লেখা:ডেকান হেরাল্ডে প্রকাশিত নিবন্ধ অবলম্বনে।
এ বছর বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করেছে ভারতও। কারণ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বিপক্ষে লড়াইয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছিল দেশটি। ১৯৭১ সালে লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের প্রধান। ১৬ ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর কাছে ঢাকার তত্কালীন রমনা রেসকোর্সে পাকিস্তানি জেনারেল এ কে নিয়াজির নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে সংঘাতে বড় ধরনের পরাজয় হয় ভারতের। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অমীমাংসিত অবস্থায় শেষ হওয়ার পর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের চরম পরাজয় দিল্লিকে স্বস্তি দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সত্যিকারের নেতা হিসেবে উত্থানের শুরু ভারতের।
পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ক্ষমতার পাল্লা নিজেদের পক্ষে রাখার সুযোগ পায় দেশটি। এর মধ্য দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে শক্ত বার্তাও পাঠায় ভারত। নয়াদিল্লি ক্রমাগত বার্তা দিতে থাকে যে নিজেদের আধিপত্য নিশ্চিত করতে যা করার তা তারা করে যাবে। প্রয়োজন হলে প্রতিবেশী দেশে ক্ষমতার পালাবদলেরও প্রচেষ্টা চালানো হবে। চীন, মরিশাস, মালদ্বীপ, সিসিলি, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি। নেপাল, ভুটান এমনকি আফগানিস্তানেও ভারতের তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাব দেখা গেছে।
৫০ বছর পর ভারতের প্রভাব এ অঞ্চলে কেমন?
১৯৭১ সালে বিশ্বে মানচিত্রে বাংলাদেশ জায়গা করে নেওয়ার এক বছর পর নর্থ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার এজেন্সিতে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে ভারত। এর নতুন নাম দেওয়া হয় অরুণাচল প্রদেশ। আলাদা একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয় অরুণাচল। ভারতের এমন আচরণে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হয় চীন। বেইজিংয়ের কঠোর বিরোধিতা উপেক্ষা করে ১৯৭৫ সালের মে মাসে সিকিমকও ভারতের সঙ্গে একীভূত হয়।
তবে ২০২০ ও ২০২১ সালে আবারও ভারতের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হতে দেখা যায় চীনকে। লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারতীয় সেনাসদস্যদের সঙ্গে চীনা সেনাসদস্যদের মুখোমুখি সংঘাত হয়ে। যদিও চলতি বছরের আগস্ট ও ফেব্রুয়ারিতে দুই পক্ষকে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে পানগং সো ও গোগরা পোস্ট থেকে সেনাদের সরাতে দেখা গেছে। তবে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখাসংলগ্ন অন্য এলাকাগুলোতে বিরোধের সমাধান করতে পারেনি দুই পক্ষ। পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরসহ ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সীমান্ত এলাকাজুড়ে সেনা উপস্থিতি বাড়িয়ে যাচ্ছে চীন। এতে মধ্যাঞ্চলীয় ও পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অপারেশন লাল ডোরা
১৯৮২ সালে মরিশাসে আনিরুদ জুগনাথকে ক্ষমতায় আসতে সহযোগিতা করে ভারত। শুধু তাই নয়, ১৯৮৩ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী পল বেরেঞ্জার জুগনাথকে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার পরও তাঁকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা সহযোগিতা করেছিল। এমনকি মরিশাসে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্যও প্রস্তুত ছিল নয়াদিল্লি। সম্ভাব্য ওই অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন লাল ডোরা’। পোর্ত লুই সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে এ অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অবশ্য ‘অপারেশন লাল ডোরা’ কখনো কার্যকর করা হয়নি। বরং ১৯৮৬ সালে ভারত মহাসাগরীয় আরেক দ্বীপরাষ্ট্র সিসিলিতে প্রেসিডেন্ট ফ্রান্স আলবার্ত রেনের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান ব্যর্থ করতে ‘অপারেশন ফ্লাওয়ার্স আর ব্লুমিং’ চালানো হয়েছিল।
‘ভারত তাড়াও’ প্রচারণা
তিন দশকের বেশি সময় পরও মরিশাস ও সিসিলি নিয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে দিল্লির প্রতিযোগিতা চলছে। মরিশাসে আগালেগা দ্বীপ এবং সিসিলিতে এজাম্পশন দ্বীপের উন্নয়নে ভারতের নেওয়া প্রকল্প ভেস্তে দিতে চাইছে চীন। দুটি দ্বীপকে ভারতীয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে পরিণত করা হচ্ছে বলে দাবি করছে দেশটি। এতে স্থানীয় রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও করছে তারা।
১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ ফলপ্রসূ হয়নি। তবে ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুম সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ব্যর্থ করতে অপারেশন ক্যাকটাস চালিয়ে সফল হয়েছিল তারা। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কাছ থেকেও প্রশংসা কুড়িয়েছিল দেশটি।
গাইয়ুমের সৎভাই ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম এখন মালদ্বীপকে ভারতের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম মোহাম্মদ সলিহ আবার উল্টো। সলিহ-এর ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ তথা ‘সবার আগে ভারত’ই নীতির বিরোধিতা করছেন ইয়ামিন। শ্রীলঙ্কাকে ইতিমধ্যে ‘ঋণের ফাঁদে ফেলার কূটনীতি’তে সফল হয়েছে চীন। শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যে বেইজিংকে ৯৯ বছরের জন্য তাদের হাম্বানটোটা বন্দর ইজারা দিয়েছে।
কলম্বো পোর্ট সিটি ইকোনমিক কমিশন বিল নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে নয়াদিল্লি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ বিলের আওতায় ভার্চ্যুয়ালি শ্রীলঙ্কায় একটি কলোনি প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে চীন। ভারতের দক্ষিণাঞ্চল থেকে এলাকাটি খুব একটা দূরে নয়। ২০১৫ সালে নেপালের নতুন সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে দিল্লি যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাতে ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। নেপালে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকার অনানুষ্ঠানিক অবরোধ আরোপ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত কয়েক মাসে ভারত ও নেপালের মধ্যকার ভূমিগত বিরোধও বাড়তে দেখা গেছে।
২০১৭ সালে দোকালামে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও চীনা সেনাবাহিনীর মধ্যে ৭৪ দিনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি চলার সময় নয়াদিল্লির পাশে ছিল থিম্পু। তবে শেষ পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় ভূমিগত বিরোধের সমাধানে চীনের তৈরি রোডম্যাপকে সমর্থন জানায় ভুটান।
২০২১ সালে ভারত একদিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর উদ্যাপন করছে। অন্যদিকে পাকিস্তানকে দেখা যায় আফগানিস্তানে ভারতের বিপক্ষে কৌশলগত সমর্থন অর্জন করতে। গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করেছে তালেবান। ভারত কখনোই আফগানিস্তানে সেনাসদস্য পাঠায়নি। তবে গত ২০ বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে অবকাঠামো পুনর্গঠনের জন্য ৩০০ কোটি ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে দিল্লি। এ বিনিয়োগ এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কাবুলে গ্রহণযোগ্য সরকার গঠনের জন্য ভারত আহ্বান জানিয়ে এলেও এখন তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগের পথ খুঁজছে দেশটি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সরকারকে উৎখাত করে সেনা সরকার ক্ষমতা দখলের পর পশ্চিমা দেশগুলো এর সমালোচনা করেছিল। তবে চীনের সঙ্গে কৌশলগত শত্রুতা এবং এর নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগকে কেন্দ্র করে ভারত সমালোচনা থেকে বিরত থাকে।
ভারতের এমন সতর্ক অবস্থান মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকারীদের ক্ষুব্ধ করেছে। অবশ্য ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সম্প্রতি নেপিডো সফর করেন। অবিলম্বে সু চিসহ সব রাজনৈতিক কারাবন্দীর মুক্তি দাবি করেছেন তিনি। একই সঙ্গে মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠারও আহ্বান জানিয়েছেন শ্রিংলা।
১৯৯০–এর দশক থেকে বেশির ভাগ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারতকে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে দেখা যায়। তখন থেকে দেশটির সব সরকারকে কঠোর হওয়ার চেয়ে নমনীয় ক্ষমতার চর্চা করতে দেখা গেছে। ২০১৪ সাল থেকে মোদি সরকারকেও এ নীতিতে স্থির থাকতে দেখা গিয়েছিল। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রমও দেখা গেছে। মোদির শাসন মেয়াদে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে এবং ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী স্থাপনাগুলোতে অভিযান চালায় ভারত। এসব সামরিক অভিযানের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণাও করা হয়। এর মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামরিক বার্তা দিতে চায় দেশটি। এদিকে বিরোধপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় ২০ মাস ধরে চীনের সঙ্গে ভারতের সংঘর্ষ চলেছে। এমন অবস্থায় নতুন করে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলের নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে নিজেদের অবস্থান জোরালো করার দিকে মনযোগী হয়েছে দিল্লি।
*** সূত্র: ডেকান হেরাল্ডে প্রকাশিত নিবন্ধ অবলম্বনে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ডিসেম্বর ২৯, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,