লেখক:আহমেদ দীপ্ত।
শজনেগাছের পাতাকে বলা হয় অলৌকিক পাতা। এর ফল সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। আর পাতা খাওয়া হয় নানাভাবে। কেউ খায় ভর্তা, কেউ খায় বড়া বানিয়ে আবার কেউ খায় শাক হিসেবে। এবার এই শজনেপাতার পুষ্টিকর গুঁড়া তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) বিজ্ঞানীরা।
পুষ্টিবিদেরা বলছেন, শজনেপাতার গুঁড়া পুষ্টির আধার। এতে ভিটামিন এ, সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, প্রোটিন, জিংকসহ অসংখ্য উপকারী উপাদান আছে। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ডায়বেটিস, হৃদ্রোগ নিয়ন্ত্রণে এবং কিডনি, যকৃৎ ভালো রাখতে শজনেপাতা বেশ উপকারী।
বিসিএসআইআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রেজাউল করিম, জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রকিবুল হাসান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দেবব্রত কর্মকার গবেষণাটি করেন। গবেষণাটি প্রবন্ধ আকারে গত বছরের আগস্টে একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। আরও একটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে এটি প্রকাশের অপেক্ষায়।
ইতিমধ্যেই শজনেপাতা গুঁড়া করার পদ্ধতি লিজ নিয়েছে দেশের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ইনস্ট্যান্ট ড্রিংক পাউডার ও ট্যাবলেট আকারে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে। চলতি বছরেই শজনেপাতার গুঁড়া বাজারে পাওয়ার কথা রয়েছে।
শজনেপাতা প্রোটিনের খুব ভালো উৎস। বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীরা জানালেন, তাঁদের পদ্ধতিতে উৎপাদিত শজনেপাতার গুঁড়াতে ২৭ শতাংশ প্রোটিন, ৩৮ শতাংশ শর্করা, ১৯ শতাংশ ফাইবারের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এ ছাড়া ২ শতাংশ চর্বি, ৯ ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন (প্রতি ১০০ গ্রামে ৫০ হাজার ২৬৯ মাইক্রোগ্রাম) পাওয়া যায়। বিটা ক্যারোটিন হচ্ছে একধরনের রঞ্জক পদার্থ, যা শাকসবজিতে উপস্থিত থেকে লাল, হলুদ ও কমলা রং দেয়। মানবদেহে এটিকে রেটিনলে (ভিটামিন এ) রূপান্তরিত করে।
তিন বছর আগে বিসিএসআইআরের অধীনস্থ ইনস্টিটিউট অব ট্রান্সফার অ্যান্ড ইনোভেশনের (আইটিটিআই) বিজ্ঞানীরা শজনেপাতা নিয়ে কাজ শুরু করেন। কীভাবে এ পাতা থেকে পুষ্টিকর গুঁড়া বানানো যায়, সে জন্য গবেষণাটি চলতে থাকে। ২০২০ গবেষণাটি শেষ হয়। গত বছরের ২৪ জানুয়ারি গুঁড়া বানানোর প্রক্রিয়াটি বিসিএসআইআর কর্তৃক গৃহীত হয়। মার্চে এ গবেষণার ফলাফল নিয়ে হিনদওয়াই পিয়ার রিভিউ সাময়িকী ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফুড সায়েন্সে পাঠানো হয়। গবেষণাটি প্রবন্ধ আকারে গত বছরের ১১ আগস্ট প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া এই গবেষণা সায়েন্স ওয়েবের জার্নাল অব অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ক্রপ রিসার্চে প্রকাশিত হয় ৩০ আগস্ট।
শজনেগুঁড়ার প্রস্তুত প্রণালি
বিজ্ঞানীরা জানালেন, তাঁরা প্রথমে বিসিএসআইআরের প্রাঙ্গণ ও বিভিন্ন জায়গা থেকে শজনের কচি পাতা সংগ্রহ করেন। এরপর এটিকে পরিষ্কার করে ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা, ৩৫ শতাংশ আর্দ্রতা এবং বাতাসের প্রবাহের সাহায্যে গুঁড়া প্রস্তুত করা হয়। অ্যামিনো অ্যাসিড অ্যানালাইজার, প্রোটিন অ্যানালাইজার এবং গ্যাস ক্রমোটোগ্রাফি যন্ত্রের সাহায্যে এর পুষ্টিগুণ বজায় আছে কি না, তা দেখা হয়। এক দিনেই তৈরি হয় (মেকানিক্যালি ড্রাইড) শজনেপাতার গুঁড়া। এর নাম দেওয়া হয়েছে, ‘কমপ্লিট গ্রিন সুপার ফুড’।
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, শজনের প্রতি ১০০ গ্রামের কাঁচা পাতায় প্রোটিনের পরিমাণ থাকে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। আর একই পরিমাণ শুকনা পাতার গুঁড়াতে প্রোটিনের পরিমাণ বেড়ে হয় ২৭ দশমিক ১ শতাংশ। একইভাবে প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা শজনেপাতায় কার্বোহাইড্রেট থাকে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, যা তিন গুণ বাড়ে এবং ফাইবার থাকে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ, যা বাড়ে ২১ গুণ।
স্পিরুলিনার বিকল্প শজনেগুঁড়া
গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী বিসিএসআইআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, এ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হওয়া গুঁড়াতে কাঁচা পাতার প্রায় সব গুণাগুণ অক্ষুণ্ন থাকে। সঠিকভাবে মোড়কজাত ও সংরক্ষণ করা হলে এই শজনে গুঁড়া ছয় মাস পর্যন্ত ভালো থাকে। শক্তিবর্ধক বলে স্পিরুলিনার বিকল্প হিসেবে শজনেগুঁড়াকে ভাবা হচ্ছে। গবেষণাটি আরও একটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে বলে জানান তিনি।
বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান মো. আফতাব আলী শেখ প্রথম আলোকে বলেন, শজনে খুব দামি, তবে এ দেশে এটি অবহেলিত উদ্ভিদ। যেকোনো মাটিতে এটি ফলে। প্রোটিন, আমিষ, কার্বোহাইড্রেটসহ অসংখ্য পুষ্টিগুণের বিবেচনায় এ পাতা থেকে গুঁড়া বানানোর উদ্যোগটি নেওয়া হয়। তিনি বলেন, বেসরকারি উদ্যোক্তারা এটি লিজ নিয়ে উৎপাদন করতে পারে। তাতে মানুষের পুষ্টিও নিশ্চিত হবে। আবার ব্যবসাও হবে।
বাজারে আসতে পারে ট্যাবলেট আকারে
বিসিএসআইআর গত ৭ জুন শজনেপাতার গুঁড়ার এ পদ্ধতি একটি চুক্তির মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পূর্নাভা লিমিটেডকে ইজারা দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা আয় করেছে। প্রতিষ্ঠানটির রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগের প্রধান রিজভিক রিন্নাত জানিয়েছেন, শজনেপাতা গুঁড়া করে তা থেকে ট্যাবলেট ও ইনস্ট্যান্ট ড্রিংক পাউডার বানানোর উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা নিয়েছেন তাঁরা। ময়মনসিংহের ভালুকায় কারখানা স্থাপিত হবে। বাণিজ্যিকভাবে এই পণ্য বাজারে ছাড়া হবে।
শজনেপাতা সুপার ফুড
শজনেগুঁড়া তৈরির নতুন এ পদ্ধতি পেটেন্ট করার জন্য শিগগির আবেদন করা হবে বলে জানান জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রকিবুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দৈনিক এক চামচ শজনেপাতার গুঁড়া খেলেই দৈনন্দিন ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হয়। শজনেপাতার গুঁড়া পানির সঙ্গে গুলিয়ে খাওয়া যায়। এ ছাড়া মধু, চিনি, গুড়, লেবু ও লবণের সঙ্গে এ গুঁড়া মিশিয়েও খাওয়া যায়।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দিন বলেন, শজনের পাতা ফাংশনাল ফুড বা সুপার ফুড বলা হয়। মানবদেহে যেসব উপাদানের নিয়মিত প্রয়োজন, তা শজনেপাতায় আছে। এ পাতাতে প্ল্যান্ট প্রোটিন ও আয়রনের উপস্থিতি বেশি। এটিকে শুকিয়ে গুঁড়া করে খাওয়া হলে পুষ্টিগুণ ঠিক থাকবে, একদম নষ্ট হবে না।
পুষ্টির পরিমাণ দুধের কাছাকাছি
জানতে চাইলে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ বলেন, শজনেপাতার শুকনো গুঁড়াতে পুষ্টি অনেক বেশি। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম আছে। পুষ্টির পরিমাণ কাছাকাছি বলে কেউ প্রতিদিন দুধ খেতে না পারলে এক চামচ করে শজনেপাতার গুঁড়া খেতে পারেন। এই পুষ্টিবিদ আরও বলেন, শজনেপাতার গুঁড়া খেলে তা শরীরকে ক্ষতিকর পদার্থ (ডি-টক্সিফাই) বের করে ফেলে। এটি লিভার, কিডনির জন্য ভালো। রক্তে সুগারের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করে শজনেপাতা।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:জানুয়ারী ১৪, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,