লেখক:ফখরুল ইসলাম।
লন্ডন ইন্টারব্যাংক অফারড রেট বা লন্ডন আন্তব্যাংক সুদের হার (লাইবর) চূড়ান্তভাবে উঠে যাচ্ছে। আগামী বছরের জুন থেকে এই প্রথা আর থাকবে না। সে জন্য লাইবর–পরবর্তী সময়ের করণীয় নির্ধারণে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ কাজ শুরু করে দিলেও বাংলাদেশে এখনো এ ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
বিশ্বের প্রায় সব দেশ ১৯৭০ সাল থেকে লাইবর প্রথা অনুসরণ করে, অর্থাৎ এটির সঙ্গে সমন্বয় রেখে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া–নেওয়া করে আসছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বাংলাদেশও দীর্ঘ মেয়াদে লাইবরযুক্ত ঋণ নিয়ে রেখেছে।
লন্ডনের এক ব্যাংক আরেক ব্যাংককে যে সুদহারে ঋণ দেয়, সেটাই হচ্ছে লাইবর। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় বড় আকারের ঋণ দেওয়া–নেওয়ার ক্ষেত্রে লাইবর প্রথা অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত।
এদিকে লাইবর উঠে যাওয়ার পর বিকল্প ব্যবস্থা কী এবং সুদের হারের সমন্বয়ই–বা হবে কীভাবে, তা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এখনো মাথা ঘামাচ্ছে না। অথচ বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সাত মাস আগেই এ ব্যাপারে ইআরডিকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। অর্থ বিভাগ ২০২১ সালের ২ জুন ইআরডিকে চিঠি দিয়ে লাইবর উঠে যাওয়ার আগের ও পরের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত
ও প্রস্তাব দিতে বলেছিল। কিন্তু ইআরডি বিষয়টিকে হালকাভাবে নিয়েছে বলে মনে করেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
বিজ্ঞাপন
লাইবরের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি), এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি)—এসব আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। এর বাইরে অবশ্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় রাশিয়া, ভারত, কোরিয়া প্রভৃতি দেশ থেকেও বাংলাদেশ ঋণ নিয়েছে।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে বাংলাদেশকে মোট ১ হাজার ১৩৮ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। এ ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বর্তমানে পাইপলাইনে রয়েছে ৫০ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৩৬ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশের প্রায় ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ধরে)। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ঋণ নিয়েছে ১ হাজার ১৩ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। প্রসঙ্গত, ১ বিলিয়ন মানে ১০০ কোটি।
যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল কনডাক্ট অথরিটি (এফসিএ) ২০১৭ সালে লাইবর প্রথা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ২০২১ সালের ২২ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে বিকল্প সুদহার ঘোষণা করে। স্বল্পমেয়াদি ঋণের সুদ হার ঋণদাতা দেশগুলোর সুদের হারের সঙ্গে আরও ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি ঋণের সুদের হার নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এখনো কিছুই করেনি।
সোফর, সোনিয়া নাকি টোনা
২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময় আইন লঙ্ঘন করে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সেই দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কারসাজির মাধ্যমে লাইবর কমাতে বারবার চাপ দেয়। এই ঘটনা পরে ফাঁস হয়ে যায়। ফলে ঘটনাটির জেরে ২০১২ সালে চাকরি চলে যায় যুক্তরাজ্যের বার্কলেজ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বব ডায়মন্ডের। এ ঘটনা বিশ্বব্যাপী লাইবর কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিত। এর পর থেকে লাইবর থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলতে থাকে। একপর্যায়ে ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফসিএ লাইবর প্রথা বাতিল ঘোষণা করে।
লাইবরের বিকল্প কী—এ চিন্তা মাথায় নিয়ে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ও নিউইয়র্ক ফেডখ্যাত ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক যৌথভাবে বিশ্বখ্যাত বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে ২০১৪ সালে গঠন করে অল্টারনেট রেফারেন্স রেটস কমিটি (এআরআরসি)। এআরআরসি সিদ্ধান্ত নেয় যে লাইবরের একটি ভালো বিকল্প হতে পারে সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট (সোফর)। এটি হতে হবে মার্কিন ডলারভিত্তিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে। ফোরামটি ২০১৮ সালে এর কার্যক্রম বাড়ায় এবং সোফর কার্যকরে দৃঢ় হয় ২০২১ সালে এসে।
গত বছরের ২২ জুলাই বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকদের পর্ষদ লাইবরের পরিবর্তে সোফরের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়। ইংল্যান্ডও আরেকটি বিকল্প ব্যবস্থা দাঁড় করায়, যার নাম স্টার্লিং ওভারনাইট ইনডেক্স এভারেজ (সোনিয়া)। এটি হবে পাউন্ডভিত্তিক (জিবিপি) ঋণের ক্ষেত্রে। এদিকে বসে থাকেনি জাপানও। এশীয় দেশটি দাঁড় করায় টোকিও ওভারনাইট এভারেজ রেট (টোনা)। এটি হবে সেই দেশের মুদ্রা ইয়েনভিত্তিক। বিশ্বব্যাংক এগুলোর ব্যাপারেও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়।
অর্থ বিভাগ কী বলেছিল
অর্থ বিভাগ গত বছরের ২ জুন ইআরডিকে দেওয়া চিঠিতে বলেছে, সব বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রেই এআরআরসির সুপারিশ অনুসরণ করতে হবে। এ জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও অন্যান্য বিকল্প উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সোফরের ব্যাপারে ইআরডি কী ভাবছে এবং আগে নেওয়া ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার নিয়েই–বা কী চিন্তা করছে, সেটিও চিঠিতে জানতে চেয়েছে অর্থ বিভাগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, লাইবরের পরিবর্তে সোফর হলেও সুদের অঙ্ক প্রায় একই থাকবে।
ইআরডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লাইবরে খুব বেশি ঋণ নেওয়া নেই বাংলাদেশের। এটা বড়জোর মোট বিদেশি ঋণের ১৫ শতাংশ। ফলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
তবে ইআরডির সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনকে এ নিয়ে বেশ কয়েকবার ফোন ও বার্তা দেওয়া হলেও তিনি জবাব দেননি।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ জানুয়ারী ২২, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,