একদিকে স্বামী আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, অন্যদিকে বৃদ্ধ মা–বাবার অসুস্থতা। ইভানা লায়লা চৌধুরী বুঝতে পারছিলেন না কোথায় গেলে সমাধান হবে। সবশেষ গত বুধবার ইভানার মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় রাজধানীর পরীবাগে শ্বশুরবাড়ির পেছনে।
ইভানা লায়লা চৌধুরী (৩২) ছিলেন ঢাকার স্কলাসটিকা স্কুলের ইউনিভার্সিটি প্লেসমেন্ট সার্ভিসেসের উপব্যবস্থাপক। আইনে স্নাতক করার পর ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেন। পেশায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসানকে (৪২) ভালোবেসে ১১ বছর আগে বিয়ে করেন। ইভানার পরিবারের অভিযোগ, আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান বিয়েবহির্ভূত একটা সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। ইভানা সহ্য করতে পারেননি। এর জেরেই প্রাণ গেছে তাঁর।
ইভানা তাঁর স্বামীর এই নতুন সম্পর্ক নিয়ে বন্ধু–বান্ধব, শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। মৃত্যুর দু–তিন দিন আগেও ই–মেইল করেছেন সাবেক একজন শিক্ষককে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে ইভানা বলেছেন, তিনি ভালো নেই। এমনকি পরীবাগে যেদিন তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়, তার দুদিন আগেও হাতের রগ কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। সেই ছবিও তিনি তুলে রাখেন।
বন্ধু–শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে কথোপকথনগুলোর একটিতে ইভানা লিখেছেন, ‘সম্ভাব্য তালাকের চিন্তায় আমার ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার মা–বাবা সহ্য করতে পারবেন না। তাঁদের দুজনেরই বয়স হয়েছে। নানা রকম শারীরিক জটিলতা আছে।’
ইভানার মেজ বোন ফারহানা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মাস দেড়েক আগে ইভানা ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে বনানীতে তাঁদের মা–বাবার ওখানে এসেছিলেন। হঠাৎ তিনি বলেন, রুম্মান (আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান) প্রেম করছে। তিনি বারবার বিস্তারিত জানতে চান, কিন্তু ইভানা মুখ খোলেননি। ইভানার ভয় ছিল সত্তরোর্ধ্ব মা–বাবা এই খবর সহ্য করতে পারবেন না। মারা যাওয়ার দিন কয়েক আগে বাবা ও দুলাভাইকে জানিয়েছিলেন। তা–ও খুব বিস্তারিত নয়।
বিজ্ঞাপন
মৃত্যুর দুদিন আগে ইভানার বাবা আমানুল্লাহ চৌধুরী চেয়ার থেকে পড়ে যান বলে জানান ফারহানা। বিষয়টি তাঁকে জানানোর জন্য বারবার ফোন করলেও ইভানা ধরেননি। তাঁর স্বামী তাঁদের বলেন, ইভানা একটির জায়গায় দুটো ওষুধ খেয়ে ফেলেছে। ঘুমোচ্ছে। চিন্তার কিছু নেই।
বারবার ফোন করেও ইভানার সঙ্গে কথা বলতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ফারহানা চৌধুরী পরীবাগে ইভানার বাসায় যান। খুব ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ইভানা। বোনের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। পরে ইভানা তাঁকে ভিডিও কল করেন। কান্নার দমকে তিনি তখন কথা বলতে পারছিলেন না। ইভানা বলেন, ‘দেখ, রুম্মান আমাকে বলেছিল ওর মা–বাবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে। আমি তো আগে কিছু করতে পারতাম না। এখন ইউটিউব দেখে অন্তত নাশতাটা বানাতে শিখেছি, চেষ্টা তো করছি। তা–ও ও আমার সঙ্গে এমন করতে পারল!’
ফারহানা চৌধুরী জানান, বুধবার সকালে আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসানের বাবা মো. ইসমাঈল হোসেন তাঁদের বাবাকে ফোন করে বিকেলে পরীবাগের বাসায় যেতে বলেন। তিনি বলেন, ইভানা ও তাঁর স্বামীর মধ্যে সমস্যা হচ্ছে। ফারহানা তাঁর বাবা আমানুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে ইভানার শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছান বেলা একটার দিকে। তাঁরা গিয়ে দেখেন নিচতলায় ইসমাইল হোসেন দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বলেন, ইভানাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করেন, তাঁরা কোনো শব্দ শুনেছেন কি না। পরে ভবনের পেছনের দিকে গিয়ে ফারহানা ছোট বোনের হাত আর জামার একটি অংশ দেখতে পান।
ভবনের পাঁচতলায় ইভানাদের বাবা তখন মেয়ের অপেক্ষায়। তাঁর মৃত্যু হয়েছে, এ কথা বলতেই ইভানার শাশুড়ি লুলু মারজান বলেন, ‘হ্যাঁ! এখানে মরল কেন? বনানীতে মরত।’ তাঁরা যখন ইভানার ছেলেদের নিয়ে তাঁদের বনানীর বাসার দিকে বের হচ্ছিলেন, তখন আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসানের বাবা ইসমাইল হোসেন তাঁদের ছবি তুলে রাখেন।
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসানের মুঠোফোনে কল করলে সেটি ব্যস্ত দেখায়। তাঁদের পরীবাগের ওই বাসায় গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসানের বাবা ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইভানা ভালো মেয়ে ছিল। ওর জন্মের সময় বাবা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন। প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়েছে। এখানেও প্রাচুর্য ছিল। তিনি নিজে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। রুম্মান তাঁর একমাত্র ছেলে। বছরে অন্তত একবার ছেলে–ছেলে বউ দেশের বাইরে বেড়াতে যেতেন। অন্য কিছু তিনি শোনেননি। তারপরও ইভানার পরিবারের কোনো অভিযোগ থাকলে তাঁরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।
নানাজনের সঙ্গে ইভানার যোগাযোগের বেশ কিছু স্ক্রিনশট রয়েছে সাংবাদিকদের হাতে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আসিফ বিন আনোয়ার একসময় ইভানার শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রোববার ইভানা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। এর আগেও ২০১৩, ২০১৫ ও ২০১৮ সালে ইভানা দেখা করতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আসেননি। শুধু ২০১৫ সালে তাঁকে পাঠানো লম্বা এক ই–মেইলে ইভানা জানান, স্বামী তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান তাঁকে তালাকের কথা বলছেন। কিন্তু এতে তাঁর (ইভানা) পরিবার ছোট হয়ে যাবে। তাঁর একটা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তান আছে। আর যে টাকা তিনি রোজগার করেন, তাতে দুটো সন্তানকে নিয়ে চলতে পারবেন না।
এই দফায় দেখা না করলেও মৃত্যুর দুদিন আগে ইভানা আসিফ বিন আনোয়ারকে বেশ কিছু খুদে বার্তা পাঠান। তিনি স্বামীর অন্য সম্পর্কে জড়ানোর কথা বলেন। তাঁর কোথাও ভুল হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে ইভানা স্বামীর ওই বান্ধবীর ছবি পাঠান। তাঁদের দুজনের কথোপকথনের কিছু স্ক্রিনশটও পাঠান। তার একটিতে আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান জানান, বিষয়টি তিনি তাঁর বাবাকে বলেছেন। তাঁর বাবা শান্তভাবেই নিয়েছেন।
শুধু বলেছেন তিক্ততা যেন না হয়। ইভানা যাওয়ার পর যা কিছু করার করবেন। তাঁর মাকেও পরে জানাবেন। এ থেকে তিনি ধারণা করেন, আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান ও তাঁর পরিবার ইভানাকে বের করে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন।
এই আইনজীবী আরও জানান, মৃত্যুর দিন কয়েক আগে ইভানাকে তাঁর স্বামী একজন কিডনি ও নেফ্রোলজি বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান। তিনি ইভানাকে বিষণ্নতা দূর করে, এমন কিছু ওষুধ খেতে দেন। ওই চিকিৎসক মানসিক রোগের চিকিৎসক ছিলেন না, ব্যবস্থাপত্রেও ইভানার মানসিক রোগের কোনো উল্লেখ নেই। বিষণ্নতার ওষুধ অনেক সময় মানুষকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। সে কারণেও ইভানা আত্মঘাতী হয়ে থাকতে পারেন বলে তাঁর ধারণা।
বিজ্ঞাপন
হাতের কবজি থেকে রক্ত ঝরছে, এমন একটি ছবি পাঠিয়ে মৃত্যুর দুদিন আগে ইভানা তাঁকে লিখেছিলেন, ‘আজ বুঝলাম, টিভিতে দেখতে যত সহজ লাগে, আদতে তত সহজ নয়। আমি পারলাম না। তবুও ডিভোর্স নিয়ে আমি ফিরতে পারব না। আমার বাবা–মাকে কষ্ট দিতে পারব না। আমার ছোট বাচ্চাটা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। তাকে নিয়েই আমার যত চিন্তা। কিন্তু তারপরও…।’ আসিফ বিন আনোয়ার তাঁকে বোকামি না করার পরামর্শ দেন।
এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। পরিদর্শক (অপারেশন্স) শেখ মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ইভানা কানে ফোন নিয়ে ছাদে ওঠেন। ওই ফোনটি তাঁরা জব্দ করেছেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবেন তাঁরা। ইভানার স্বামীর সঙ্গে তাঁরা কথা বলেছেন। তিনি ইভানার কিছু শারীরিক সমস্যা ছিল বলে দাবি করেছেন। মানসিক রোগে ভুগছিলেন এমন কোনো তথ্য দেননি।
ইভানার বোন ফারহানা প্রথম আলোকে বলেন, আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি তাঁরা। অপমৃত্যুর মামলা করেছেন তাঁর ভাই। জানাজাতেও আসেননি ইভানার স্বামী। ইভানার বড় ছেলে ঘুমের মধ্যে কাঁদে। চিৎকার করে বলে, ‘ওভার ডোজ ইজ নট গুড।’ সে কখনো মায়ের জন্য কাঁদে, কখনো চুপ করে থাকে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছোট ছেলে শূন্য চোখে কাকে যেন খোঁজে। কী করলে সন্তানদের ভালো হয়, তাই এখন তাঁদের একমাত্র ভাবনা।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ২০, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,