লেখক:হাসান হামিদ, গবেষক।
ছোটবেলায় শুনতাম, ইংরেজি বা গণিতটা ঠিকমতো করো, নইলে চাকরি পাবে না! কিংবা ক্লাসের ভালো ছাত্র হলে তাদেরই কেবল বিজ্ঞানে পড়ার রেওয়াজ আমাদের দেশে অনেক দিন ধরেই প্রচলিত। তারপর দেখা গেল, বিজ্ঞান বিভাগের ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো কেমেস্ট্রি নিয়ে পড়ল। স্নাতকোত্তরের পর সে চাকরি নিল ব্যাংকে। ব্যাংকিং খাতের কর্মী হিসেবে টাকা-পয়সার হিসাব রেখে জীবন পার করে দিল। তাহলে কেমেস্ট্রি পড়ে তার কিংবা দেশের কী লাভ হলো? এ অবস্থা বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে চলছে। এর অবসানে দেশে কোন খাতে কত লোক দরকার তার একটা কাছাকাছি হিসাব করে সেভাবেই শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সবকিছু সাজানো উচিত। এটা জানা কথা, কাজের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে পঠিত বিষয়ের পুরোপুরি সামঞ্জস্য বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কিন্তু যে খাতে দশজন লোক দরকার, সে বিষয়ে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে, করতে বাধ্য হচ্ছে। আবার যে খাতে হাজারো সুযোগ, সেই খাতে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে নগণ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী। এভাবেই দক্ষ জনশক্তির অভাব একদিকে, অন্যদিকে বাড়ছে বেকারত্ব।
বর্তমানে এদেশে স্নাতক পর্যায়ে পড়ছেন মোটামুটি ৩৫ লাখ ছেলেমেয়ে। তারা উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। তারপর? এসব ভাবনায় নেই। সবাই ঝুঁকছে সরকারি চাকরিতে। হ্যাঁ, সরকারি সেবা মানুষের কাছে পৌঁছানোর কাজের সুযোগ পেলে বিশেষ দক্ষতার দরকার হবে না এটা ঠিক, কিন্তু দেশের অর্থনীতির শতকরা ৮২ ভাগ যেখানে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে শুধু সরকারি খাতের চিন্তা করলে তো হবে না। সরকার বেতন দেবে, সেই টাকা আসবে কোথা থেকে? সবচেয়ে বড় কথা, ৫০ বছরেও আগে যা হয়নি, তা মাত্র চার বছরে সম্ভব করেছে প্রযুক্তি। সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়, যখন এম এ না এমবিএ নয়; জিজ্ঞেস করা হবে আপনি কী পারেন? সুইডেন ও ডেনমার্ক কাগুজে নোটের ব্যাংক বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। আপনি না চাইলেও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কিন্তু কড়া নাড়ছে। আমাদের শিক্ষা কি আসন্ন শিল্পবিপ্লব মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট?
‘দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন’ নামে একটা বই আছে। বইটি লিখেছেন বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা শোয়াব। আমাদের এই পৃথিবীতে একসময় আদিম সাম্যবাদী সমাজ ছিল। লাঙল আবিস্কার হলো, কৃষির প্রচলন ঘটল, সেখান থেকে এলো সামন্ততন্ত্র। পৃথিবীকে চমক লাগানো জেমস ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিন। লেখকের মতে, ওটাই প্রথম শিল্পবিপ্লব। তারপর বিদ্যুৎ, রেডিও, টেলিভিশন এসব দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। তারপর ডিজিটাল যুগ। এটা তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। আবার বর্তমানে ফেসবুক, টুইটার অনেকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ধরলেও অর্থনীতিবিদরা এসবকে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সংস্কার বলে অভিহিত করছেন।
২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে কী কী নতুন বাস্তবতা দেখা দেবে সেসবের একটি তালিকা দিয়েছেন এই বইয়ের লেখক। তার মধ্যে কিছু হলো ২০২৫ সালের মধ্যে শরীরে মোবাইল ফোন বসানো হবে; পেসমেকারের মতোই অনেকটা। তাতে আমাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে কিন্তু ক্ষতি হবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা। প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের একাধিক ডিজিটাল ঠিকানা থাকবে, তাতে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাড়বে। তেমনি বাড়বে এ সংক্রান্ত অপরাধ। ইন্টারনেটে যুক্ত থাকবে যেমন- চালকবিহীন গাড়ি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিটকয়েন ব্লকচেইন। বিকল্প টাকা। ত্রিমাত্রিক প্রিন্টারের মাধ্যমে মানুষের চিকিৎসা হবে। থ্রি-ডি প্রিন্টারের থেকে নেয়া যকৃত মানুষের শরীরে বসানো হবে। প্রথম মানব শিশু জন্ম নিবে, যার জিনোম কৃত্রিমভাবে উন্নতর করা হয়েছে। তার মানে বোঝা যাচ্ছে আগামী সাত বছরের মধ্যে পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
আমরা টের পাচ্ছি, ডিজিটালাইজেশন এরই মধ্যে সর্বক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আগামী ১০ বছরে ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে এমনসব পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে হবে, যা এর আগে কখনও সম্ভব হয়নি। বিশ্বের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কী প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে দুই ধরনের মত পাওয়া যাচ্ছে। একদল বিশেষজ্ঞ বলছেন, এতে সব মানুষেরই আয়ের পরিমাণ ও জীবনমান বাড়বে। বিশ্বের পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়ায়ও ডিজিটাল প্রযুক্তি আনবে ব্যাপক পরিবর্তন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য পাঠানোর খরচ অনেক কমে আসবে এবং ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। আবার অন্য একদল অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ডিজিটাল বিপ্লব বিশ্বের অসাম্য ও দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে আরও দুর্বিষহ পর্যায়ে নিয়ে যাবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে মানুষের অনেক কাজ রোবট ও যন্ত্রপাতি দিয়ে করা হবে। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তা সমস্যা তৈরি করবে। এ ছাড়া শ্রমবাজারে অল্প কর্মদক্ষ শ্রমিকদের চাহিদাও বাজার কমে যাবে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সমস্যায় ফেলবে।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস প্রবাসীদের আয়। এখন আমরা লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে যাচ্ছি গ্যারেজ কিংবা কলকারখানায় কাজ করতে, তখন ওই কাজ তো যন্ত্র করবে। অটোমেশন সর্বত্র হবে। নির্মাণ খাতেও হবে। আমাদের এই মানুষগুলো কাজ হারাবে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যেই বাংলাদেশে বেকারত্ব আরও বাড়বে, সঙ্গে আসবে একটি বিপর্যয়, যদি না আমরা এ বিষয় মাথায় রেখে অগ্রসর হই। আমাদের বিজ্ঞাননির্ভর আগামী বাজারের উপযোগী শিক্ষা দিতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ঝড় মোকাবিলা করতে হলে আমাদেরকে বিজ্ঞানের আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং নির্ভর হতে হবে ইন্টারনেটভিত্তিক কাজে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়তে হবে এবং অবশ্যই আগামী এক দশক পর কোন খাতে কী পরিমাণ দক্ষ লোক লাগবে, সেই হিসাব করে শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বলতে যেটি বোঝানো হচ্ছে, তা হলো সমাজ এবং অর্থনীতির বিভিন্ন অনুষঙ্গের নিরবচ্ছিন্ন প্রযুক্তিগত রূপান্তর। প্রতিটি ক্ষেত্রে রোবটিপ বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার কীভাবে মানুষের কল্যাণে আসতে পারে। প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা-প্রশাখা কীভাবে মানবজীবনকে বদলে দিতে পারে ও কীভাবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হতে পারে এসব কিছুই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। দেশ যদি এখন থেকেই যথাযথ পরিকল্পনা নিতে না পারে, তবে ভবিষ্যতের জন্য অনেক সমস্যা হবে।
সূত্রঃ সমকাল।
তারিখঃ অক্টোবর ০২, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,