করোনার কারণে ঘরবন্দী হয়ে থাকা মানুষের দুয়ারে নিত্যপণ্যসহ খাবার, ওষুধ, পোশাক এবং এমনকি কাঁচাবাজারও পৌঁছে দিয়েছে বিভিন্ন ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান। ২০২০ সালের মার্চে দেশে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর মানুষ আশা করেছিল, বছর শেষে এই সংকট হয়তো কেটে যাবে। কিন্তু ২০২১ সালে করোনা আরও ভয়ংকর রূপে আসে। সে জন্য ঘরে বসে পণ্য–সেবার পাওয়ার চাহিদা বেশ বৃদ্ধি পায়। সেই সুবাদে ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যস্ততা বাড়ে, ব্যবসা ভালো হয়।
কিন্তু মানুষের চাহিদার সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান চটকদার বিজ্ঞাপন ও মনভোলানো প্রতিশ্রুতির আড়ালে নির্বিচার প্রতারণা শুরু করে। তারা বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে পণ্য বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এ রকম প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইভ্যালি, যাদের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের আগস্টেই বহুস্তর বিপণন পদ্ধতির (এমএলএম) ধরনে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তখন এক মাসের জন্য প্রতিষ্ঠানটির হিসাব স্থগিত রেখে পরে ছেড়ে দেয়। এরপরই ইভ্যালি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কম দামের অফারে দেদার বিক্রয়াদেশ আসতে শুরু করে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাউন্ট, অর্থাৎ হিসেবে শত শত কোটি টাকা জমা হতে থাকে। কিন্তু গ্রাহকদের ক্রয়াদেশ অনুযায়ী পণ্য দিতে পারছিল না ইভ্যালি। তাদের লোভনীয় বিজ্ঞাপন, উচ্চহারে মূল্যছাড়ের ঘোষণা ও ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাকের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হতে থাকেন গ্রাহকেরা।
পরিস্থিতি বড় মোড় নেয় চলতি বছরের জুনে ইভ্যালিকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও তখন নড়েচড়ে বসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছরের মার্চ পর্যন্তই ইভ্যালির দেনার পরিমাণ দাঁদিয়েছে ৪০৩ কোটি টাকা, আর চলতি সম্পদের মূল্য ৬৫ কোটি টাকা। পণ্যমূল্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম ২১৪ কোটি টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহ করেনি ইভ্যালি। আবার যেসব কোম্পানির কাছ থেকে ই-ভ্যালি পণ্য কিনেছে, তাদের কাছেও প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া পড়েছে ১৯০ কোটি টাকা। চলতি সম্পদ দিয়ে বকেয়া অর্থের মাত্র ১৬ শতাংশ পরিশোধ করা সম্ভব।
এদিকে তলে তলে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান যে ইভ্যালির মডেলে দেশে প্রতারণার জাল বিছিয়েছে তা যেন আড়ালেই ছিল এত দিন। ইভ্যালির পর একে একে সেই সব প্রতিষ্ঠানের গোমর ফাঁস হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের আগস্টে আরেক প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়। মালিকপক্ষের মধ্যে সোনিয়া মেহজাবিন ও তাঁর স্বামী মাসুকুর রহমান এবং প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আমানউল্লাহ চৌধুরী গ্রেপ্তার হন। ই–অরেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত সোনিয়া মেহজাবিনের ভাই বনানী থানার পরিদর্শক সোহেল রানা ভারতে পালাতে গিয়ে সেখানে গ্রেপ্তার হন।
পরের মাস সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হন ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল। গ্রেপ্তার হন কিউকমের সিইও রিপন মিয়া ও ধামাকা শপিংয়ের সিইও সিরাজুল ইসলাম ওরফে রানা। এরপর অন্যদের কাহিনিও চাউর হয়। আদিয়ান মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপ, রিং আইডি, আলেশা মার্ট, আনন্দের বাজার, এসপিসি ওয়ার্ল্ড, নিরাপদ ডটকমসহ আরও দেড় ডজন ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাপদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অনেকেই এখন পলাতক। প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ। এদিকে টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন অসহায় গ্রাহকেরা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অবশ্য গত জুলাইয়ে একটি পরিচালনা নির্দেশিকা জারি করে, যার অভাব বোধ করছিল ই–কমার্স খাত। আর মন্ত্রণালয়টি এ ব্যাপারে জোরালো নজর দেয় আগস্ট মাসে। তখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও সজাগ হয়। ই–কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে একে একে কমিটি গঠিত হতে থাকে। আসতে থাকে নতুন নতুন সুপারিশ। এর মধ্যে অন্যতম সুপারিশ হচ্ছে, ই–কমার্স ব্যবসা পরিচালনা করতে গেলে ইউনিক বিজনেস আইডেনটিফিকেশন (ইউবিআইডি) নেওয়া।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ডিসেম্বর ৩০, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,