লেখক:মাসুদ মিলাদ।
চট্টগ্রাম-ইতালি সরাসরি জাহাজ সেবা চালু হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীদের খরচ কমবে ৩০ শতাংশ ও সময় বাঁচবে এক থেকে দুই সপ্তাহ।
চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর বা শ্রীলঙ্কার বন্দর ঘুরে ইতালিতে যেতে স্বাভাবিকভাবে সময় লাগে ২৪ থেকে ২৮ দিন। এখন সিঙ্গাপুর বা শ্রীলঙ্কায় বড় জাহাজে বুকিং পেতে দেরি হওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই সময় লাগছে ৩০ থেকে ৩৫ দিনের বেশি। তবে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে পণ্য রপ্তানির এই সময় কমিয়ে দিচ্ছে চট্টগ্রাম-ইতালি সরাসরি জাহাজ সেবা। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নেতারা বলছেন, এখন ভিয়েতনামের চেয়ে অন্তত এক-দুই সপ্তাহের কম সময়ে ইতালির বন্দরে রপ্তানি পণ্য পাঠাতে পারবেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা।
শুধু সস্তা শ্রম দিয়ে এত দিন বাংলাদেশপোশাক খাতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে ছিল। বিদেশি ক্রেতাদের হাতে পণ্য তুলে দিতে প্রতিযোগী দেশের চেয়ে পিছিয়েই ছিল বাংলাদেশ। এর কারণ, বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নেই। তাতে বড় জাহাজ চলাচল করতে না পারায় লম্বা দূরত্বে সরাসরি জাহাজ সেবা ছিল না। তবে করোনার সময় ভাড়া অস্বাভাবিক বাড়ায় এবং পণ্য পরিবহনে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় ছোট জাহাজ দিয়েই সরাসরি কনটেইনার পরিবহনসেবা চালু করেছে একটি প্রতিষ্ঠান। তাতে ইউরোপের ক্রেতাদের হাতে কম সময়ে পণ্য হাতে তুলে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
গত ২৩ ডিসেম্বর প্রথমবার পরীক্ষামূলকভাবে ইতালি থেকে চট্টগ্রামে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়। প্রথম যাত্রায় ইতালি থেকে শুধু খালি কনটেইনার আনা হয়েছিল। পরীক্ষামূলক চলাচল সফল হওয়ায় এবার শুরু হচ্ছে রপ্তানি পণ্য পরিবহন। এ জন্য ইতালি থেকে ছেড়ে আসা ‘এমভি সোঙ্গা চিতা’ নামের আরেকটি জাহাজ ১৬ দিন পর আগামীকাল শনিবার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। জাহাজটি চট্টগ্রাম থেকে ৯৮৩ একক কনটেইনার পণ্য নিয়ে যাবে ইতালিতে। এসব কনটেইনারের ৯৯ শতাংশই পোশাকশিল্পের। ইতালির পাশাপাশি জার্মানিরও কিছু পণ্য রয়েছে, যেগুলো সড়কপথে নেওয়া হবে।
কম সময়, কম খরচ
চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর বা কলম্বো হয়ে ইউরোপে ৪০ ফুট লম্বা কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া ১৪ থেকে ১৫ হাজার ডলারে ওঠানামা করছে। নতুন চালু হওয়া সরাসরি জাহাজ সেবায় এই দর চাওয়া হচ্ছে ১০ হাজার ডলার। এ ক্ষেত্রে সরাসরি জাহাজ সেবায় আগের তুলনায় খরচ কমবে প্রায় ৩০ শতাংশ। আবার সরাসরি জাহাজ সেবায় আগের তুলনায় এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় কম লাগবে। পণ্য হাতে পেতে বিদেশি ক্রেতাদের অনিশ্চয়তাও কাটবে।
বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানি পণ্য কম সময়ে বিদেশি ক্রেতাদের হাতে তুলে দেওয়াটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের। সরাসরি জাহাজ সেবা চালু হওয়ায় আমরা ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগী দেশের চেয়ে এক-দুই সপ্তাহ আগে ক্রেতাদের হাতে পণ্য তুলে দিতে পারব। তবে সরাসরি জাহাজ সেবায় প্রতি সপ্তাহে অন্তত তিনটি জাহাজ থাকতে হবে। না হলে পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে না।’
সরাসরি জাহাজ চালুর নেপথ্যে
করোনার প্রভাবে গত বছর থেকে বিশ্বজুড়ে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া বাড়তে থাকে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ভাড়া ৫ থেকে ১০ গুণ বেড়ে যায়। আবার সংকটের কারণে জাহাজে কনটেইনার পরিবহনের নিশ্চয়তাও পাওয়া যাচ্ছিল না। এটি বড় উদ্বেগ তৈরি করে বিদেশি ক্রেতাদের।
কারণ, বিদেশি ক্রেতাদের প্রতিনিধি ফ্রেট ফরোয়ার্ডাররা বাংলাদেশে বেসরকারি ডিপোগুলোতে পণ্য বুঝে নেয়। এরপর বিদেশি ক্রেতাদের খরচেই নেওয়া হয় নিজ দেশে। চট্টগ্রামে পণ্য বুঝে নিলেও তা পরিবহনে যেমন খরচ বেশি হচ্ছিল, তেমনি সময়মতো পণ্য হাতে পাচ্ছিল না তারা।
এমন পরিস্থিতিতে ইতালির ফ্রেট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠান আরআইএফ লাইন এবং এটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ক্যালিপসো কোম্পানিয়া ডি নেভিগেশন নতুন এই সেবা চালু করেছে। মূলত ইতালির ক্রেতাদের সহযোগিতায় ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠানটি চালু করেছে এই সেবা।
গত বছরের সংকটকালে বিজিএমইএর সঙ্গে এক সভায় চট্টগ্রাম থেকে ইউরোপে সরাসরি জাহাজ সেবা চালুর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এটা সুখবর যে শেষ পর্যন্ত বিদেশি ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠান উদ্যোগী হয়ে এটা বাস্তবায়ন করেছে।’
কত দিন টিকবে
সমুদ্রপথে ভাড়া অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এখন ছোট জাহাজে সরাসরি ইতালিতে কনটেইনার পণ্য পরিবহন করেও লাভজনক দেখছে জাহাজ পরিচালনাকারীরা। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনভাড়া কমে আগের মতো কনটেইনারপ্রতি (৪০ ফুট লম্বা) আড়াই থেকে তিন হাজার ডলারে নেমে এলে এই উদ্যোগ না-ও টিকতে পারে। তবে সমুদ্রপথের ভাড়া সহসাই স্বাভাবিক হচ্ছে না, সে সম্পর্কে আভাস দিয়েছে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন সেবা ধরে রাখতে হলে জাহাজের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আরও বড় জাহাজ নামাতে হবে। নতুন রুট জনপ্রিয়তা পেলে অনেক শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে আসতে পারে।
নতুন সেবার বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধি রিলায়েন্স শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রাশেদ প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত দুটি জাহাজ দিয়ে এই সেবা চালু হলেও পর্যায়ক্রমে জাহাজের সংখ্যা বাড়তে পারে।
তবু সম্ভাবনা
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যের শীর্ষ সপ্তম গন্তব্য ইতালি। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি হয় ১৩০ কোটি ডলার পণ্য, যার ৯৫ শতাংশই পোশাক। একই সময়ে ইতালি থেকে আমদানি হয় ৪৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের পণ্য, যার অর্ধেকই মূলধনি যন্ত্রপাতি।
বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানির ৪৫ শতাংশই রপ্তানি হয় ইতালির মতো ইউরোপের ২৭টি দেশে। গত অর্থবছরে রপ্তানি পণ্যের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৪৬ ডলার। বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া মোট ৭ লাখ ২৯ হাজার একক কনটেইনারের মধ্যে ৩ লাখ কনটেইনারই নেওয়া হয়েছে ইউরোপে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে সরাসরি বড় জাহাজে ইউরোপ-আমেরিকায় কনটেইনার পরিবহন সম্ভব হবে। সে জন্য চার থেকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের আগে ফিডার জাহাজে সরাসরি কনটেইনার পরিবহনসেবা চালু রাখা গেলে প্রতিযোগিতায় এক পা এগিয়ে থাকবে বাংলাদেশ।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ০৪, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,