে জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেন, কয়েকটি রুশ ব্যাংককে সুইফট থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর ফলে ওই ব্যাংকগুলো গোটা বিশ্বে আর কাজ করতে পারবে না। ধাক্কা খাবে রাশিয়ার আমদানি-রপ্তানি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন উরসুলা। সেই সঙ্গে রুশ ধনকুবেরদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক বাজারের সম্পদ ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
কয়েকটি রুশ ব্যাংককে সুইফট থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর ফলে ওই ব্যাংকগুলো গোটা বিশ্বে আর কাজ করতে পারবে না। ধাক্কা খাবে রাশিয়ার আমদানি-রপ্তানি।
উরসুলা ভন ডার লিয়েন প্রেসিডেন্ট, ইউরোপীয় ইউনিয়ন
এরপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আসতে থাকে। সব রুশ বাণিজ্যিক বিমানের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করেছে বেলজিয়াম। পাল্টা স্লোভেনিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়ার বিমানের জন্য বন্ধ হয়েছে রুশ আকাশসীমা। এরপর ভিসা ও মাস্টারকার্ড বলেছে, রাশিয়ায় তাদের সেবা বন্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া মার্কিন কোম্পানি অ্যাপল ও নাইকিও রাশিয়ায় সেবা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে।
এসবের প্রভাব ইতিমধ্যে অনুভূত হতে শুরু করেছে। রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মান ৩০ শতাংশ পড়ে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার এক লাফে দ্বিগুণ করেছে।
তবে তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের তেল উৎপাদনকারীদের পোয়াবারো। তারা কিছুদিন চুটিয়ে ব্যবসা করতে পারবে। এর মধ্যে ইরানের আবারও মাঠে ফেরত আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা মনে করছেন, তেলের সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় এখন ইরান আবারও তেলের বাজারে ঢুকতে পারে। এই সুযোগে দেশটির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
ফলে গণপরিসরে এখন আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে, সুইফট কি নতুন যুগের পারমাণবিক বোমা। বিষয়টি অনেকটা এ রকম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে সুইফটের জোর বেশি, নাকি অস্ত্রের জোর বেশি—আগামী কয়েক দিনে বিশ্ববাসী সেটাই দেখার অপেক্ষায়।
রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা
সোভিয়েত ইউনিয়ন যত দিন ছিল, তত দিন বিশ্ব রাজনীতি-অর্থনীতিতে তারা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ। ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। কিন্তু এখনো রাশিয়া ভূরাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে গত ৩০ বছরে তার অর্থনৈতিক শক্তি কমেছে। তেল-গ্যাসের বাজারে তারা বড় খেলোয়াড়, কিন্তু সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে তারা এখন মধ্যম মানের শক্তি। এখন তারা বিশ্বের একাদশ বৃহত্তম অর্থনীতি। জিডিপির আকার দেড় ট্রিলিয়ন (এক ট্রিলিয়নে এক লাখ কোটি) ডলারের কম। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ১৪ ভাগের ১ ভাগ তারা।
তবে রাশিয়ার জনসংখ্যা ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো কম নয়। সাড়ে ১৪ কোটি জনসংখ্যার দেশ রাশিয়া সেই অর্থে তুলনামূলকভাবে দরিদ্র। মাথাপিছু জিডিপির নিরিখে বিশ্বের অন্তত ২৪টি দেশ রাশিয়ার আগে। এমনকি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও চেক রিপাবলিকের মতো দেশও এখন মাথাপিছু জিডিপিতে রাশিয়ার চেয়ে এগিয়ে।
রুশ ধনকুবেরের বিলাসবহুল প্রমোদতরি জার্মানিতে জব্দ
জার্মান কর্তৃপক্ষ ৬০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি বিলাসবহুল প্রমোদতরি (সুপার ইয়ট) জব্দ করেছে। জার্মানির হামবুর্গ শহরের শিপইয়ার্ড থেকে প্রমোদতরিটি জব্দ করা হয়। এটির মালিক রাশিয়ান ধনকুবের আলিশার উসমানোভ। উসমানোভ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। খবর দ্য গার্ডিয়ান অনলাইনের।
ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেসব রুশ ধনকুবেরের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাঁদেরই একজন উসমানোভ।
প্রমোদতরি নির্মাণশিল্পের তিনটি সূত্রের বরাতে মার্কিন সাময়িকী ‘ফোর্বস’ জানিয়েছে, দিলবার নামের আলিশার উসমানোভের ১৫৬ মিটার, অর্থাৎ ৫১২ ফুট লম্বা ওই প্রমোদতরির মূল্য ৬০ কোটি ডলার। ওজনের দিক থেকে এটি বিশ্বের বৃহত্তম মোটর ইয়ট হিসেবে বিবেচিত। বুধবার জার্মান কর্তৃপক্ষ প্রমোদতরিটি জব্দ করেছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ নিয়ে জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সাড়া পায়নি। উসমানোভের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও যোগাযোগ করে সাড়া পায়নি ‘ফোর্বস’।
২০১৬ সালে জার্মানির জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লুসেনের কাছ থেকে দিলবার নামের প্রমোদতরিটি কেনেন উসমানোভ। এটির ওজন ১৫ হাজার ৯১৭ টন।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ মার্চ ০৩, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,