লেখক: মাসুদ মিলাদ।
১৯৭৭ সালে পারিবারিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপে যোগদান করেন আলীহোসেইন আকবরআলী, তখন দেশে শিল্পকারখানা ছিল হাতে গোনা। এরপর প্রায় ৪৫ বছর ধরে নিজ চোখে দেখেছেন দেশের শিল্পকারখানা গড়ে তোলার ও গড়ে ওঠার অবিস্মরণীয় অগ্রযাত্রা। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী বা ৫০ বছরের সেই অগ্রযাত্রার অনুভূতি তুলে ধরে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ৫০ বছরের তুলনা করলে বাংলাদেশে শিল্পায়নে অবিশ্বাস্য অগ্রগতি হয়েছে। আর এখন শিল্পসহায়ক যেসব ছোট-বড় অবকাঠামো হচ্ছে, তা বাস্তবায়ন শেষে এই অগ্রগতি চূড়ায় উন্নীত হবে। এ জন্য অবশ্যই সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ হাতে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ভারতের গুজরাটের আম্রেলি জেলা থেকে আলীহোসেইন আকবরআলীর পরিবার চট্টগ্রামে এসে শিল্পকারখানা গড়ে তোলে। পেরেক কারখানা দিয়ে যাত্রা শুরু করে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাসে চট্টগ্রামের নাছিরাবাদে রড তৈরির কারখানা গড়েন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের বৃহৎ সব শিল্পকারখানা, ব্যাংক-বিমা জাতীয়করণের ঘোষণা দেয় সরকার। সে সময় চট্টগ্রামের নাছিরাবাদ শিল্প এলাকায় অবস্থিত বিএসআরএমের কারখানাটিও জাতীয়করণ করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে কারখানাটিতে বসানো হয় একজন ব্যবস্থাপক। ব্যবস্থাপকের অধীনে কারখানার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। আলীহোসেইন আকবরআলীর বাবা আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালাকে জাত ব্যবসায়ী হিসেবে চিনতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাতে জাতীয়করণের আওতায় আসা কারখানাটি মূল মালিককে ফেরত দিতে সময় নেয়নি তৎকালীন সরকার।
চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা আলীহোসেইন আকবরআলী তখন করাচির এএফ ফারগুসনে চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্সি (সিএ) কোর্স করছিলেন। প্রথম আলোকে সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে বলেন, জাতীয়করণের মাত্র দুই মাসের মাথায় কারখানাটি ফেরত দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দূরদর্শী চিন্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। সে সময় দ্রুত কারখানাটি ফেরত দেওয়া না হলে বিএসআরএম গ্রুপ আজকের অবস্থানে আসত না—তাই কৃতজ্ঞতাভরে বঙ্গবন্ধুর সেই অবদানকে স্মরণ করেন তিনি।
স্বাধীনতার পরপরই শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করা হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের সীমা বাড়ানো হয়। এরপর আশির দশকে বেসরকারি খাতে শিল্পকারখানা ছেড়ে দেওয়া শুরু হয়। উদ্যোক্তারাও নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনে এগিয়ে আসেন। উৎপাদনমুখী কারখানার বিকাশও শুরু হয় তখন থেকে। পাট ও চামড়ার সঙ্গে পোশাক খাতের পথচলা শুরু হয়।
আলীহোসেইন আকবরআলী বলেন, ১৯৮৪ সালে শিল্পকারখানা স্থাপনে লাইসেন্স প্রথা তুলে দেওয়া হয়। তাতেই ওই সময় ভারী শিল্প ইস্পাত খাতে অনেকেই যুক্ত হন। শিল্পায়নের শুরুর দিকে কারখানাগুলো ছিল খুবই ছোট। কারণ, দেশে তখন চাহিদা ছিল কম। শিল্পায়নে অগ্রগতির বড় ঢেউ শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম আমলে শিল্পায়ন গতি পায়। শিল্পের স্বর্ণযুগের সূচনা হয় তখন। আর বৃহৎ শিল্পে পদার্পণের যুগ শুরু হয় নতুন শতাব্দীতে। বিশেষ করে বিগত ১৫ বছরে দেশে ভারী শিল্পের বিকাশ হয়। ইস্পাত, সিমেন্ট, ঢেউটিনের মতো ভারী শিল্পে ছোট কারখানাগুলো সম্প্রসারণ করে বড় করেছেন উদ্যোক্তারা। দেশে ভোক্তা চাহিদা বাড়ার কারণেই বৃহৎ শিল্পের উত্থান হয়েছে।
যোগাযোগ অবকাঠামোসহ শিল্পকারখানা সহায়ক যেসব অবকাঠামো হচ্ছে, তাতে আগামী দিনে অর্থনীতিতে বড় অগ্রগতি হবে বলে মনে করেন আলীহোসেইন আকবরআলী। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ী হিসেবে আমরা সব সময় চাই, সরকার শুধু অবকাঠামো ও নীতিসহায়তা দিক। বাকি কাজটুকু করবেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। বর্তমান সরকার বড় অবকাঠামোর প্রকল্প নিয়ে সেই কাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। এখন পদ্মা সেতু, টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো যেসব বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলো চালু হলে এই দেশের বিশাল অগ্রগতি ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।
সরকার বর্তমানে যেসব বড় অবকাঠামো প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেগুলোর সুফল যদি দ্রুত পেতে হয়, তাহলে কিছু কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে। বে টার্মিনালও নির্মিত হবে। টানেলও হয়ে যাচ্ছে। এখন যদি মাতারবাড়ী থেকে মিরসরাই পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে গভীর সমুদ্রবন্দরের সুফল পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে অনেক ঠিকাদারকে একসঙ্গে কাজ দিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করা সম্ভব।
দেশে যেভাবে শিল্পায়ন হচ্ছে, তাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক চাপ নিতে পারবে না। বিদ্যমান সড়ক সম্প্রসারণ করে যদি আরসিসি সড়ক নির্মাণ করা যায়, তাহলে ৫০ টনের পণ্যবাহী গাড়ি চলতে পারবে। এতে জ্বালানি যেমন সাশ্রয় হবে, তেমনি খরচও কমবে। পরিবেশের কম দূষণ হবে। সরকার বাজারে ২০ বছর মেয়াদি বন্ড ছেড়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে। তাতে অন্তত ৪০ শতাংশ গাড়ি চলাচল কমে যাবে। সময় বাঁচবে ৩০ শতাংশ।
বর্তমানে শিল্পায়ন শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো মূল শহরকেন্দ্রিক। আলীহোসেইন আকবরআলী মনে করেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল বা শুধু মূল শহরের আশপাশে শিল্পকারখানা গড়ে তুললে হবে না, প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন কারখানা গড়ে তোলার জন্য নীতিসহায়তা দেওয়ার সময় এসেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ এখন অনেক ভালো। বৈচিত্র্যময় পণ্যের কারখানা হতে পারে গ্রামে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ প্রসারিত করে গ্রামে কারখানার জন্য সুবিধা দিতে পারে সরকার। গ্রামাঞ্চলে বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনের জন্য ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ, প্রণোদনাসহ যদি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়, তাহলে উদ্যোক্তারা গ্রামে গিয়ে কারখানা গড়ে তুলবেন। ছোট ছোট বহু কারখানা গড়ে উঠবে। শিল্পায়নে বিকেন্দ্রীকরণ হবে। এ রকম বিশেষ সুবিধা যদি দেওয়া হয়, তাহলে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পের উত্থান হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে। গ্রামে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। বাংলাদেশকে বদলে দিতে পারে এই এক সিদ্ধান্ত। তাতে কর্মসংস্থান টেকসই হবে।
আলীহোসেইন আকবরআলী বলেন, বেশি দূর যেতে হবে না। ২০ বছর আগের কথাই যদি বলি, তখন বিএসআরএমের কারখানায় দিনে রড উৎপাদিত হতো ৪০০ টনের মতো। এখন দিনে রড উৎপাদিত হচ্ছে ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টন। শুধু একটি কারখানাই নয়, ইস্পাত ও সিমেন্টের মতো ভারী শিল্পের প্রবৃদ্ধিতে উত্থান হয়েছে। এই দুটো পণ্যের উৎপাদন বাড়ার চিত্র বলে দেয়, অর্থনৈতিক অগ্রগতি থেমে নেই। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ডিসেম্বর ২০, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,