লেখা: স্বপন সেন।
তাসখন্দে খুনখারাপি ………..
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মন্ত্রীসভা থেকে দেশবাসী সবাই সেদিন মেনে নিলো হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েই মারা গেছেন শাস্ত্রীজী ।
এলো ১৯৭৭, জনতা পার্টির ঐতিহাসিক জয়ের পরে সংসদের চেহারা যখন বদলে গেলো তখন নতুন সরকার লালবাহাদুরের মৃত্যুর তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি তৈরি করলেন। অধ্যক্ষ হলেন সেই রাজনারায়ণ৷ কমিটি কিছু লোককে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। তলব পেয়ে একদিন সাক্ষী দিতে যাচ্ছিলেন সপরিবারে ডাক্তার চুঘ, কিন্তু রাস্তায় একটি ট্রাক ধাক্কায় দেয় তার গাড়িতে। মারা যায় তাঁর স্ত্রী ও এক পুত্র, কিশোরী কন্যাটি প্রাণে বাঁচলেও মারাত্মক জখম হয়৷ ট্রাকটি প্রথমে গাড়ির পিছনে আঘাত করে, ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাপ করতে চালকের আসন থেকে যখন নেমে আসেন চুঘ তখন ট্রাকটি ঘুরে এসে তাঁকে পিষে দেয় ৷ মানে তাঁকে কোনভাবেই বাঁচতে দেয়া যাবেনা ।
ওই দিনই কমিটির ডাক পেয়েছিলেন বৃদ্ধ রামনাথও৷ যাওয়ার আগে তিনি বরাবরের অভ্যাস মতো ১ নম্বর মোতিলাল নেহরু মার্গে ললিতা শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন— ‘‘আম্মা, অনেকদিন ধরে বুকের মধ্যে বোঝা নিয়ে ঘুরছি, আজ সব বলে দিয়ে হালকা হব৷’’ কিন্তু তাঁকে আর হালকা হতে দেওয়া হলোনা৷ মোতিলাল নেহরু মার্গ থেকে সংসদ ভবন হেঁটেই আসছিলেন, রাস্তায় একটি বাস তাঁর উপর দিয়ে চলে যায়৷ শক্ত প্রাণ রামনাথের বেঁচে গেলেও দু’টি পা কেটে ফেলতে হলো৷ শকে স্মৃতি হারালো বুড়ো, আর কোনও দিন তাসখন্দের গল্প বলতে পারলো না৷
দু’টি ঘটনা যে সমাপতন বা নিছক পথ দুর্ঘটনা নয়, তা বুঝতে রকেট বিজ্ঞানী হতে হয় না৷ সেই জন্যই প্রশ্নটা থেকে যায়— ডাঃ চুঘ বা রামনাথ এমন কী জানতেন, যার জন্য তাঁদের এত মূল্য দিতে হলো?
দু’দশক পরে আবার এমন একটা ঘটনা ঘটল, যাতে গল্পে অন্য মাত্রা যোগ হয়ে গেল৷ ১৯৯৮-এর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ান পত্রিকা ‘কমসোমলস্কায়া প্রাভদা’-তে একটি ছোট্ট খবর বেরোয়৷ খবরটি হল— ১৯৬৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দে মারা যাওয়ার পরে আহমেদ সাত্তারভ নামক এক রাঁধুনিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল৷ সাত্তারভ শাস্ত্রীর ডাচা-য় তাঁর জন্য রান্না করত৷ কোনও ভারতীয় সাংবাদিক, এমনকী ভারতীয় দূতাবাসও খবরটি লক্ষ্য করেনি৷ কিন্তু ‘লন্ডন টেলিগ্রাফ’-এর মস্কো সংবাদদাতা খবরটি দেখে তাঁর কাগজের জন্য পাঠিয়ে দেন৷ পরের দিনই খবরটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে৷ ললিতা শাস্ত্রীর প্রশ্নটা আবার মাথা চাড়া দেয়— রাশিয়ানরা কি শাস্ত্রীর শরীরে বিষপ্রয়োগের সম্ভাবনার কথা জানত?
এরও প্রায় পনেরো বছর পরে, ২০১৩-র অক্টোবরে ‘রাশিয়া বিয়ন্ড’ ওয়েবসাইটের এক সাংবাদিক সাত্তারভের সাক্ষাৎকার নেন৷ সাত্তারভ বলেছিলেন— ১১ জানুয়ারি খুব ভোরে কেজিবি-র লোকেরা তাঁকে ও তাঁর তিন সহকর্মীকে গ্রেফতার করে৷ তাঁরা বলেন যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে৷ তাঁদের চার জনকে হাতকড়া লাগিয়ে তাসখন্দ থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে একটি ছোট শহরে নিয়ে যাওয়া হয়৷ খানিক পরে সেখানে জান মহম্মদকেও হাজির করা হয়৷ জেরা শুরু হয়৷ ছ’ ঘন্টা জেরা চলছে, সাত্তারভের ভাষায়— ‘‘আমরা এত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে, আমার এক সহকর্মীর জুলফি আমাদের চোখের সামনে সাদা হয়ে গেল আর আমি সেই থেকে কথা বলতে গেলে তোতলাই৷ হঠাৎ কোসিগিন সেখানে উপস্থিত হন ৷ তিনি আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন, মেডিক্যাল পরীক্ষায় ধরা পড়েছে যে, শাস্ত্রী হৃদরোগেই মারা গিয়েছেন৷ তোমরা কোনও ভাবেই দোষী নও৷’’ তার পর তাঁরা সকলে ছাড়া পান৷
গল্পটায় কিন্তু গণ্ডগোল রয়েছে৷ ভারত সরকারের বিবরণ অনুযায়ী, ডাঃ চুঘ বা রাশিয়ান ডাক্তারেরা কোনওরকম বিষক্রিয়া সন্দেহ করেননি, একবাক্যে হৃদরোগে মৃত্যুর সার্টিফিকেটে সই করে দিয়েছিলেন৷ অথচ কেজিবি পাঁচজন পাচককে গ্রেফতার করে বসল৷ তা ছাড়া, শব-ব্যবচ্ছেদ না করে ডাক্তারেরা কী করে বুঝলেন যে বিষের কোনও ভূমিকা ছিল না? তাহলে শাস্ত্রীজির শরীরের ক্ষতচিহ্নগুলি কি পোস্টমর্টেমের দাগ ছিল?
এত কান্ডের পরেও পাচক জান মহম্মদ কে এদেশের পুলিশ একবারও জেরা করেনি উপরন্তু তাকে রাষ্ট্রপতি ভবনে চাকরি দেয়া হয় ।
সবচেয়ে বড় কথা, পাঁচ জন সন্দেহভাজন পাচককে মুক্ত করতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী ছুটে আসবেন— ব্যাপারটা হজম করতে একটু কষ্ট হয়না কি ?
লালবাহাদুর জমানার গৃহসচিব ও পরবর্তী জীবনে রাজ্যপাল লালনপ্রসাদ সিংহ তাঁর লেখা এক বইতে জানিয়েছেন— রুশ কর্তৃপক্ষ শাস্ত্রীজির মৃত্যুর ময়নাতদন্ত করতে চেয়েছিল, কিন্তু বিদেশমন্ত্রী কর্ণ সিংহ অনুমতি দেননি। তিনি নাকি বলেছিলেন, দেশবাসী মনে করবে দেহ অপবিত্র হয়ে গিয়েছে৷ অথচ সংসদে এই প্রশ্নের উত্তরে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় গৃহমন্ত্রী বলেছিলেন— সেই সময়ে কোনও রকমের পোস্টমর্টেমের কথাই ওঠেনি৷ তবে ললিতা শাস্ত্রী দেহ ভারতে আসার সঙ্গে সঙ্গে দাবি করেছিলেন, অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী গুলজারীলাল তাতে পাত্তাই দেননি ।
বছর দশেক আগে নেতাজি-বিশেষজ্ঞ অনুজ ধরও এই অনুসন্ধানে যোগ দিয়েছেন৷ তিনি তথ্যের অধিকার আইন অনুযায়ী নথিপত্র চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দফতর জানায়, তাদের কাছে লালবাহাদুর সম্বন্ধে মাত্র একটিই ফাইল রয়েছে, সেটিও দেশের স্বার্থরক্ষার্থে প্রকাশ করা যাবে না৷ প্রখ্যাত সাংবাদিক ও শাস্ত্রীজীর উপদেষ্টা কুলদীপ নায়ার তাসখন্দে ওনার সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি কথায় কথায় একবার বলেছিলেন— ‘‘আমার তো এতকাল মনে হতো হার্ট অ্যাটাকই হয়েছিল। লেকিন দুনিয়া নে বহুত কুছ দিখায়া, কেয়া মালুম, কুছ ভি হো সকতা…’’
এই নায়ার সাহেব যখন লন্ডনে ভারতের হাইকমিশনার, তখন গর্বাচভের পতন হয় । গ্লাসনস্তের উচ্ছ্বাসে কেজিবি-র বহু গোপন ফাইল বেরিয়ে এসেছিল৷ নায়ার তাঁর একটি চেনা লোককে ডিউটি দিয়েছিলেন শাস্ত্রীজির মৃত্যু সম্বন্ধে ফাইলগুলি খুঁজে বার করতে৷ কিন্তু অনেক সন্ধান করেও কিছু পাওয়া যায়নি৷
এখন কিছু কিছু নেতাজি গবেষক দাবি করছেন, তাসখন্দে নাকি শাস্ত্রীজির সঙ্গে নেতাজির দেখা হয়েছিল যদিও তথ্যপ্রমাণ বেশ নড়বড়ে৷ তবে শাস্ত্রীজির মৃত্যু নিয়ে গোলকধাঁধার গণ্ডগোলের মতো রহস্যের জাল বিস্তারিত হয়েই চলেছে৷ লালবাহাদুরের দৌহিত্র, বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ ভারত সরকারের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন— ‘‘আমি মেনে নিচ্ছি, আমার দাদুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল৷ কিন্তু তুমি ভাই দুটো কাগজ তো অন্তত দেখাও৷’’
উত্তর মেলেনি৷ এই মুহূর্তে তাঁরই পার্টি সরকার চালাচ্ছে, কংগ্রেসকে বিঁধবার এমন মোক্ষম অস্ত্র যদি সত্যিই প্রধানমন্ত্রীর দফতরে থেকে থাকে, সেটা তাঁরা নিশ্চয়ই লুকিয়ে রাখতেন না৷ কিন্তু কোনও কাগজের সন্ধান আজ অব্দি পাওয়া যায়নি ।
জটায়ুর ভাষায় কেসটা সত্যি সত্যিই এখন ” হাইলি সাশপিসাস !” সমাপ্ত।
সূত্র: নেট থেকে সংগৃহিত মলাট।
তারিখঃ অক্টোবর ০৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,