অনুবাদে: ইললু।
অষ্টম অংশ
এই প্রশ্নটা শোনার ইচ্ছাটা একেবারেই ছিল না তার,এ ধরণের প্রশ্ন তাকে সবসময় দূরে ঠেলে দেয়,নিয়ে যায় তাকে অজানায়।কি উত্তরই বা দিতে পারে সে?
“আমি একটা নাইট ক্লাবে কাজ করি”।
তার কাঁধের থেকে বিরাট এক বোঝা নেমে গেল,সুইজারল্যান্ডে আসার পর এমন কি আর জানা তার,প্রশ্নগুলো(কুর্দরা কে?সান্তিয়াগোতে যাওয়ার পথটা কি?),আর সহজ উত্তরটাই ভাল (আমি এক নাইট ক্লাবে কাজ করি),কে কি ভাববে সেটা না ভেবে।
“আমার মনে হয় আমি তোমাকে আগে দেখেছি,তোমাকে আগেও দেখেছি কোথাও”।
অনুভব করলো সময়টাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে লোকটা,এটা তো তারই বিজয় পর্ব।কিছুক্ষন আগেই নিশ্চুপ হয়ে সে শুনছিল তার কথা,মনে হচ্ছিল লোকটাযেন জানা তার চাওয়া পাওয়ার গল্পটা।বদলে গেছে এখন সেটা,লোকটা আর কজনের মত,মেয়েদের সামনে জড়সড় কি বলা যায় না বলা যায় এ চিন্তায় বিব্রত।
“কিসের বই ওগুলো”।
খামার সমন্ধে,বইগুলো লোকটাকে দেখালো সে।লোকটা যেন আরও বেশ কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়লো।
“তুমি কি শরীর নিয়ে ব্যাবসা কর”?
শেষ পর্যন্ত মানুষটা তার আসল চেহারাটা দেখালোই।সে কি পোষাকআষাকেও একটা পতিতা?যাকগে,তার সময় কাটানো দরকার।এটা মজার একটা খেলা,এই খেলাটায় মারিয়ার হারানোর কিইবা আছে?
“পুরুষেরা কি শুধু ঐ কথায় ভাবে,আর কোন কিছু মনে আসে না তাদের”?
বইগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে লোকটা বললো,
“যৌনবিহার আর খামারের ব্যাবসা দুটোই একেবারে,নিরস”।
কি?এবার তার পালা,এত সাহস কি করে হলো লোকটার তার কাজ নিয়ে কথা,এর একটা যথাযথ উত্তর দেয়া দরকার।
“ছবি আঁকার চেয়ে নিরস আর কিছু আছে কি?কোন প্রান নেই তাতে,সময়ে আটকে থাকা একটা সময়,সত্যিকারের ছবিটার সাথে খেলা করা অন্য আরেক কিছু।প্রানহীন এক আকাশ, শিল্পীদের ছাড়া আর কারও আগ্রহ নেই যেটাতে।শিল্পীর দল যারা নিজেদের মনে করে সংষ্কৃতির পতাকাবাহক,জানা নেই তাদের বাইরে একটা পৃথিবী আছে আরও।জোয়ান মিরোর নামটা কি জানা আছে তোমার?আমার জানা ছিল না,এক আরব ভদ্রলোক আমাকে জানানোর আগে।কিন্ত নামটা জেনে আমার জীবনের কোন কিছুই বদলায়নি,আমি যাইনি কোন নতুন আনন্দের আকাশে”।
ভাবলো মারিয়া বলাগুলো বেশি হয়ে গেল কি,না?থেমে গেল কথাবার্তা,ককটেল এসে পৌঁছালো সেই মুহুর্তে।চুপচাপ বেশ কিছুক্ষন দুজন,এক সময় মারিয়া ভাবলো,এখন যাওয়ার সময়।কিন্ত তাদের আটকে রেখেছে দু গ্লাস বিস্বাদ ককটেল।
“খামারের ব্যাবসার বই কেন”?
“কি বলতে চাচ্ছ,তুমি”?
“আমি গিয়েছি রু ডে বার্নে বেশ কবার।তুমি যখন বললে তুমি নাইট ক্লাবে কাজ কর,মনে পড়লো দেখেছি তোমাকে বেশ নামী দামী এক ক্লাবে।ছবি আঁকার সময় সেটা মনে হয়নি,
তোমার মনের আলোটা তখন আমাকে অভিভুত করে রেখেছে”।
মারিয়ার মনে হলো সরে গেছে তার পায়ের নীচের মেঝেটা,এই প্রথম তার কাজ অদ্ভুত একটা গ্লানি এনে দিল তার মনটায়,যদিও সে কাজ করছে তার সংসারের জন্য।আসলে তো লজ্জা পাওয়া উচিত ঐ লোকটার রু ডে বার্নে আনন্দ খুঁজতে গিয়েছিল যে,এই সাক্ষাৎ এর চমকটা যেন হারিয়ে গেল কোথাও।
“শুনুন হার্ট সাহেব,যদিও আমি ব্রাজিলিয়ান,সুইজারল্যান্ডে আমি আছি প্রায় ন মাস,তবে এটুকু জানি এটা একটা ছোট্ট দেশ বলেই এতটা নিয়মতান্ত্রিক।এখানে যেন সবাই সবাইকে চেনে,সেটা আমরাও বুঝতে পারলাম।তোমার ড্রিঙ্ক,তবুও আমি সেটা সবটুকুই খেয়ে উঠবো।
তারপর একটা সিগারেট খেয়ে এখান থেকে চলে যাব।আপনি যদি চান,যেতে পারেন আপনি।
একজন নামকরা শিল্পী আর সাধারণ এক বেশ্যা একই টেবিলে বসে থাকাটা মানায় না।আমি একটা বেশ্যা,পা থেকে শুরু করে মাথা পর্যন্ত-আমি একজন বেশ্যা,কে জানলো না জানলো আমার কিচ্ছু যায় আসে না তাতে।ওটাই আমার গুন,দোষ যেটাই মিথ্যা বলতে চাই না আমি নিজেকে না,অন্য কাঊকেও না।কোন লাভ নেই,মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে।ভেবে দেখ ঐ নাম করা কেমিষ্ট জানতে পারতো আমি কি করি,তবে তোমার অবস্থাটা কি হতো”?
বেশ আন্তরিকতায় একটু উঁচু স্বরেই কথাগুলো বললো,সে।
“হ্যা,আমি একজন বেশ্যা।হয়তো তুমি এটা জাননা-আমি মুক্তি দিয়েছে নিজেকে।আর মাস তিনেকের মধ্যে ছেড়ে যাব,তোমাদের এই অসহনীয় জগতটা।ফিরে যাব জীবনের অনেক কিছু জানা নিয়ে,টাকাপয়সা আমার ইচ্ছেমত খরচ করার জন্যে,পুরুষ জগতটাকে কিছুটা আয়ত্বে আনার জ্ঞানও সাথে”।
ভঁয়ে কাতর হয়ে শুনছিল ওয়েটারটা,কেমিষ্ট ভদ্রলোক আত্মমগ্ন।হয়তো সে না হলেও,তার নেশার মনটা কথা বলছিল,না হয় হয়তো শুনে যাচ্ছিল ব্রাজিলের স্বাধীন মেয়েটার মনের কথা।
“বুঝতে পারছেন,হার্ট সাহেব?আমি একটা বেশ্যা,পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা বেশ্যা,আর সেটাই আমার সবচেয়ে বড় গুন”!কোন উত্তর দিল না লোকটা,সরেও গেল না।মারিয়ার মনবল ফিরে আসছে।
“তুমি একজন শিল্পী যার ধারণা নেই কোন তার নিজের মডেলদের সমন্ধে।ঐ চেয়ারে বসে থাকা যাকে কেমিষ্ট বলা হচ্ছে,হয়তো সে কোন রেল শ্রমিক।হয়তো তোমার ছবির লোকগুলো কেউই যা না,যে ভাবে তুমি তাদের তুলে ধরেছ তোমার ছবিতে।বুঝতে পারলাম না কি ভাবে দেখলে তুমি, ‘মনের আলো’,যার ছবি আঁকতে গিয়ে জানলে,সে এক সাধারণ বে…শ্যা…’’।শেষের কথাগুলো ছিল বেশ ধীরে তবে উঁচু স্বরে,কেমিষ্ট যেন তার নেশা থকে জেগে উঠলো,ওয়েটারটা বিলটাও নিয়ে এলো।
“এটার সাথে দেহব্যাবসার কোন সম্পর্ক নেই,তবে তুমি একজন নারী হিসেবে অন্যনা”।রালফ পাশে রাখা বিলটার কথা ভুলে গিয়ে বললো, “তোমার চারপাশটায় একটা আলো ছড়িয়ে আছে,আলোটা ছুটে আসা তোমার মনের দৃঢতায়,চলার পথের হার না মানা একটা মানুষের।
আলোটা লুকোনো তোমার চোখে-চোখ ছিটকে আলোটা বেরিয়ে আসা চারপাশটায়”।
কিছুটা হতভম্ব মারিয়া,বিতর্কে থেকে সরে গেল লোকটা,তার বিশ্বাস ছিল লোকটা তাকে যৌনবিহারের জন্যে নিয়ে যেতে চাচ্ছে,কিন্ত হয়তো তা নাও হতে পারে।মাস তিনেক তার চিন্তা করার কোন কারণ ছিল না-এই পৃথিবীতেও আছে মানুষ যারা তোমাকে নিয়ে যায় ভাবনার তৃতীয় মাত্রায়।
“তোমার সামনে ঐ যে ককটেল আনিসেটের গ্লাসটা দেখছ,তুমি দেখছ শুধুই একটা ড্রিঙ্ক,কিন্ত আমার মন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ওর রহস্যগুলো,ওর উৎস,আনুষাঙ্গিকতার কথাগুলো।যে গাছের রস দিয়ে সেটা তৈরী,ঝড়ো হাওয়ায় সাথে তার যুদ্ধের কাহিনী,সুর্যের প্রখরতা,শৈত্য প্রবাহে নিজেকে টিকিয়ে রাখা,যে হাতটা তুলে নিয়ে পৌঁছিয়ে দিল এই গ্লাসে।আমাকে যদি একটা ছবি আঁকতে হয়,আঁকতে হবে তার সবটাই,যদিও তোমার চোখে সেটা শুধুই এক গ্লাস আনিসেট”।
“তুমি যখন রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলে-জানি তুমি ভাবছিলে সান্তিয়াগো যাওয়ার পথটা নিয়ে,আমি আঁকছিলাম তোমার ফেলে আসা জীবনটা,ছোটবেলার গল্পটা,যৌবন ছোঁয়ার সুর,
ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নের কান্না,আগামীর আকাশ-তোমার দৃঢতা,মনবল যা আমাকে অবাক করেছে।তুমি যখন তোমার ছবিটা দেখলে…”।
মারিয়া ফিরে গেল তার যুদ্ধের চেহারায়,এটা জেনেও বদলানো সহজ হবে না তেমন একটা।
“…আমি সেই আলোটাই দেখেছি…যদিও আমার সামনে ছিল শুধু একটা মেয়ে যে দেখতে তোমার মতন”।
আবার সেই নিস্তব্ধতা,মারিয়া তার ঘড়ির দিকে সময়টা দেখে নিল।
“কিছুক্ষনের মধ্যে চলে যেতে হবে,আমাকে।যাকগে জানতে চাই,তোমার কি মনে হয় যৌনতায় আনন্দ নেই কোন,ওটা কি শুধুই একটা শরীর খেলার একটা নিরস গল্প”।
“আমার চেয়ে ওটা তোমারই ভাল জানা দরকার”।
“আমি জানি এই জন্যে ওটা আমার কাজ,আমার প্রতিদিনের গল্প।কিন্ত তুমি তিরিশ বছরের একটা যুবক…”।
“উনত্রিশ…”।
“…যুবক,দেখতে শুনতে বেশ ভাল,নামডাক আছে,কেন তার আর্কষন হবে বারবনিতায়,
তার রু ডে বার্নে সঙ্গী খুঁজতে যাওয়ায় অবাক হওয়ারই কথা”।
“আমি তোমার বেশ কজন সহকর্মিনির সাথে যৌনবিহারও করেছি,তবে এমন না যে আমার মেয়ে বান্ধবীর অভাব,সমস্যাটা লুকোনো আমার মধ্যেই”।
ঈর্ষার এক স্রোত এসে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিয়ে গেল মারিয়াকে,ভঁয়ে কাতর হয়ে চলে যেতে হবে তাকে।
“ওটাই ছিল আমার শেষ চেষ্টা,আমি এখন সবকিছু বির্সজন দিয়েছি,আমি”,বললো রালফ,চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ছবি আঁকার সরঞ্জাম তুলতে তুলতে।
“কোন শারীরিক সমস্যা আছে তোমার”?
“তা,না,আমার কেন জানি কোন উৎসাহ নেই।শরীরের খেলায়”।
ওটা তো সম্ভব নয়।
“বিলটা দিয়ে চলো বাইরে ঘুরে আসি।আমার মনে হয়,অনেক মানুষের একই ধরণের অনুভুতি,সমস্যা আছে,তবে তাদের বলার সাহসটা নেই।একজন সৎ লোকের সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়ে ভালই লাগছে”।
তারা সান্তিয়াগো যাওয়ার পথটা ধরে হেঁটে গেল,প্রথম দিকটায় একটু চড়াই আবার উতরাই,লেকের ধার দিয়ে পাহাড়ে,সেখান থেকে চলে যাওয়া স্পেনে।তাদের পাশ দিয়ে লোকজন ছুটে যাচ্ছে লাঞ্চ খেতে,মায়ের দল তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে,বেড়াতে আসা লোকজন ছবি তুলছে লেকের ধারে,মাথায় ঘোমটা দেয়া মুসলমান মেয়েরা-সবাই যেন তীর্থযাত্রী খুজছে হারিয়ে যাওয়া শহরটা,“সান্তিয়াগো ডে কম্পোসটেলা”,হয়তো যার কোন অস্তিত্ব নেই,হয়তো একটা স্বপ্ন যা দরকার বেঁচে থাকার যুদ্ধে।এ পথ দিয়ে কত লোকই না হেঁটে গেছে,হেঁটে গেছে ঐ তিরিশ বছরের লম্বা চুল লোকটাও,সাথে তার ভারী ব্যাগটা,ভঁরা ছবি আঁকার ব্রাশ,ক্যানভাস,পেন্সিল,আর একটা মেয়েটা তার হাতে খামার ব্যাবসার বইটা।
কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করে না,কেন যায় তারা তীর্থযাত্রায়,ওটাই যে স্বাভাবিক,তার পাশের লোকটা যেন তাকে চেনে সম্পুর্ন,কিন্ত তার জানা নেই কিছু লোকটার।
ঠিক করলো,মারিয়া জানা দরকার লোকটাকে-আর উপায় হলো প্রশ্ন করা।যদিও একটু লজ্জা পেল লোকটা,তবে মারিয়া জানে কি ভাবে কথাগুলো বের করে নেয়া যায়।লোকটা বললো,দু বার বিয়ে করেছে সে(উনত্রিশ বছরের লোকের জন্য রেকর্ড),অনেক জায়গায় ঘোরাফেরা করেছে,বেশ কিছু নাম করা লোকের সাথে আলাপ হয়েছে তার।জন্ম জেনেভায়,যদিও বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছে মাদ্রিদ,আর্মেষ্টাডাম,নিউইয়র্ক আর দক্ষিন ফ্রান্সের একটা শহর,
টারবেসে।টারবেস,একটা পাহাড়ী জায়গা,তার পচ্ছন্দের জায়গা-খোলা আকাশের মানুষগুলোও বেশ আন্তরিক।বছর কুড়ি বয়সে তার খ্যাতি শিল্পী হিসেবে,আর্ট গ্যালারীর এক মালিক জাপানী রেস্তোরায় তার আঁকা ছবিগুলো দেখে মুগ্ধ হয়েছিল,তার সূযোগের প্রথম পদক্ষেপ।
অনেক টাকাপয়সা উর্পাজন করেছে সে,যেখানে যাওয়ার ইচ্ছা গিয়েছে,মিশেছে অনেক মেয়েদের সাথে,খুজে পায়নি সুখ-একটাই আনন্দ তার জীবনে,কাজ।
“কোন মেয়ে কি তোমাকে মানসিক কষ্ট দিয়েছে”?,প্রশ্ন করেই তার মনে হলো বড় বোকার মত হয়ে গেল কথাটা,যেন পুথির ভাষায় লেখা,তবে সবকিছু যে জানা দরকার তার পচ্ছন্দের মানুষটার।
“না,না, কেউ আমাকে দেয়নি মানসিক কষ্ট,সুখীই ছিলাম আমার বিবাহিত জীবনে।আমি ঠকিয়েছি তাদের,তারাও ঠকিয়েছে আমাকে,আর দশটা বিবাহিত সংসারের গল্প,তেমন নতুন কিছু না।তারপর কেন জানি আমি হারিয়ে ফেললাম যৌনসঙ্গমের উৎসাহ,কেমন যেন পানসে হয়ে গেল শরীরের গল্প।ভালবাসা খুঁজেছি আমি,আর খুঁজিনি শরীর…কিন্ত তুমি যৌনসঙ্গমের কথা বলছ কেন”?
“কারণটা তুমিই তো বলেছ,আমি একজান বেশ্যা,একজন দেহ ব্যাবসায়ী,ওটা তো আমারই এলাকা”।
“যদিও অবিশ্বাস করছ,আমার জীবনটা একেবারেই নিরস।কমবয়সেই আমি খ্যাতি পেয়েছি,শিল্পীদের ক্ষেত্রে যেটা অসাধারণ ব্যাপার।যা কিছুই আঁকি না আমি,সেটা বেশ দামেই বিক্রি হয়,সমালোচকদের মাথা খারাপ করে দেয় তা,তাদের ধারণা ‘শিল্প’ কথাটার অর্ন্তনিহিত ভাষাটা শুধু তাদেরই জানা।অনেকে ভাবে,আমার আঁকা ছবিতে লুকিয়ে আছে গভীরতা যা শুধু জ্ঞানী বোঝার চোখে ধরা পড়ে,যত কম কথা বলি,,ততই সবাই জ্ঞানী ভাবে আমাকে”।
সে বলে চললো তার জীবনের কথাগুলো,প্রতিনিয়ত তার শিল্প শিল্পী সমাজে আমন্ত্রনের কথা।তার একজন এজেন্টও আছে-থাকে বার্সিলোনায়।জানা আছে কি তার বার্সিলোনা কোথায়?
হ্যা,মারিয়া জানে,
তার এজেন্ট মোটামুটি সবকিছুই করে-আমন্ত্রন,টাকাপয়সা,ছবির এক্সজিবিশন,কিন্ত কোনদিনই তাকে কোন ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করেনি,তার ছবির বেশ একটা ভাল চাহিদাও আছে।
“আমার জীবনটা কি তোমার কাছে আর্কষনীয়,মনে হয়”?গলার স্বরটা একটু কেঁপে যাচ্ছিল
“অবশ্যই,সাধারণ হিসেবে বাইরের একটা জীবন,অনেকেই চাইবে তোমার জায়গায় পৌঁছাতে,
`তোমার ঐ জীবনটা খুঁজে নিতে”।
রালফের জানার ইচ্ছা ছিল,মারিয়া সমন্ধে।
“আমার মাঝে লুকোনো আমার তিনজন,নির্ভর করে আমি কার সাথে কি ভাবে আছি,আর বের হয়ে আসে তাদের একজন।সাধারণ সরল মেয়েটা অবাক হয়ে থাকে,পুরুষের শক্তি,চমকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে।তারপর ডাইনী মেয়েটা পুরুষদের ওপর ভর করে ছিনিয়ে নিতে চায় তাদের মানসিক শক্তি,তাদের করে ফেলে অসহায়।তারপর মায়ের চেহারা যে ধৈর্য ধরে শুনে যায় সবার কান্না,উপদেশ দেয় তাদের।কার সাথে দেখা করতে চাও তুমি”?
“তোমার সাথে”।
সবকিছুই বললো তাকে,মারিয়া,বলার যে দরকার ছিল তার-ব্রাজিল ছেড়ে আসার পর প্রথম কাউকে মন উজাড় করে বলা।মনে হলো তার জীবনটাও বেশ নিরস- রিও ডি জেনোরোর কটা দিন,সুইজারল্যান্ডের প্রথম মাসটা ছাড়া।তা ছাড়া কাজ,বাড়ী-বাড়ী,কাজ,এটাই তো তার জীবনের গল্প।এর মাঝে তারা বসে ছিল আরেক বারের এক লুকোনো কোনায়,সান্তিয়াগো ছাড়িয়ে অনেক দূরে,জানা নেই নিয়তি নিয়ে যাবে কোথায়।
“আমার বলায় কিছু ফাঁক থাকলো,কি”?
“কি ভাবে বলা যায়,হয়তো দেখা হবে আবার,হয়তো নতুন তোমাকে জানা যাবে”।
তা ঠিক,এটাতো তার জীবনের যে কোন একটা বিকাল না,খুলে দেওয়া দরজাটা বন্ধ করার উপায়টা তো জানা নেই তার।
“শেষ হলে ছবিটা কি দেখা সম্ভব হবে”?
রালফ,বার্সিলোনা এজেন্টের একটা কার্ড তুলে দিল তার হাতে।
“মাস ছয়েক পরে ফোন করো,যদি ইউরোপে থাক।জেনেভার মুখগুলো-চেনা অচেনা,সাধারণ নামী দামী।বার্লিনে প্রর্দশিত হবে প্রথম,তারপর দেখা যাবে সারা ইউরোপে”।
মারিয়ার মনে পড়লো তার ক্যালেন্ডারের কথা,আর আছে তার নব্বই দিন,তিন মাস,এর মাঝে কোন সম্পর্ক যোগাযোগ তৈরী করা,তার জন্যে ক্ষতিকর।
সে ভাবলো, “জীবনে কোন জিনিষটার প্রয়োজন বেশি,বেঁচে থাকা,না বেঁচে থাকার ভান করা।সাহস করে এগিয়ে বলবে নাকি,সেটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় একটা সন্ধ্যা।তাকে ধন্যবাদ জানাবো,আমার কথাগুলো কোন মন্তব্য বা পরিহাস ছাড়া শোনার জন্যে?নাকি মনবলের, ‘আলোছড়ানো’ একটা মেয়ের মত কিছু না বলে হেরে যাব”?
সান্তিয়াগোতে যাওয়ার পথটায় হাঁটতে হাঁটতে লোকটার জীবন কথা শোনার সময়টা,মারিয়ার জন্যে ছিল একটা চরম আনন্দের সময়,।ওটা তো তার জীবনের বিরাট এক পাওয়া,জীবন যুদ্ধের অন্ধকারে এক মশাল।
“আমি তোমার সাথে দেখা করতে আসবো”।
“ না,না,এসো না।খুব শীঘ্রীই ব্রাজিল আমি,ফিরে যাব।আমাদের একজনের আরেকজনকে দেয়ার মত আর কিছুই নেই”।
“আমি তোমার একজন খদ্দের হিসেবে আসবো”।
“সেটা হবে আমার জন্যে অপমানজনক আর লজ্জার ব্যাপার”।
“আমি তোমার কাছে আসবো,আমার নিজেকে রক্ষা করার জন্যে”।
সে তো আগেই বলেছিল যৌনসঙ্গমে তার অনীহার কথা।
সে বলতে চাইলো যৌনতায় তারও অনীহা-কিন্ত থেমে গেল,অনেক কিছুতেই না বলা ছিল তার,হয়তো এখন নিস্তব্ধতাটায় মানান সই।
কি করুন এক দৃশ্য!সেই ছোট্ট ছেলেটার সাথে আবার দেখা হলো,এখন আর পেন্সিল চায় নি সে,দরকার তার সঙ্গ।পেছনে দিকে তাকিয়ে নিজেকে ক্ষমা করলো সে,দোষটা তার ছিল না,অত সহজেই ছাড়ই বা দিল কেন ছেলেটা।এমন কোন বয়স ছিল না তাদের,অত সহজেই পালিয়ে গেল,সাহস না থাকলে সাহস কি তৈরী করা যায়।
ওটাই তো জীবন,মানুষের এক অংশ খুঁজে যাওয়া তার আরেক অংশকে।অনেক কিছুই বদলে যাওয়া,কারণগুলো যাই হউক না কেন(আমি ব্রাজিলে ফিরে যাচ্ছি,আমি একটা ক্লাবে কাজ করি,তেমন একটা জানাশোনা নেই আমাদের,যৌনবিহারে ইচ্ছা নেই আমার,ছবি-ছবি আঁকা সমন্ধে কোন ধারণা নেই আমার,আমরা দুজনে দুটো আলাদা জগতের মানুষ),আমার সামনে যে বিরাট এক যুদ্ধ।সে তো আর সেই ছোট বেলায় নেই,তাকে বেছে নিতে হবে তার কি করা দরকার।
মারিয়ার ডাইরী থেকে নেয়া,একই দিনে লেখাঃ
“আজকে আমরা যখন লেকের ধার দিয়ে,সান্তিয়াগো যাওয়ার রাস্তাটা দিয়ে হাটছিলাম,সাথে ছিল একজন শিল্পী-তার অভিজ্ঞতা,দেখার চোখ আমার চেনা মানুষদের চেয়ে সম্পূর্ন আলাদা।একটা পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলাম লেকের জলে,ছুটতে ছুটতে একটা বৃত্ত করে পাথরটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল।সেই এক বৃত্তের থেকে এলো ছোট,ছোট আরও কটা বৃত্ত, যা একসময় ছুয়ে গেল ভেসে যাওয়া একটা হাঁসকেও,ভয় না পেয়ে খেলা করে গেল,হাঁসটা।
কিছুক্ষন আগে আমি একটা ক্লাবে গিয়েছিলাম কফির জন্যে,বিধাতা কোন অজানা কারণে ছুঁড়ে দিল ঐ ক্লাবে,সেই স্বর্গীয় সুর ছুয়ে গেল আমাকে আর বসে থাকা একজনকে,যে ছবি আঁকছিল।মাতাল করা আনন্দটা ছুয়ে গেল আমাকে আর ঐ শিল্পীকে,এখন কি হবে?
শিল্পী জানে সে কি খুঁজে পায় তার মডেলে,বাদক জানে তার সুরের তারটা ঠিকমত বেধে দেয়া আছে কি না।এই ডাইরীতে আমি জানি অনেক কিছুই লিখেছি আমি যা আমার কথা নয়,কথাগুলো সেই মেয়েটার“মনের আলোটা’ ছড়ানো যার চারপাশে।আমিই সে মেয়েটা কিন্ত বিশ্বাস হয়না আমার।আমি ভেসে যেতে পারি এ স্রোতে,আবার মত্ত হতে পারি হাঁসটার মত খেলায়।
ঐ ছোঁড়া পাথরটার একটা নাম আছে-আবেগ।যার ছোঁয়াচে বদলে গেল দুটো মানুষের সারা জীবন,শুধু তাই কি?নতুন স্বপ্ন নিয়ে নতুন আকাশ খোঁজার গল্প সাজানোর স্বপ্ন তাদের।
আবেগ আমাদের জীবনকে নিয়ে যায় নানান মোহনায়,আমার জানা দরকার আবেগের স্রোত কি বলতে চায় আমাকে।
আমি বিশ্বাস করতে চাই,প্রেমে পড়েছি আমি,এমন একজনের সাথে যার কোন অবস্থানই ছিল না,আমার কল্পনায়।মাসের পর মাস সংযম,ভালবাসায় বিশ্বাস না করার ফলটা দেখি এখন উল্টো,ভেসে গেলাম প্রথম মানুষটার প্রেমে যে একটু অন্য ধরণের।।
তার ফোন নাম্বার আমার কাছে নেই,জানা নেই সে কোথায় থাকে,হারিয়ে গেলে কোন দুঃখ থাকবে না আমার।তা যদি হয়,আমি হারিয়ে ফেলেছি তাকে।একটা সুখের দিন ছিল আমার জীবনে,আর এই পৃথিবীটা যে ধরণের,সেখানে একটা সুখের দিন যে অলৌকিক এক ঘটনা”।
০০০০০০০
কোপাকাবানায় সে রাতে গিয়ে দেখে,লোকটা অপেক্ষা করছে তার জন্যে,একমাত্র খদ্দের,বসে আছে তার জন্যে।মিলান বেশ কিছুটা আগ্রহ নিয়েই চোখে চোখে রাখছিল তাকে-বুঝলো মেয়েটা হেরে গেছে ভালবাসার খেলায়।
“একটা ড্রিঙ্ক নেবে নাকি”?জিজ্ঞেস করলো লোকটা।
“আমি কাজে এখন,আমার চাকরী টা হারাতে চাই না,আমি”।
“আমি তো এখন খদ্দের হিসেবে এসেছি,আর অন্যান্য খদ্দেরদের মতই তোমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছি”।
এই লোকটার প্রতি বিকালের দিকে সে ছিল দৃঢমনা,তুলির আছড় দিয়ে কত সহজেই এঁকে যাচ্ছিল ছবি,বার্সিলোনায় যার এজেন্ট আছে,প্রভুর টাকাপয়সা আছে,এখন সেই যেন ভেঙ্গে পড়া ভঁয়ে।এমন করে ঠিক হয়নি,আসা তার এই অচেনা পৃথিবীতে,এটাতো সান্তিয়াগো যাওয়ার স্বাপ্নিক পথটা নয়।
“খাবে না একটা ড্রিঙ্ক”?
“আরেক দিন হবে,আমার জন্যে খদ্দেররা সব বসে আছে”।
মিলান শুনলো কথাগুলো,তা হলে ভুল ছিল তার বোঝাটা,ভালবাসা কথাটার মায়াজালে জড়িয়ে পড়েনি সে।তবু প্রশ্ন ছিল তার মনে,কেন মেয়েটা বেছে নিল বুড়ো এক একাউন্টেনট,ইনসুরেন্স এর একলোক…।
অবশ্য ওটা,তারই সমস্যা।কমিসন দিলেই হলো,তার বিচার করার কি দরকার,কার সাথে যাওয়া আসা।
মারিয়ার ডাইরী থেকে নেয়া-বুড়ো একাউন্টেন্ট,ইন্সুরেন্স বিক্রেতার গল্পঃ
“এই শিল্পী আমার কাছ থেকে কি চায়?ও কি জানেনা আমরা দুজন আসা,দুটো আলাদা দেশ,দুটো আলাদা জগত থেকে,আলাদা সংষ্কৃতি ভাষাটাও আমাদের?ও কি ভাবে,শরীরের গল্পের কথা,যৌনতার অভিজ্ঞতাটা অনেক বেশী আমার।
অন্য কিছু না বলে,কেন বললো, ‘আমি এসেছি খদ্দের হিসেবে’।খুব সহজেই তো আমাকে বলতে পারতো, ‘বড়ই মনে পড়ছিল তোমাকে,বিকালটা আমার এত ভাল কাটেনি কোনদিন’।আমিও হয়তো বলতাম,(আমি তো একজন পেশাদার),কিন্ত ও তো বুঝতে পারবে না,আমার অসহায় অবস্থাটা,কেন না আমি একটা মেয়েমানুষ,খুব সহজেই ভেঙ্গে পড়ে যারা,কিন্ত আমি যখন ঐ ক্লাবে,আমি যে অন্য আরেকজন।
একজন পুরুষ সে,একজন শিল্পী্তার অন্ততঃ জানা উচিত,মানুষ সারা জীবনটা অপেক্ষা করে কাটিয়ে দেয়,জানার জন্য ভালবাসা কি?অন্যের ভালবাসা না,ভালবাসাটা খুঁজে নেওয়া নিজের মনে,অনেক কষ্টে যাকে জাগিয়ে তুলতে হয়।কিন্ত সেই ঘুম ভাঙ্গানোর জন্যে দরকার আরেকজন,যার সাথে সাজিয়ে নেয়া যায় স্বপ্নগুলো,যে বুঝতে পারে তোমার কান্না হাসির কথা।পৃথিবীটা তখনই মনে হয় পৃথিবি-যখন সুখদুঃখ ভালমন্দ ভাগ করে নেয়া যায় আরেকজনের সাথে।
ও বলছে,ক্লান্ত সে যৌনতায়,ক্লান্ত আমিও,জানা নেই আমরা,আমাদের কি বোঝাতে চাই।জীবনের সবচেয়ে বিশেষ সময়টা হলো মৃত্যুর-ও তো আমাকে বাঁচাতে পারে।আমি তো ওকে বাঁচাতে পারতাম,কিন্ত সুযোগটা পেলাম কোথায়”।
সূত্রঃ চতুর্মাত্রিক।
তারিখঃ অক্টোবর ৩১, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,