১৯৯৮-এর ১৪ অক্টোবরের কাকভোর—
ভোর পাঁচটায় বেজে উঠল অমর্ত্য সেনের ফোন
প্রভাতের প্রথম সূর্য তখনও তার প্রথম কিরণ ভালো ভাবে পৌঁছে দিতে পারেনি পৃথিবীতে৷কাকভোরে ফোন,তিনি ভেবেই বসেছিলেন পরিচিত কেউ নিশ্চয়ই অসুস্থ হয়েছেন,অথবা কিছু একটা খারাপ ঘটনা ঘটেছে বলে এত ভোরে তাঁর কাছে ফোনটা এসেছে৷সম্ভাব্য খারাপ কোনও সংবাদ তাঁর কাছে এসেছে ভেবে তিনি ফোনটা তিনি ধরলেন,ভেঙে গেলো ভুল,জানতে পারলেন অ্যাকাডেমি অর্থনীতিতে অবদানের জন্য অমর্ত্য সেন কে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে৷
অর্থনীতির কঠিন সাবজেক্টে নোবেল জয়ী হয়েও তাঁর বিরুদ্ধে স্ত্রী নবনীতা দেবসেনের অভিযোগ ছিল তিনি নাকি নিজের পকেট কোনওদিন ঠিক ভাবে সামলাতে পারেন নি৷
মা অমিতা সেন ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত স্নেহধন্য।অমর্ত্য সেনের নামকরণ বিশ্ব কবি রবি ঠাকুর স্বয়ং করেছিলেন৷
অমর্ত্য সেন ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি যিনি মাত্র ২৩বছর বয়সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হওয়ার বিরল সম্মান অর্জন করেছেন৷
অর্থনীতিতে দুর্ভিক্ষ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ১৯৯৮ সালে নোবেল পুরস্কার পান বিশ্ববন্দিত অর্থনীতিবিদ ভারত তথা বাংলার গর্ব অমর্ত্য সেন৷
আঠারো বছর বয়েসে অমর্ত্যর মুখে ক্যানসার ধরা পড়ে, তাকে হেলায় হারিয়ে দিয়ে জীবনের ক্রিজে ব্যাটিং করছেন অপরাজিত ৮৭,আর মাত্র ১৩টি বসন্ত অতিক্রম করলেই পৌঁছে যাবেন জীবনের সেঞ্চুরিতে৷
পূর্বপুরুষদের জন্মস্থান বাংলাদেশের ঢাকা,যদিও অমর্ত্য সেনের পৃথিবীর প্রথম আলো দেখা শান্তিনিকেতনে,বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে, ১৯৩৩ সালের ৩ নভেম্বর অমিতা দেবীর কোলে।
দাদু ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন সংস্কৃতের শিক্ষক,অত্যন্ত পন্ডিত ব্যক্তি৷
বাবা আশুতোষ সেন এবং মা অমিতা সেন,উভয়ের জন্মস্থান ঢাকার মানিকগঞ্জ৷
আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন পরে অবশ্য তিনি ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দিল্লিতে চাকরি করেছেন৷
অমর্ত্য সেনের প্রথম স্কুল ছিল ঢাকার সেন্ট গ্রেগরী, তারপর লেখাপড়া শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে।
অমর্ত্য সেন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘শান্তিনিকেতনে প্রধানত রবীন্দ্রনাথের স্কুলেই শিক্ষার ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গী প্রথম একটা রূপ লাভ করে। সেখানে ছেলে মেয়ে একসঙ্গে পড়ত, শিক্ষার পরিবেশ ছিল অনেক উদার।’
‘প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি করা বা কে কাকে টপকে যাবে সে ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেওয়ার বদলে তাদের মনে কৌতূহল জাগিয়ে তোলাটাই ছিল সেখানে শিক্ষাদানের মূল আদর্শ। পরীক্ষায় ভাল করা বা ভাল নম্বর পাওয়ার ব্যাপারে কখনো উৎসাহ দেওয়া হতো নাস’৷
অমর্ত্য সেনের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল সেইন্ট গ্রেগরী বিদ্যালয়ে৷ রবীন্দ্রনাথের স্কুলে শিক্ষালাভের পর অসম্ভব মেধাবী অমর্ত্য ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ অর্থনীতি পড়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজে।
তখনও তাঁর মনে দগদগে স্মৃতি ১৯৪৩-এর বঙ্গীয় দুর্ভিক্ষ ৷ প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর সহপাঠী ঐতিহাসিক বরুণ দে অমর্ত্য সেন সম্পর্কে বলেছেন
‘কলেজে যখন এলেন দেখতে লম্বা, সুন্দর চেহারা, লোককে মুগ্ধ করার মতন কথাবার্তা বলার ধরনধারণ। অমর্ত্য যেখানে সবাইকে জয় করলেন, সেটা হচ্ছে সকলের সঙ্গে মিশ খেয়ে যাওয়ার তাঁর বিশেষ ক্ষমতা। মেয়েরা তো একেবারে কুপোকাত ছিল তাকে দেখে’৷
প্রেসিডেন্সির অধ্যয়ন পর্ব সমাপ্ত হলে ইংল্যান্ডের ট্রিনিটি কলেজে পড়তে যান। অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রতি বরাবর অমোঘ টান অনুভব করতেন৷ অত্যন্ত আগ্রহ ছিল গণিতের প্রতিও।যদিও সংবাদ মাধ্যমের কাছে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন কেমব্রিজের অর্থনীতি বিভাগে তখন গণিত বেশি ছিল না। ১৯৫৬ সালে প্রথম শ্রেণীতে বি.এ (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন ট্রিনিট্রি কলেজ থেকে৷মজার বিষয় ১৯৯৮ সালে নোবেল পাওয়ার সময় প্রফেসর অমর্ত্য সেন ইংল্যান্ডে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের ‘মাস্টার’ ছিলেন। অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজের কোন কলেজের তিনিই প্রথম এশীয় প্রধান।
‘চয়েস অব টেকনিক্স’ নিয়ে তিন বছরের গবেষণা এক বছরে শেষ করে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলেন।
ফেলোশিপ নামে একটা চমৎকার বৃত্তিও পেয়ে যান।তিন বছরের গবেষণা এক বছরে শেষ করে তিনি ফাঁকা হয়েছিলেন৷ফিরলেন কলকাতায়,রত্ন চিনতে ভুল হয়নি তদানীন্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ত্রিগুনা সেনের৷ সদ্য প্রতিষ্ঠিত বর্তমান ভারতের গর্ব যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং অর্থনীতি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হিসেবে অমর্ত্য সেনকে নিয়োগ করলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ত্রিগুনা সেন।
অমর্ত্য সেন ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি যিনি মাত্র ২৩বছর বয়সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হওয়ার বিরল সম্মান অর্জন করেছেন৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর অধ্যাপনা করার পর ১৯৫৯ সালে আবার ফিরলেন ইংল্যান্ডে৷
ট্রিনিট্রিতে ফেলোশিপ অর্জন করায় চার বছরের জন্য নিজের পছন্দসই যে-কোনও বিষয় নিয়ে পড়শুনোর সুযোগ পেলেন। অমর্ত্য সেন পড়ার বিষয় বেছে নিলেন দর্শন। পরবর্তীকালে তাঁর গবেষণার কাজে অনেক সাহায্য করেছে দর্শনশাস্ত্র৷অবশ্য প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় থেকেই দর্শনের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল৷
সেখানে নিয়মিত দর্শন চর্চা এবং বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন।তর্কে অমর্ত্য সেনের তুখোড় দক্ষতা ছিল। তাঁর প্রথম স্ত্রী নবনীতা দেবসেন বলেছেন তাদের দুজনের প্রথম আলাপের সূত্রপাত ছিল বিতর্ক৷
অমর্ত্য সেন শিক্ষকতা জীবন শুরু করেছিলেন কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সে অধ্যাপনার মধ্যে দিয়ে তিনি আরোহন করেছেন শিক্ষকতার জগতে একটার পর একটা চূড়ায়।শিক্ষকতা করেছেন বিশ্ববিখ্যাত কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ড,হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে৷
১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বাঙালির হৃদয় জিতে নিয়েছিলেন৷ পৃথিবীর বিভিন্ন স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে অসংখ্য সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেছেন।১৯৯৯সালে ভারত সরকার অর্মত্য সেনকে ‘ভারতরত্ন’সম্মানে ভূষিত করে৷
প্রথম কোনও বাঙালি তথা ভারতীয় হিসেবে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার ঐতিহ্যবাহী শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন৷
অমর্ত্য সেনের লেখা বই প্রায় তিরিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে ৷
দারিদ্র্যতা এবং দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণার জন্যই নোবেল জয়, পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য মানুষের অসীম শ্রদ্ধার পাত্র নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন৷আর এক বাঙালি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেল জিতেছেন৷
বাঙালি জাতি কিন্তু রসিকতা করে বলতেই পারে অর্থনীতি অনেকের তুলনায় তারা ভাল বোঝেন,তার বড় প্রমান অমর্ত্য সেন এবং অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অর্থনীতিতে নোবেল জয়৷
অনেকে হয়তো জানেন না,নিতান্ত নিরীহ এক বাইসাইকেল অমর্ত্য সেনের অর্থনীতির নোবেল জয়ের অন্যতম বড় চরিত্র হয়ে উঠেছিল৷সুইডেনের নোবেল কমিটির দাবি কিন্তু ঠিক তেমন৷ পন্ডিত এই মানুষটির ছিল বহুমুখী প্রতিভা৷রীতিমত সাহিত্য চর্চা করতেন৷
বাংলায় ১৯৪৩-এর মন্বন্তর প্রত্যক্ষ করেছিলেন অমর্ত্য সেন। ওই দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর গবেষণার সূত্রপাত।
জনকল্যাণকর অর্থনীতি এবং গণদারিদ্র্যের অন্তর্নিহিত কার্যকারণ বিষয়ে তাঁর গবেষণার জন্য অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ৷
নিজের মুখে তিনি বলেছেন—
‘শান্তিনিকেতনের আশেপাশে বাস করা মানুষের আয় কত ছিল, চালের দাম কত ছিল, এসব তথ্য সাইকেলে চড়ে ঘুরে ঘুরে আমাকে সংগ্রহ করতে হয়েছে, শান্তিনিকেতনে এবং তার আশপাশের অঞ্চলে’৷
সুইডেনের নোবেল মিউজিয়ামে একটা বাই সাইকেল আছে,খোদ নোবেল কমিটির দাবি এই সাইকেলে চড়ে গ্রাম ঘুরতেন অমর্ত্য সেন।আর সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিজের গবেষণাপত্রে তুলে এনেছিলেন। যে গবেষণার ভিত্তিতে ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন অমর্ত্য সেন।
ইনস্টাগ্রামে করা এক পোস্টে এমনই দাবি জানিয়েছিল সুইডেনের নোবেল কমিটি। ৩ জুন, বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস পালিত হয়৷ দিনটি উদযাপন করতে গ্যালারিতে রাখা সেই সাইকেলের ছবি কয়েক বছর আগে সোশাল মাধ্যমে পোস্ট করেছিল নোবেল কমিটি। সেই পোস্টে নোবেল কমিটি লিখেছিল, ‘বাইসাইকেল অর্থবিজ্ঞানের চাবিকাঠি নয়। কিন্তু অমর্ত্য সেনের অর্থনীতির গবেষণায় এই বাইসাইকেল বড় ভূমিকা পালন করেছিল।’ লিঙ্গ সমতায় প্রবল বিশ্বাসী মানুষ,সম্মান করেন নারী জাতিকে। যে কোনো অচেনা-অজানা মানুষ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে He নয়,তিনি She শব্দ ব্যবহার করেন।অমর্ত্য সেনের মত মানুষকে হয়ত একটা শহর বা একটা দেশের পরিচয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখতে পারা যায় না,কিন্তু
তিনি বাঙালি,আর সেইজন্য অমর্ত্য সেনের যেকোনও কৃতিত্বে নিজেদের গর্বিত মনে করে যেমন বাঙালি,তেমন গর্ব বোধ করেন গোটা ভারত থেকে সারা পৃথিবীর মানুষ৷বোধহয় সেই কারনে তিনি বাঙালি ও ভারতীয় হয়েও বিশ্বনাগরিক,অথচ যিনি কখনও নিজের শেকড়কে অস্বীকার করেন নি৷
তথ্যঋণ -বিবিসি
সূত্রঃ মলাট থেকে ।
তারিখঃ অক্টোবর ১৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,