লেখক:সানাউল্লাহ সাকিব।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকেভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এই সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথরচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তাঁরাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।
১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো দেশ গার্মেন্টস ও রিয়াজ গার্মেন্টস শার্ট সরবরাহের ক্রয়াদেশ পায়। কিন্তু হাতে তো টাকা নেই, কাঁচামাল দেবে কে? শার্ট তৈরি হবে কীভাবে। কাঁচামাল কিনতে ঋণ চাইলে ব্যাংকও অপারগতা জানায়। দুই প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে। অনেক দেনদরবারের পর চালু হয় ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি বা ঋণপত্র। যেখানে শার্টের ক্রয়াদেশের বিপরীতে চালু হয় নতুন করে অর্থায়ন সুবিধা। যা দিয়ে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আনা যায়। পোশাক রপ্তানি হলে পুরো আয় আসবে ব্যাংকে, শোধ হয়ে যাবে ঋণের টাকা। বাকি টাকা যাবে পোশাক কারখানার মালিকের হিসাবে।
এমন এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত এসেছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এম নূরুল ইসলামের সময়ে। ওই সময়ে পোশাক খাতে চালু হয় বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা। যার মাধ্যমে বিনা শুল্কে পোশাকের কাঁচামাল আনার সুযোগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের পোশাক খাত এখন যে স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার মূলে রয়েছে এই দুই সিদ্ধান্ত। আর এতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা এম নূরুল ইসলামের। এর সঙ্গে অবশ্য আরেকজনের নাম নিতেই হয়। আর তিনি হলেন মোহাম্মদ নুরুল কাদের।
আমরা জানি, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল পাট, যা মূলত কৃষিপণ্য। বিশ্বব্যাপী পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা কমতে থাকায় রপ্তানি বাণিজ্যে সংকট উত্তরোত্তর বাড়ছিল। সেখান থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করে পোশাকশিল্প। ১৯৭৮ সালের ২৮ জুলাই ফ্রান্সে প্রথম ১০ হাজার শার্ট রপ্তানি করে রিয়াজ গার্মেন্টস। আর একই বছর দেশে প্রথম ১০০ ভাগ রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা দেশ গার্মেন্টস গড়ে তুলেছিলেন নুরুল কাদের। ১৯৮০ সালের রপ্তানি নীতিতেই প্রথম পোশাক খাতকে বছরের রপ্তানি পণ্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
সেই পোশাক খাত থেকেই এখন রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে, কর্মসংস্থানের দিক থেকেও পোশাক খাত শীর্ষে। পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। তবে দুটি সরকারি নীতি না থাকলে পোশাক খাত আজকের এই অবস্থানে আসতে পারত কি না, সে প্রশ্ন করাই যায়। এই দুই নীতি হচ্ছে বিলম্বে দায় পরিশোধের ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা এবং বিনা শুল্কে কাঁচামাল আমদানি করার বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা। দক্ষিণ কোরিয়ায় এই সুবিধা চালু ছিল। দেশ গার্মেন্টসের উদ্যোক্তা নুরুল কাদের চেয়েছিলেন বাংলাদেশেও তা চালু হোক। আর এই দুই সুবিধা সরকারি নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার কৃতিত্ব সে সময়ের বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এম নূরুল ইসলামের। এই দুই সুবিধা পোশাক খাতে বিপুলসংখ্যক উদ্যোক্তা সৃষ্টি করেছিল। বড় অঙ্কের পুঁজি ছাড়াই যে একটি পোশাক কারখানা তৈরি করে রপ্তানি করা যায়, এটা সম্ভব করেছিল সরকারের ওই দুই সুবিধা বা নীতি।
শুধু পোশাক খাতে নয়, যে প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই রেখেছেন এমন কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে দিতে যেসব সিদ্ধান্ত বড় ভূমিকা রেখেছে, তাঁর অনেক ক্ষেত্রে ছিল এম নূরুল ইসলামের ছোঁয়া।
এম নূরুল ইসলামের বাবা আবুল বাশার ছিলেন সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। আবুল বাশার ও ওমদাদুননেছা খাতুন দম্পতির ১১ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন নূরুল ইসলাম। আর চতুর্থ সন্তান দেশের প্রথম অর্থসচিব মতিউল ইসলাম। নূরুল ইসলাম ২০০৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর ইহজগৎ ছেড়ে যান। তাঁর ছোট ভাই মতিউল ইসলামের বয়স এখন ৯২ ছুঁই ছুঁই।
মতিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি সদ্য স্বাধীন দেশের অর্থনীতিতে যেসব উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল, নূরুল ইসলাম তার অনেকগুলো শুরু করেছিলেন। বাকিতে পণ্য আমদানি উদ্যোগটি ছিল তাঁর। পোশাক রপ্তানির বড় দ্বার উন্মোচন করেছিলেন। কম সুদের আবাসন ঋণ চালু করে মধ্যবিত্তদের মৌলিক চাহিদা পূরণে উদ্যোগ নিয়েছিলেন।’
নূরুল ইসলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে পরিচিত হলেও এর আগে তিনি ছিলেন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান। দেশ স্বাধীনের আগে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে একাধিক সরকারি দপ্তরে কাজ করেন। সততা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতার জন্য সব ক্ষেত্রেই সুনাম ছিল তাঁর।
এম নূরুল ইসলাম ১৯৪৬ সালে বরিশালের বিএম কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৪৭ সালে কলকাতায় যান। তবে সেখানকার পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি, অর্থসংকটও ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ফিরে আসেন। এরপর বরিশাল জিলা স্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হন। তবে তিনি মাস্টার্স শেষ করেননি। কারণ, ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।
পেশাগত এই জীবনে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রক হয়েছিলেন। এই সংস্থার প্রধান হওয়ার সুবাদে সব সময় ছিলেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পক্ষে। বাঙালি ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দিচ্ছেন বলে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। তৎকালীন বাণিজ্যসচিব নূরল ইসলামকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিরক্ত হয়ে নূরল ইসলাম নিজেও বদলি করার জন্য চিঠি লিখেছিলেন। তবে সে সময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী কেবল যে নূরল ইসলামকে পদে রেখে দিয়েছিলেন তা–ই নয়, রাগ কমাতে নিজের কারখানায় উৎপাদিত এক ব্যাগ চিনিও উপহার পাঠিয়েছিলেন।
আর দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে তাঁকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময় তাঁকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দিতে সুপারিশ গেলে বঙ্গবন্ধু টিসিবি চেয়ারম্যান পদেও রেখে দেন, পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান পদেরও দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৬ সালে গভর্নর পদে নিযুক্ত হন এম নূরুল ইসলাম। তিনি ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কেউ এতটা বছর এই পদে ছিলেন না।
এই সময়ে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে একের পর এক সিদ্ধান্ত। এতে ‘ডেফার্ড পেমেন্ট’ সুবিধার আওতায় পণ্য আমদানির পর বিল পরিশোধের সুবিধা চালু হয়। এই সুবিধা তখন অর্থনীতি ভিত্তি শক্তিশালী করতে বড় ভূমিকা রাখে। কারণ, তখন আমদানি বিল পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত ডলার ছিল না।
এম নূরুল ইসলাম যে শুধু ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করেছেন, তা নয়; সাধারণ মধ্যবিত্তদের কথা চিন্তা করে ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ফ্ল্যাট কিনতে সহজ ঋণসুবিধা চালু করে। যা দিয়ে ১৫০০ বর্গফুট পর্যন্ত ফ্ল্যাট কিনতে ঋণ দেওয়া হতো, সুদহার ছিল ৫ শতাংশ। আর ঋণের মেয়াদ ছিল ৩০ বছর। তাঁর মেয়াদেই দেশের প্রথমবারের মতো বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৩ জুলাই থেকে ১৯৮৭ সালের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত গভর্নর ছিলেন।
এম নূরুল ইসলামের এক মেয়ে ও দুই ছেলে। তাঁর বিষয়ে মতিউল ইসলাম বলেন, ‘এখনো অনেকে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন নূরুল ইসলামের ভাই হিসেবে। আমি যে প্রথম অর্থসচিব, পরে শিল্পসচিব ছিলাম; সেই পরিচয় অনেকেই ভুলে যান। আমিও নিজেকে নূরুল ইসলামের ভাই হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। সততা, সাহস ও বিচক্ষণতা তাঁকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।’
মতিউল ইসলাম বলেন, ‘নূরুল ইসলাম ছিলেন মৃদুভাষী। গভর্নর পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর তেমন কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন না। নিজেকে বড় করে কখনো পরিচয় দিতেন না।’
স্মৃতিচারণা করে মতিউল ইসলাম বলেন, ‘একবার একজন ব্যবসায়ী তাঁকে একটি প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছিল। তিনি পরে দেখতে পান, সেখানে স্বর্ণের ঘড়ি। এটা নিয়ে কোনো হইচই না করে বা কাউকে না জানিয়ে নিজের ছেলের মাধ্যমে তা ফেরত পাঠিয়েছেন। এটাই ছিল নূরুল ইসলামের চরিত্র।’
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ নভেম্বর ১৬, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,