লেখক:শুভংকর কর্মকার।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকেভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এই সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথরচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তাঁরাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।
১৯৪৫ সালে আনোয়ার হোসেনের বাবা রহিম বখ্স মারা যান। তখন আনোয়ার হোসেনের বয়স মাত্র সাত বছর। বাবার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে পারিবারিক ব্যবসা সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। কারণ, বিশ্বস্ত কর্মচারীদের কয়েকজন টাকাপয়সা আত্মসাৎ করেন।
১২ বছর বয়সে বাবার ব্যবসা সামলানোর দায়িত্ব আনোয়ার হোসেনের ওপর পড়ে। এর আগে তাঁর বড় ভাই তাঁকে নিজেদের দোকানের পাশে ভোলা মিঞা নামের এক ব্যক্তির দোকানে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। সকাল থেকে বেলা একটা পর্যন্ত পড়াশোনা, এরপর দোকানে কাজ। আনোয়ার হোসেনের ভাতা ছিল মাসে ১৫ টাকা। আর দৈনিক ২ আনা নাশতার খরচ।
কিছুকাল পর আনসার বাহিনীর চাকরি ছেড়ে বড় ভাই আবার ব্যবসায় ফিরে আসেন। তখন আনোয়ার হোসেন নিজে কিছু করার চিন্তা শুরু করেন। ভোলা মিঞার দোকানে কাজ করে জমানো ৯০ টাকাই সম্বল। মা দিলেন ২০০টি রুপার মুদ্রা, যা বিক্রি করে পেলেন ৩৯০ টাকা। মোট মূলধন ৪৮০ টাকায় ১৯৫৩ সালে চকবাজারে ২২০ নম্বর দোকান নিলেন তিনি। নাম দিলেন আনোয়ার ক্লথ স্টোর। তাঁর বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর।
আজকের আনোয়ার গ্রুপ নামের যে বড় শিল্পগোষ্ঠী, তার প্রতিষ্ঠাতা আনোয়ার হোসেন নিজের ব্যবসায়ী জীবন এভাবেই শুরু করেছিলেন। বর্তমানে দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে আনোয়ার গ্রুপ অন্যতম। স্বাধীনতার আগে বাঙালিদের মধ্যে বড় ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন হাতে গোনা। আনোয়ার হোসেন ছিলেন তাঁদের একজন।
দেশীয় ব্র্যান্ডের জনপ্রিয় মালা শাড়ি থেকে শুরু করে দেশীয় মালিকানার বস্ত্রকল, চামচ-কাঁটাচামচ, বেসরকারি ব্যাংকের মতো নতুন নতুন উদ্যোগে আনোয়ার হোসেন ছিলেন অগ্রণী। বর্তমানে বস্ত্র, পাট, সিমেন্ট, ইস্পাত, ব্যাংক, বিমা, গাড়ি, আবাসন, অবকাঠামো, আসবাবসহ ৩৬টি পণ্য ও সেবা খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। গ্রুপটির ২০ কোম্পানিতে ২০ হাজারের বেশি কর্মী রয়েছেন।
শুরুর দিকের কথা
চকবাজারে দোকান দেওয়ার পর আনোয়ার হোসেন কঠোর পরিশ্রম করতে লাগলেন। ঢাকার রায়েরবাজারে তখন হাট বসত। সেখানে তিনি লুঙ্গির গাঁটরি মাথায় করে নিয়ে যেতেন। পরনে লুঙ্গির ভাঁজে থাকত মুড়ি আর পেঁয়াজি। খিদে পেলে তাই খেতেন।
ব্যবসা বাড়তে থাকে। একসময় চকবাজারে পাশের ছয়টি দোকান কিনে নেন আনোয়ার হোসেন। লুঙ্গি থেকে কাপড়, এরপর শাড়ি, ব্যবসা বাড়ছিল। আনোয়ার হোসেন নামেন ঢেউটিন আমদানির ব্যবসায়—সবই ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে।
বাণিজ্যে ভালো করছিলেন ঠিকই, কিন্তু আনোয়ার হোসেনের ইচ্ছা ছিল শিল্পকারখানা করার। ১৯৫৬ সালে বাড়িতে শাড়ির ছাপাখানা চালু করেছিলেন। সেটা সেই অর্থে শিল্প ছিল না। ১৯৬৮ সালে তিনি একটি সিল্ক মিল কিনে চালু করলেন আনোয়ার সিল্ক মিলস। তৈরি হলো মালা শাড়ির ইতিহাস। তখন ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় আনোয়ার হোসেনের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। দোকান, কার্যালয়, বাড়ি-গাড়ি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতেও।
দেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে এই শাড়ি এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, বিয়ে মানেই ছিল মালা শাড়ি। বাজারে তখন আমদানি করা এবং অবাঙালিদের কারখানায় উৎপাদিত বিভিন্ন শাড়ি ছিল। সব শাড়িকে হটিয়ে বাজার দখল করে মালা শাড়ি। গত শতাব্দীর আশির দশকেও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় জিঙ্গেল ছিল ‘মালা শাড়ি না দিলে বিয়া করমু না’।
নতুন নতুন উদ্যোগ
আগেই বলেছি, স্বাধীনতার আগে বাঙালিদের মধ্যে বড় ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন হাতে গোনা। আনোয়ার হোসেন ছিলেন তাঁদের একজন। দেশীয় ব্র্যান্ডের জনপ্রিয় শাড়ি, দেশীয় উদ্যোক্তার মালিকানায় বস্ত্রশিল্প, দেশীয় মালিকানার কারখানায় উৎপাদিত চামচ-কাঁটাচামচ, বেসরকারি ব্যাংক-নতুন নতুন উদ্যোগে তিনি ছিলেন অগ্রণী।
১৯৭৮ সালে ৪০ জন ব্যবসায়ীর একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আনোয়ার হোসেন তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। সেখানে গিয়ে কেউ ব্যাংকের কথা বললেন না। প্রসঙ্গটি তুললেন আনোয়ার হোসেন। বললেন, দেশে বেসরকারি ব্যাংক দরকার। নানা যুক্তিতর্কের পর রাজি হলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো দি সিটি ব্যাংক, চারবার সেটির চেয়ারম্যান ছিলেন আনোয়ার হোসেন।
ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। আশির দশকে তিন বছর সাংসদ (ঢাকা-৮ আসনের) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আনোয়ার হোসেন। এরপর এরশাদ সরকারের পতন হয়। পড়ে আনোয়ার হোসেন আর রাজনীতির পথে পা বাড়াননি।
দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মধ্যে স্বনামধন্য ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) আজকের অবস্থানে আসার পেছনেও বড় ভূমিকা ছিল আনোয়ার হোসেনের। তিনি অনেকবার ডিসিসিআইয়ের সভাপতি হতে পারতেন। কিন্তু হননি। বরং ১২ জনকে সভাপতি হতে সহায়তা করেছেন। হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, সামাজিক সংগঠনে সহায়তায় উদারহস্ত আনোয়ার হোসেন। নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশনও প্রতিষ্ঠা করেছেন।
নেতৃত্বে তিন ছেলে
আনোয়ার হোসেনের স্ত্রীর নাম বিবি আমেনা। আনোয়ার-আমেনা দম্পতির সাত সন্তান। চার মেয়ে ও তিন ছেলে। প্রথম তিন সন্তান মেয়ে—শাহীন বেগম, সেলিনা বেগম মালা ও হাসিনা বেগম রুমা। আরেক মেয়ের নাম শাহনাজ বেগম মুন্নী। আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত মালা শাড়ির নাম দেওয়া হয় দ্বিতীয় সন্তান সেলিনা বেগম মালার নাম অনুসারে।
চতুর্থ সন্তান মানোয়ার হোসেন, যিনি বর্তমানে আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান। আনোয়ার সিমেন্ট, আনোয়ার স্টিল মিলস, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, মানোয়ার ইন্ডাস্ট্রিজ ও সানশাইন কেব্লসের ব্যবসা সামলান তিনি। মেজ ছেলের নাম হোসেন মেহমুদ। তিনি হোসেন ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং, মেহমুদ ইন্ডাস্ট্রিজ, আনোয়ার সিল্ক, আনোয়ার টেক্সটাইল ও আনোয়ার টেরিটাওয়েলের ব্যবসা দেখাশোনা করেন। আর ছোট ছেলে হোসেন খালেদ আনোয়ার জুট মিলস, এজি অটোমোবাইলস, বাংলাদেশ ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিসহ কয়েকটি ব্যবসা দেখেন।
আনোয়ার হোসেন ২০১২ সালে স্মৃতিশক্তি হারানোর রোগ বা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন। এর আগে আগেই ছেলেরা ব্যবসার দায়িত্ব নেন। আনোয়ার হোসেনের তিন ছেলে—মানোয়ার হোসেন, হোসেন মেহমুদ ও হোসেন খালেদ বর্তমানে আনোয়ার গ্রুপকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আনোয়ার হোসেনের জীবদ্দশায় ইচ্ছা ছিল, তাঁর প্রতিষ্ঠানে ২০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। তিনি থাকাকালে ১৪ হাজারের মতো হয়েছিল। পরে তাঁর ছেলেরা সেটিকে ২০ হাজারে উন্নীত করেন।
বছর দুয়েক আগে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় বাবা আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে কথা বলেন মানোয়ার হোসেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাবা ঘুরতে বেশ পছন্দ করতেন। পুরো বাংলাদেশ ওনার নখদর্পণে ছিল। কোন গলিতে কার দোকান, তাঁর মোটামুটি মুখস্থ ছিল। প্রতিদিন তিনি কারখানায় যেতেন। আমি সঙ্গে থাকলে বলতেন, “আমি আমার লোকজনকে দেখে রাখলে তারা আমার কারখানা দেখে রাখবে। আমি তো আসব আধা ঘণ্টা-এক ঘণ্টা বড় জোর দুই ঘণ্টা। মিল তো থাকবে ওদের হাতে। ফলে ওদের দেখে রাখবা।”’
মানোয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘বাবা প্রায়ই একটা উপদেশ দিতেন, “কালকের কাজ আজকে। আজকের কাজ এক্ষুনি। অফিস থেকে যখন যাবা, তখন টেবিল খালি করে দিয়ে যাবা। তুমি এক মানোয়ার একটা কাগজে সই না করলে হয়তো ৫০০ লোকের বেতন হবে না। নয়তো একটি মেশিন চলবে না।” উপদেশটি মেনে চলার চেষ্টা করি। বাবা শ্রমিকের সঙ্গে খুব কথা বলতেন। সব সময় কাজটি করতে পারি না। তবে মাঝেমধ্যে চেষ্টা করি।’
শেষ কথা
আনোয়ার হোসেন নিজের আত্মজীবনী লিখেছেন, যার নাম আমার আট দশক। তিনি পছন্দ করতেন ঘুরে বেড়াতে। পুরো বাংলাদেশের পাশাপাশি বহু দেশ ঘুরেছেন তিনি। গান শুনতেন, সিনেমা দেখতেন। প্রিয় খেলা ছিল কাবাডি। নিজের তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও সন্তানদের দেশে-বিদেশে পাঠিয়ে উচ্চশিক্ষা দিয়েছেন।
আনোয়ার হোসেনের পছন্দের খাবার ছিল চিংড়ির দোপেঁয়াজি আর গরুর মাংসের কোপ্তা। পুরান ঢাকার রশীদ দেলওয়ালের ফালুদা, লাসানীর শিক কাবাব, ইসলামপুরের শানু পালোয়ানের মোরগ পোলাও, চকবাজারের লতিফের তেহারিও ছিল তাঁর পছন্দের তালিকায়।
আনোয়ার হোসেনের জন্ম হয়েছিল ১৯৩৮ সালে। তাঁদের পারিবারিক ব্যবসার শুরু এরও ১০৪ বছর আগে, ১৮৩৪ সালে। ওই বছর তখনকার কুণ্ডু রাজার কাছ থেকে চকবাজারে বছরে এক টাকা খাজনায় একটি ভিটা ইজারা নেন আনোয়ার হোসেনের দাদা লাক্কু মিয়া (আসল নাম লাট মিয়া)। এখন আনোয়ার হোসেনের পরিবারের ব্যবসার বয়স দাঁড়িয়েছে ১৮৫ বছর। দেশের শীর্ষস্থানীয় এই ব্যবসায়ী গত ১৭ আগস্ট রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
আনোয়ার হোসেন নিজের আত্মজীবনীর শেষ অনুচ্ছেদের নাম দিয়েছেন ‘শেষের কবিতা’, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাসের নামে। সেখান থেকে উদ্ধৃত করেছেন তিনটি লাইন, ‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান; গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়। হে বন্ধু, বিদায়।’
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ নভেম্বর ১৭, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,