লেখক: পার্থ মণ্ডল।
জুলিয়ানা-মুয়াজ্জম: অজানা মুঘল প্রেমের অদ্ভুত কাহিনি।।
সপ্তাহান্তে অভ্যেসের বশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম আর পরবর্তী পর্বের বিস্তার নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলাম। অষ্টাদশ শতাব্দের দ্বিতীয় ভাগে ভারতে ফরাসি আধিপত্য বিস্তারের পুরোভাগে ছিলেন সেনানায়ক জ্যাঁ ব্যাপটিস্ট জোসেফ জেন্টিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে টক্কর দিতে কূটনীতির আশ্রয় নিয়ে কখনো তিনি মুর্শিদাবাদে মীর কাশিমের হাত ধরেছেন, আবার কখনো অওধে সুজা-উদ-দৌলার দরবারে ফরাসি দূত হিসাবে কাজ করেছেন। ফরাসি কর্নেল হিসাবে চন্দননগর ও পন্ডিচেরিতে কাটিয়েছেন বহু সময়। ভারতে থাকাকালীন তিনি মুঘল আমলের বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন, যেমন আসল ম্যানুস্ক্রিপ্ট, চিঠি, দলিল-দস্তাবেজ, মিনিয়েচার আর্ট ইত্যাদির সংগ্রহ গড়ে তোলেন। ফ্রান্স ফিরে গিয়ে তিনি একটি বই লেখেন – ‘Memoires sur L’Indoustan, ou Empire Mogol’, যা সেই সময়ের ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক বিবরণীর প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এহেন জেন্টিল সায়েব ফৈজাবাদে জনৈক পর্তুগিজ রমণী তেরেসা ভেলহো’র সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। এই তেরেসা ছিলেন সম্পর্কে জুলিয়ানা ডায়াস ডা কোস্টা’র পৌত্রী (গ্র্যান্ড-নিস্)। কে এই জুলিয়ানা? একটু গুগল করতেই অজানা প্রেমের এক অদ্ভুত কাহিনি জানতে পারলাম, আর তা নিয়ে একটু লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।
সপ্তদশ শতাব্দের দ্বিতীয় ভাগ। ইস্তাম্বুল থেকে টোকিও – এশিয়ার এই বিস্তীর্ণ ভূমিতে দিল্লি তখন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও বর্ধিষ্ণু নগর যা ছিল শক্তিশালী মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। শাহ জাহানকে বন্দী করে ও অন্য ভাইদের ছলে-বলে-কৌশলে হত্যা করে ময়ূর সিংহাসনে তখন আসীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ আওরঙ্গজেব – অত্যাচারী ও অসহিষ্ণু শাসক হিসাবে দুর্নাম কুড়োলেও তাঁর আমলেই ভারতবর্ষে মুঘল ব্যাপ্তি শীর্ষে পৌঁছয়। এহেন আওরঙ্গজেবের অন্দরমহলে তাঁরই তরুণ শাহজাদার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে এক পর্তুগিজ ক্যাথলিক বিধবা তরুণীর। শাহজাদার নাম মহম্মদ মুয়াজ্জম ওরফে শাহ আলম যিনি বেশ কয়েক দশক পর আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর তিন মাসের মধ্যে অষ্টম মুঘল সম্রাট হিসাবে ময়ূর সিংহাসনে আরোহন করেন। আর সেই পর্তুগিজ ক্যাথলিক বিধবা তরুণীর নাম ছিল জুলিয়ানা ডায়াস ডা কোস্টা। তরুণের বয়স ঊনিশ আর তরুণী সতেরো। তাও, তরুণী ছিলেন তরুণের শিক্ষিকা। সবচাইতে কম বয়সের আর সবচাইতে প্রিয় শিক্ষিকা শাহজাদার। চিন্তা করলে চমকে যেতে হয় – সিংহাসনে অত্যাচারী বাবা যাঁর পরধর্মে অসহিষ্ণুতা নিয়ে কুখ্যাতি, এদিকে অন্দরমহলে টিনএজ বিধর্মী শিক্ষিকার সঙ্গে টিনএজ ছাত্র শাহজাদার প্রেম চলছে। বেশ একটা পিরিয়ড লাভ স্টোরির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, তাই না?
জুলিয়ানার জন্ম ও তাঁর বাবা-মা’র সামাজিক অবস্থান নিয়ে মতভেদ আছে যথেষ্ট। এক শ্রেণীর ঐতিহাসিক মনে করেন, তাঁর পর্তুগিজ বাবা-মা কেরালার কোচিতে থাকতেন। ডাচ আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচাতে তাঁরা প্রথমে গোয়া, ও পরে বাংলার হুগলিতে পালিয়ে যান। গত শতাব্দের আশির দশক থেকে তিরিশ বছরের গবেষণা শেষে দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়ামের প্রাক্তন কর্ণধার মধুকর তিওয়ারি ও সংরক্ষক রঘুরাজ সিংহ চৌহান একটি বই প্রকাশ করেন ২০১৭ সালে – নাম তার ‘জুলিয়ানা নামা’। পর্তুগিজ ও পারসিক সহ পাঁচটি ভাষায় উপলব্ধ বিভিন্ন দলিল, চিঠি, বই ও বিভিন্ন সামগ্রী অনুসন্ধান করে জুলিয়ানার দীর্ঘ ঊননব্বই বছরের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা একসূত্রে গেঁথেছেন এই দুই গবেষক ও লেখক। তাই তাঁদের গবেষণালব্ধ ইতিহাসের গল্পকে স্বীকৃতি দিতেই হয়।
একটু পিছিয়ে আরম্ভ করি। উদারপন্থী ও সর্বধর্ম সমন্বয়ে বিশ্বাসী বলে পরিচিত আকবর পর্তুগিজ জেসুইটদের ধর্মপ্রচারে অনুমতি দিয়েছিলেন, পর্তুগিজ বণিকরাও পেয়েছিল বাণিজ্যের সুযোগ। কিন্তু তাঁর রাজত্বের শেষ সময় থেকে বাংলায় এই পর্তুগিজরাই মুঘলদের মাথাব্যথার যথেষ্ট কারণ হিসাবে দাঁড়ায়। মগদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জলদস্যুগিরি করে বাংলার উপকূলে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল এরা। মাইলের পর মাইল উপকূলের গ্রামে লুটপাট চালিয়ে আর গ্রামবাসীদের ক্রীতদাস বানিয়ে আরাকান সহ বিভিন্ন দূর প্রাচ্যের দেশে যোগান দিত তারা। ১৭৩২ সালে শাহ জাহান পর্তুগিজদের আচরণে যারপরনাই বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হয়ে হুগলিতে পর্তুগিজদের ঘাঁটি আক্রমণ করে সাড়ে চার হাজার পর্তুগিজকে বন্দী করে তৎকালীন মুঘল রাজধানী আগ্রায় নিয়ে আসেন। জুলিয়ানার বাবা মুসলমান হয়ে গেলেও তাঁর মা নিজের ধর্ম ত্যাগ করেননি। ১৬৪৫ সালে দিল্লিতে জন্ম হয় জুলিয়ানার। জুলিয়ানার মা তখন বাদশাহী হারেমের বাঁদি। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর ছোট জুলিয়ানা দিল্লিতে বেড়ে ওঠেন পর্তুগিজ যাজক ফাদার অ্যান্টোনিও ডি মাগাইয়ানেস (Antonio de Magalhanes) এর তত্ত্বাবধানে। এরপর কিশোরী জীবনের বহু অংশ কাটান গোয়ায়। জেসুইট ফাদারের হাত ধরে তিনি পরিচিত হন বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে, আয়ত্ব করেন বাণিজ্যবিদ্যা, অর্জন করেন ইতিহাসে জ্ঞান আর চিকিসাশাস্ত্র ও শল্যবিদ্যায় পারদর্শিতা। সেই সময়ে কূটনীতিবিদ বা রাজদূত হিসাবে কাজ করতে গেলে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার যে পরিধির প্রয়োজন হতো অল্প বয়সেই তা অর্জন করেছিলেন এই নারী। অল্পবয়সেই বিবাহ হয়েছিল তাঁর, কিন্তু খুব সময়ের মধ্যেই তিনি স্বামীকে হারান। ফাদার মাগাইয়ানেসের প্রভাবে বাদশাহী অন্দরমহলে তরুণী জুলিয়ানার একটা চাকরি জুটে যায়। আওরঙ্গজেবের দ্বিতীয় পুত্র শাহজাদা মুয়াজ্জমের শিক্ষিকা হিসাবে নিযুক্ত হলেন তিনি। মুয়াজ্জম বা শাহ আলম ছিলেন শাহ জাহানের অন্যতম প্রিয় পৌত্র। ঠাকুরদার প্রতি বাবার নিষ্ঠুর আচরণ ও তাঁর অন্যায় বন্দীদশা হেতু তরুণ মুয়াজ্জম তখন ছিলেন মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত। শ্বেতাঙ্গিনী জুলিয়ানা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন শাহজাদার মানসিক সম্বল ও একান্ত বিশ্বাসভাজন। শাহজাদাকে তিনি ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন ও নিজের হাতে আগলে রাখতেন। সাম্রাজ্য শাসনে আওরঙ্গজেব শাহজাদাকে ভারতবর্ষের যে প্রান্তেই পাঠান না কেন, জুলিয়ানা সেখানে শাহজাদার সঙ্গে গেছেন। আওরঙ্গজেব সন্দেহ করেছিলেন যে শাহজাদা মুয়াজ্জম তাঁকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করতে পারেন – সেই সন্দেহের বশে তিনি নিজের ছেলেকে সাত বছর বন্দী করে রেখেছিলেন। সেই সময়ে নিজের জীবন বাজি রেখে জুলিয়ানা নিয়মিত যেতেন কারাগারে – সঙ্গে নিয়ে যেতেন বিবিধ বিলাস সামগ্রী, যাতে শাহজাদার বন্দী জীবন একটু আরামের হয়।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দাক্ষিণাত্যের শাসক তাঁর প্রিয়তম পুত্র শাহাজাদা আজম নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন, যদিও তিনি আওরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন না। সেই সময় শাহজাদা মুয়াজ্জম ছিলেন লাহোরের শাসক। জুলিয়ানা সঙ্গে সঙ্গে লাহোর চলে যান শাহজাদাকে সিংহাসনের সোপানে পৌঁছোবার সঠিক শলা দেবার উদ্দেশ্যে। এর পর দুজনে একসঙ্গে যাত্রা করেন দাক্ষিণাত্যে, শাহজাদা আজমের সঙ্গে কূটনৈতিক বোঝাপড়া করতে; উদ্দেশ্য ছিল মৃত আওরঙ্গজেবের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সাম্রাজ্যকে দুই ভাইয়ের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া। সেই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ না হওয়ায় জাজউ-এর ভয়ঙ্কর যুদ্ধে মুয়াজ্জম তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই আজমকে তাঁর তিন পুত্রসহ হত্যা করে ময়ূর সিংহাসনে আসীন হন, উপাধি নেন বাহাদুর শাহ। সেই যুদ্ধে গুরু গোবিন্দ সিংহ প্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করেছিলেন শাহজাদা মুয়াজ্জমকে। আর সেই যুদ্ধক্ষেত্রে হাতির পিঠে চেপে শাহজাদার পাশে থেকে তাঁকে ক্রমাগত মানসিক সাহস জুগিয়ে গেছেন আর কেউ নন – জুলিয়ানা স্বয়ং। সম্রাট হবার পর শাহজাদা সেই ভালোবাসার প্রতিদানও দিয়েছিলেন। বাহাদুর শাহ জুলিয়ানাকে দিয়েছিলেন দারাশিকোর বিলাসবহুল প্রাসাদ। তাঁরা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ না হলেও পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসার জায়গা অটুট ছিল সম্রাটের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। সম্রাট তাঁকে এতটাই বিশ্বাস করতেন যে জুলিয়ানা ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন মুঘল দরবারের ক্ষমতার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সম্রাট তাঁর সঙ্গে আলোচনা না করে নিতেন না। জুলিয়ানার নিজের ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা দেখে সম্রাট তাঁকে ‘জুলিয়ানা ফিদায়েঁ’ উপাধি দেন। সম্রাট তাঁকে নব্বই হাজার টাকার উপহার দেন আর চারটি গ্রামের জায়গিরদারি দেন, যা থেকে জুলিয়ানার আয় ছিল বছর প্রতি পঞ্চাশ হাজার টাকা। জুলিয়ানা নিজেকে ‘ফিদায়েঁ বাহাদুর শাহ জুলিয়ানা’ নামে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন, যার অর্থ ছিল ‘বাহাদুর শাহের প্রতি নিবেদিত-প্রাণ জুলিয়ানা’। জুলিয়ানা অনুচরবৃন্দের একটি দল নিয়ে যাতায়াত করতেন – সঙ্গে থাকতো সুন্দর সাজে দুটি হাতি যাদের ওপরে রাখা থাকতো লাল মানদণ্ডের মাথায় সাদা সুদৃশ্য দুটি ক্রস। ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার বশে সম্রাট বংশপরম্পরায় ব্যবহারের জন্য ‘জুলিয়ানা’ নামের একটি উচ্চমর্যাদার পদ সৃষ্টি করেন জুলিয়ানার পরিবারের জন্য।
আর ঠিক এই কারণেই ডাচ, পর্তুগিজ আর ইংরেজ বণিকদের সম্রাটের কাছে পৌঁছনোর জন্য জুলিয়ানা হয়ে উঠলেন এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ১৭১১ সালের ডিসেম্বর মাসে লাহোর শহরের অদূরে সরায় খান খানান-এ ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎকালীন কর্ণধার ইয়োহান জোশুয়া কেটেলার-এর নেতৃত্বে একদল ইউরোপীয় বণিক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে জুলিয়ানার সঙ্গে মিলিত হন বাণিজ্যিক সুবিধার একগুচ্ছ দাবি নিয়ে। এর কয়েক মাসের মধ্যেই সম্রাটের মৃত্যু হয় ও উত্তরাধিকারের দাবি নিয়ে সম্রাট বাহাদুর শাহের চার পুত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হন। অবশেষে পরবর্তী সম্রাট হিসাবে ময়ূর সিংহাসনে বসেন শাহ জাহানধার। শুধু বাহাদুর শাহ নন , জাহানধার শাহের ওপরেও জুলিয়ানার এতটাই প্রভাব ছিল যে নতুন সম্রাট পর্যন্ত জুলিয়ানার কথায় ডাচ বণিকদের সমস্ত দাবি মেনে নেন।
জুলিয়ানার সাহায্যে মুঘল সাম্রাজ্যে পর্তুগিজরা নানাবিধ সুবিধা নিয়মিত পেত। খ্রিস্টান বলে মুঘলদের হাতে পর্তুগিজদের ওপর কোনো রকম অত্যাচার বা অবিচার হতে দেননি জুলিয়ানা। সেই সময়কার পর্তুগিজ ভাইসরয় আর পর্তুগালের সম্রাটের মধ্যে চিঠির আদানপ্রদান হলে জুলিয়ানার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন দুজনেই। ভাইসরয়ের মাধ্যমে জুলিয়ানা পর্তুগিজ সম্রাটকে একটি চিঠি লেখেন যেখানে তিনি নিজেকে ‘সম্রাটের দাসানুদাস’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। ১৭১১ থেকে ১৭১৪ সালের মধ্যে ভাইসরয় জুলিয়ানাকে চারটে চিঠি লেখেন। প্রতিটি চিঠিতে জুলিয়ানা ও তাঁর পরিবারের প্রতি ভাইসরয় শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। তিনি এমনকি জুলিয়ানার সম্পর্কে নাতি ও ভ্রাতুষ্পুত্রীর স্বামীকেও পর্তুগাল রাজপরিবারের সাম্মানিক উপাধি প্রদান করেন। ১৭১৭ সালে পর্তুগিজ সম্রাটকে লেখা ভাইসরয়ের একটি চিঠি থেকে জানা যায় যে সম্রাট স্বয়ং যে চিঠিটি জুলিয়ানাকে লিখেছিলেন, তা জুলিয়ানার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ওই একই চিঠিতে ভাইসরয় জুলিয়ানাকে সর্বগুণসমন্বিতা মহিয়সী নারী বলে সম্বোধন করেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জুলিয়ানাকে লেখা পর্তুগিজ সম্রাটের চিঠিটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সম্রাট জাহানধারের শাসনকালে জুলিয়ানা দরবারের কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়ে গোয়ায় ফিরে গিয়ে অবসর জীবন যাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সম্রাটের বিশেষ অনুরোধে দরবারের কাজ চালিয়ে যেতে সম্মত হন জুলিয়ানা। ইউরোপের এক পর্যটক ভ্যালেন্টিন তাঁর বিবরণীতে দরবার ও সম্রাটের ওপর জুলিয়ানার প্রভাব দেখে তাঁকে ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই-এর রানী মাদাম দ্য মাঁতেনন-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তবে খুব শিগগির জাহানধারের মৃত্যুর পরেই জুলিয়ানা বিপদে পড়েন। যদিও নিজের হাতে পরবর্তী সম্রাট ফারুকশিয়ারের কার্বাঙ্কলের চিকিৎসা করে তাঁকে সারিয়ে তুললে সম্রাটের ওপর তাঁর প্রভাব বাড়ে বহুগুন। মুঘল বংশের রাজনৈতিক ডামাডোল আর সিংহাসনের অধিকার নিয়ে বংশধরদের মধ্যে সংঘর্ষের মাঝে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাভোগ করতে থাকল। তারা হয়ে উঠলো কিংমেকার। তাদের চক্রান্তে জুলিয়ানা সমস্ত সম্পদ ও সম্মান হারিয়ে কারারুদ্ধ হন সাময়িকভাবে। এরপর মহম্মদ শাহ রঙ্গিলা সম্রাট হলে জুলিয়ানার সসম্মানে পুনর্বাসন হয়। মহম্মদ শাহের অভিষেকের সময় জুলিয়ানা নিজের হাতে রাজমুকুট তরুণ সম্রাটের হাতে তুলে দেন। কারণ পদমর্যাদায় জুলিয়ানা ছিলেন রাজমুকুট ও সিংহাসনের রক্ষক। প্রিয় পুরুষ বাহাদুর শাহের পৌত্র মহম্মদ শাহের প্রতি জুলিয়ানার স্নেহ ছিল প্রবল। সম্রাট হবার অব্যবহিত পরে সিংহাসন নিষ্কণ্টক রাখতে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় আব্দুল্লা খান আর হুসেন আলি খানকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেন মহম্মদ শাহ। এ ব্যাপারে জুলিয়ানার কি কোনো প্রভাব ছিল সম্রাটের ওপরে? যদিও এর কোনো প্রমাণ নেই তবে এ অসম্ভব ছিল না, কারণ মহম্মদ শাহ সাম্রাজ্য চালানোর মতো যথেষ্ট দূরদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন না। আর জুলিয়ানা দেখেছেন সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় কী ভাবে অপরিণামদর্শী মুঘল বংশধরদের মধ্যে ক্ষমতার যুদ্ধ বাধিয়েছিল নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে। ১৭২০ সালে যমুনার তীরে ওখলাতে মহম্মদ শাহের পৃষ্ঠপোষণায় ইউরোপীয় বণিক ও পর্যটকদের জন্য জুলিয়ানা একটা সরাইখানা বানিয়ে দেন। কালে কালে সেই জায়গার নাম হয়ে গেছে সরায় জুলেনা গাঁও।
১৭৩২ সালে জুলিয়ানার মৃত্যু হলে তাঁকে আগ্রার পাদ্রে স্যান্টোস সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর শেষ শয্যার ওপরের ফলকটি আর নেই, তাই নিশ্চিতভাবে আর বলা সম্ভব নয় কোনটি তাঁর সমাধি। তাঁর মৃত্যুর সাত বছর পর নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করলে জুলিয়ানার প্রাসাদটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ১৭৪০ সালে এক জেসুইট পাদ্রি ফাদার সাইন্স (Saignes) তাঁর বিবরণীতে এই প্রাসাদ ধ্বংসের কথা বিবৃত করেন। জেসুইটরা তাঁকে ‘পেট্রোনেস অফ দ্য সোসাইটি’ হিসাবে গণ্য করতেন।
জুলিয়ানার জন্ম ভরতবর্ষে, আর মৃত্যুও ভারতবর্ষে। আমৃত্যু তিনি ছিলেন মুঘলবংশের প্রতি দায়বদ্ধ। ভারতবর্ষ ছিল তাঁর জন্মভূমি আর কর্মভূমি। জন্মসূত্রে পর্তুগিজ হলেও তাঁকে ভারতীয় বলতে বোধহয় বিশেষ বাধা থাকার কথা নয়। আশ্চর্যের কথা এই যে সম্পূর্ণ বিজাতীয় এই রমণী মুঘল রাজনীতির ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছলেও মাটিতে পা রেখেই হাঁটতেন – ক্ষমতার অপব্যবহার করে কখনোই সীমা লঙ্ঘন করেননি। একাধারে চিকিৎসক, শিক্ষক, বাণিজ্যিক উপদেষ্টা ও কূটনীতিক – ‘জুলিয়ানা নামা’র লেখকদ্বয় শ্রী তিওয়ারি ও শ্রী চৌহান মনে করেন যে এই প্রতিভাময়ী নারী জুলিয়ানা মধ্যযুগীয় ঐতিহাসিকদের কাছে যথাযোগ্য স্থান পাননি। ১৭২৬ সালে ডাচরা তাঁর একমাত্র পোর্ট্রেট প্রকাশ করেন। সেই ছবিটিই নিচে দিলাম।
তথ্যসূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস , উইকিপিডিয়া।
পার্থ মণ্ডল বিশে সেপ্টেম্বর , বিশ একুশ
সূত্রঃ সংগ্রহিত মলাট থেকে।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ২১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,