বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর ভারতের ক্ষতি হয় ৯ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। মার্চের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দিল্লির বায়ুমান ভালো, মাঝারি ও অস্বাস্থ্যকর—এসব পর্যায়ের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এরপর আসে শীত। এ সময় বায়ুমান আরও খারাপের দিকে যায়।
দিল্লিতে শীতের সময় বায়ুদূষণের দুটি কারণ নতুন করে যুক্ত হয়। অক্টোবরের শেষ দিক থেকে বৃষ্টি আর হয় না। উত্তর–পশ্চিম দিক থেকে বাতাস বইতে থাকে। এর ফলে কৃষিজমি থেকে খড় পোড়ার ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে মিশে দিল্লির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরপরই আসে দেওয়ালির মৌসুম। এ সময় লাখ লাখ বাজি পোড়ানো হয়। ফলে দূষণ আরও বাড়ে।
দিল্লির বায়ুদূষণে এ দুটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০২১ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দিল্লির বায়ুদূষণ ছিল সবচেয়ে বেশি। এ সময় বাতাসে যে পরিমাণ দূষিত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২ দশমিক ৫) ছিল, তার ৪২ শতাংশই এসেছিল খড় পোড়ানো থেকে। এ কণা মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে।
সরকার এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে খড় পোড়ালে জরিমানা করা হবে। এ ছাড়া খড় পোড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপও করা হয়েছে। এ ছাড়া স্ট্র ও শস্যের অন্যান্য অংশ ব্যবহার না করে বিকল্প কিছু ব্যবহারের ইঙ্গিত দিয়েছে সরকার। কিন্তু কৃষকেরা এই খড় পোড়ানো অব্যাহত রেখেছেন।
দিল্লির আশপাশের রাজ্যগুলোয় খড় পোড়ানো চলছে। এরপর বৃষ্টিও কম হচ্ছে। সেখানে বাৎসরিক বৃষ্টিপাত মাত্র ১৯ থেকে ২৭ ইঞ্চি। কিন্তু অনেক জমিতে এখন দুটি ফসল ফলানো হয়।। এর একটি ধান, অন্যটি গম। কিন্তু ধানের জন্যই শুধু প্রায় ৪৯ ইঞ্চি বৃষ্টির প্রয়োজন প্রতিবছর। অর্থাৎ পানির ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আর এই ঘাটতি মেটাতে ভূগর্ভস্ত পানি ব্যবহার করছেন কৃষকেরা।
উত্তরাঞ্চলের দুটি রাজ্য পাঞ্জাব ও হরিয়ানা। এই দুই রাজ্যে ধানের সবচেয়ে বেশি ফলন হয়। কিন্তু এই দুই রাজ্যে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি ঘনমিটার পানি লাগে ধানের জন্য। এই পানি আসে মূলত ভূগর্ভ থেকে। এই পানির পরিমাণ আসলে কতটা, সেটা আন্দাজ করা যেতে পারে আরেকটি হিসাব থেকে। দেশটির পৌর এলাকাগুলোয় পানি খরচ হয়েছে ৫ হাজার ৬০০ ঘনমিটার। অর্থাৎ দুই রাজ্যে ধান উৎপাদনে যে পরিমাণ পানি লাগছে, তা প্রায় সারা দেশের পৌর এলাকায় ব্যবহৃত পানির সমান।
কৃষিকাজে ভূগর্ভস্ত পানি ব্যবহারের কারণে দ্রুত পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে পাঞ্জাবের ভূগর্ভস্ত পানি শেষ হয়ে যাবে। অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে পানির বন্ধন দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এই ইঙ্গিত বহন করছে শস্যখেতের খড় পোড়ানো।
ভারতের কৃষজ উৎপাদন এমন ছিল না। স্থলভাগে যে পানি পাওয়া যেত, তা দিয়ে ফসল উৎপাদন করা হতো। কিন্তু উনিশ শতকে এসে এই পরিস্থিতি বদলে যায়। রাশিয়া হামলা চালাতে পারে, এ আশঙ্কা থেকে নদীর সঙ্গে যুক্ত করে খালখনন শুরু হয়। এর মধ্য দিয়ে পাঞ্জাবের শুষ্ক জমিগুলোয় পানির সরবরাহ বাড়ায় তারা। এ ছাড়া রেলওয়ে নির্মাণে তারা বনভূমি কেটে ফেলে। একই সঙ্গে কৃষকদের ওপর নতুন কর আরোপ করা হয়। এতে কৃষি উৎপাদনে আগ্রহ বাড়ে কৃষকদের। মূলত যেসব ফসল সহজে বিক্রি করা যাবে, এমন কৃষি উৎপাদনে আগ্রহ বাড়ে কৃষকদের।
এর মধ্য দিয়ে কৃষকের ভাবনাও বদলে যায়। কৃষকেরাও তখন বিশ্বাস করতে শুরু করেন, শুধু প্রাকৃতিক উৎস থেকে নয়, অন্য উৎস থেকেও পানি পাওয়া যেতে পারে। কৃষকদের এই ভাবনাবদলের কারণে বর্তমানে ভারত ভুগছে।
এ ছাড়া আরেকটি ঘটনা ঘটে সেই সময়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর খড় দেখা দেয়। সরকারও এরপর সবুজায়নে প্রলুব্ধ হয়। তখনো পাঞ্জাবে ধান উৎপাদন খুব বেশি ছিল না। তখন এই অত্যধিক পানি শোষণকারী ফসল উৎপাদিত হতো ৭ শতাংশ জমিতে। কিন্তু ১৯৬০–এর দশকে পরিস্থিতি বদলে যায়। মাটির নিচ থেকে পানি তুলে কীভাবে কম খরচে ধান উৎপাদন করা যায়, এ উদ্ভাবন কৃষকদের সামনে উপস্থাপন করা হয়।
ওই সময় কৃষকদের ধারণা ছিল, ভূগর্ভস্ত পানির কোনো ব্যবস্থা তাদের করতে হয় না, শুধু তুলে নিলেই হয়। ফলে সেই সময় ধান উৎপাদনে একধরনের বিপ্লব হয়ে যায়। ধান ও গম উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় এবং ভারত খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন হয়। কিন্তু কয়েক দশকের ব্যবধানে ভূগর্ভস্ত পানি ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
এ পরিস্থিতি সামাল দিতে ২০০৯ সালে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। ভূগর্ভস্ত পানি সংরক্ষণে বর্ষার আগেই ধানের চারা উৎপাদন ও রোপণ ঠেকাতে ওই আইন করা হয়। কিন্তু সংকট দেখা দেয় অন্য জায়গায়। ধান উৎপাদনে দেরি হওয়া, ধান কাটা ও গম বপনের ব্যবধান কমে যায়। তাই জমির খড় পরিষ্কার করতে সংক্ষিপ্ত পথ বেছে নেন কৃষকেরা। তাঁরা খড় আগুনে পুড়িয়ে দেন। আর এতেই ভারতের উত্তরাঞ্চলে বায়ুদূষণ বেড়ে যায়। অর্থাৎ এই বায়ুদূষণের সঙ্গে পানির একটি সম্পর্ক রয়েছে।
*** (বিবিসি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ)
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ জানুয়ারী ১৩, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,