লেখক: রাজীব আহমেদ।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকে ভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এ সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথ রচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তারাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।
বাংলাদেশে গত শতাব্দীর আশির দশকেও সিরামিকের তৈজসপত্রের বাজার ছিল জাপানি ও ইউরোপীয় কয়েকটি ব্র্যান্ডের দখলে। নোরিটেক, নিক্কো, রয়েল ডালটন—ইত্যাদি। ১৯৮৪ সালে এসব ব্র্যান্ডের দাপটের মধ্যে একটি নতুন কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়, যার উদ্যোক্তা ছিলেন হারুনার রশিদ খান মুন্নু।
মুন্নু সিরামিক নামের এই সিরামিক তৈজসপত্রের কারখানা একসময় জাপান ও ইউরোপীয় ব্র্যান্ডগুলোকে হটিয়ে বাজার দখল করে। আজ মুন্নু সিরামিক বাংলাদেশের সিরামিক তৈজসপত্রের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড।
মুন্নুর মাধ্যমে বাংলাদেশে সিরামিক শিল্পে মোড় ঘোরানো দেশি বিনিয়োগ আসে। এখন দেশের ঘরে ঘরে, ভবনে ভবনে দেশি কারখানার সিরামিক পণ্য। দেশি তৈজসপত্র আনছে আভিজাত্য, দেশি টাইলসে মানুষ মেঝে সাজাচ্ছে, দেশি স্যানিটারিওয়্যার শৌচাগারের সৌন্দর্য বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ সিরামিক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিসিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন সিরামিক পণ্যের বাজারের আকার প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ বাজার স্থানীয় উৎপাদকদের দখলে। দেশে সিরামিক কারখানার সংখ্যা ৬৬টির বেশি। এসব কারখানায় যেমন সস্তা দামের পণ্য তৈরি হয়, তেমনি মধ্যম দামের মানসম্মত পণ্য তৈরি হয়। আবার উচ্চ দামের পণ্য তৈরি করে উচ্চ আয়ের মানুষের বাজারও ধরছেন দেশি উৎপাদকেরা।
মুন্নুর বিনিয়োগ ১৯৮৪ সালে হলেও এই ভূখণ্ডে সিরামিক শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। প্রথম কারখানার নাম ছিল তাজমা সিরামিক। উদ্যোক্তা ছিলেন একজন পশ্চিম পাকিস্তানি। সিরামিক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তাজমার উৎপাদন ছিল খুবই সীমিত। উৎপাদিত পণ্যের মানও তেমন ভালো ছিল না। ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু করে পাকিস্তান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নাম পাল্টে পিপলস সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ হয়। দেশের স্বাধীনতার পর সিরামিক খাতে ১৯৭৪ সালে ঢাকা সিরামিক ও স্যানিটারিওয়্যার যাত্রা শুরু করে। তারাই দেশে প্রথমবারের মতো স্যানিটারিওয়্যার উৎপাদন শুরু করে।
মুন্নুর যাত্রা
হারুনার রশিদ খান মুন্নু ১৯৮৪ সালে জাপানি প্রযুক্তিতে সিরামিক কারখানা করেন। এখন মানিকগঞ্জে প্রায় ৪৫ একর জমিতে মুন্নু সিরামিকের কারখানা। উৎপাদন ক্ষমতা মাসে ২০ লাখ পিস। তাদের অন্তত ৬টি বৈশ্বিক সংস্থার মানসনদ রয়েছে, এটি পুঁজিবাজারেও নিবন্ধিত।
মুন্নু সিরামিক দেশের সিরামিকের তৈজসপত্র রপ্তানির পথ দেখানো প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮৫ সালেই রপ্তানি শুরু করে। প্রথম চালান গিয়েছিল যুক্তরাজ্যে। বর্তমানে তারা ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতসহ বিশ্বের মোট ৪৮টি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে।
দেশে গুটিকয়েক কোম্পানির বোন চায়না (গরুর হাড়ের গুঁড়া থেকে তৈরি) তৈজসপত্রের কারখানা রয়েছে, যার একটি মুন্নুর। মুন্নু গ্রুপ জানিয়েছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ‘অফিশিয়াল স্যুভেনির’ হিসেবে তাদের তৈরি বোন চায়না তৈজসপত্র সরবরাহ করত। যুক্তরাজ্যের সংসদে মুন্নুর তৈরি বোন চায়না মগ ব্যবহার করা হয়।
মুন্নু সিরামিক সোনার কারুকার্যে সিরামিক তৈজসপত্র তৈরি করে। তরল সোনা আনা হয় জার্মানি থেকে। মুন্নুর সোনাখচিত তৈজসপত্র রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্যে।
হারুনার রশিদ খানের কথা
মুন্নু গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা হারুনার রশিদ খান মুন্নুর জন্ম ১৯৩৩ সালের ১৭ আগস্ট। ২০১৭ সালের ১ আগস্ট মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত তিনি মুন্নু গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি শিল্প উদ্যোক্তা ও রাজনীতিবিদ ছিলেন।
হারুনার রশিদ খান ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাবেক মানিকগঞ্জ-২ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালেও তিনি জয়ী হয়েছিলেন এবং তাঁকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।
হারুনার রশিদ খান মুন্নুর পৈতৃক বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার আজিমনগর ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর গ্রামে। তিনি ১৯৫২ সালে বাণিজ্য শাখায় প্রথম বিভাগ পেয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৪ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে এইচএসসি পাস করেন তিনি। ১৯৫৬ সালে বিকম পাস করেন এবং পরবর্তী সময়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস কোর্স সম্পন্ন করেন।
পেশাজীবনের শুরুতে হারুনার রশিদ খান মুন্নুর যুক্তরাজ্যে চাকরি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তবে মা চাননি বলে তিনি যাননি। দেশে একটি চাকরি নিলেও তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল ব্যবসা করা। মুন্নু গ্রুপ জানিয়েছে, ১৯৬৩ সালে মুন্নু আর্ট প্রেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন হারুনার রশিদ খান। এই প্রেসে হিসাবরক্ষণের খাতা ও নিবন্ধন বই প্রস্তুত করা হতো। ১৯৭৫ সালে তিনি পাটকলের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি শুরু করেন। এতে বেশ সাফল্যের মুখ দেখেন।
এরপর ১৯৮৪ সালে হারুনার রশিদ খান মুন্নু প্রতিষ্ঠা করেন সিরামিক কারখানা। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ২০১৬ সালে ডিএইচএল ও দ্য ডেইলি স্টারের বিজনেস অ্যাওয়ার্ড-এর ‘লাইফ লং অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ পাওয়া উপলক্ষে এক সাক্ষাৎকালে হারুনার রশিদ খান জানান, তিনি পণ্যের মানের দিক দিয়ে কখনো আপস করেননি। ব্যবসায় অসততাকে আশ্রয় দেননি। রপ্তানি শুরুর ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রথম যখন আমার পণ্য লন্ডনে গেছে, তারা বিশ্বাস করতে পারেনি বাংলাদেশে এমন সিরামিক পণ্য তৈরি হয়। প্রথম অর্ডারটি দিয়েছিল ওয়ারেন উড কোম্পানি। তারা এখনো আমার কাছ থেকে পণ্য নেয়।’
‘তিনি চাইতেন মানুষের কাজের ব্যবস্থা করতে’
হারুনার রশিদ খান মুন্নু ও হুরুন নাহার রশিদ দম্পতির দুই কন্যা—আফরোজা খান ও ফিরোজা মাহমুদ। আফরোজা খান এখন মুন্নু গ্রুপের চেয়ারম্যান। বর্তমানে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন আফরোজা খানের বড় ছেলে রাশেদ মাইমুনুল ইসলাম এবং যুক্তরাজ্যে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে মেজ ছেলে রাশেদ সামিউল ইসলাম।মুন্নু গ্রুপের এখন সিরামিক, পোশাক ও বস্ত্র খাতে বিনিয়োগ রয়েছে। তারা মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও নার্সিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে।
মুন্নু গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, হারুনার রশিদ খান মুন্নু সব সময় চাইতেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, যারা কাজ পায় না, তাদের কাজের ব্যবস্থা করতে। মুন্নু গ্রুপ সব সময় সেই চেষ্টা করেছে। তিনি জানান, হারুনার রশিদ খান যখন মুন্নু সিরামিক প্রতিষ্ঠা করেন, তখন বাংলাদেশে বড় ও আধুনিক কোনো সিরামিক কারখানা ছিল না।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ নভেম্বর ২৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,