লেখা: রাজীব আহাম্মদ।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, জিয়াউর রহমান যতটা গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, বিএনপিতে তা স্থাপিত হয়নি। তারেক রহমানকে অনুপযুক্ত মনে করি না। তবে বড় সমস্যা হলো, তিনি নিজে দল যতটা না নিয়ন্ত্রণ করেন, বিএনপি নেতারা তার হাতে তার চেয়ে বেশি দায়িত্ব দিয়ে দেন। এই নেতারা নিজেদের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতেও কিছু করতে পারেননি বা করেননি। তারেক রহমানের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা তার সমালোচনা করা যায়- এই বোধ তিনি বিএনপি নেতাদের মধ্যে তৈরি করতে পারেননি। তারেক বিএনপির সম্পদ; বোঝাও।
ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে সমকালের কথোপকথন :
প্রশ্ন :আপনাকে বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করা হলেও দলের মহাসচিব তো বলেছেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বয়সের ভারে আবোলতাবোল বলছেন।
উত্তর :মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খাঁটি কথা বলেছেন। আমার বয়স হয়েছে, সত্যি কথা। কিন্তু আবোলতাবোল কথা বলার যন্ত্র তো মাথা। সৌভাগ্যবশত মাথা এখনও ঠিক আছে। আমার সততা ও সাহস আছে। সে জন্যই জনগণের কথা বলতে পারি। তা কারও কারও কাছে আবোলতাবোল মনে হতে পারে। তবে তারা কোনো প্রমাণ দেননি- কী আবোলতাবোল বলছি। তাতে আমি মনঃক্ষুণ্ণ হইনি। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা তাদের আত্মরক্ষার পদ্ধতি।
প্রশ্ন :আত্মরক্ষা মানে? বিএনপি নেতাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায় ঢাকাকে বোঝাচ্ছেন?
উত্তর :সেটাই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির গঠনতন্ত্র অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে পড়ছিলাম। জিয়াউর রহমান যতটা গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, বিএনপিতে তা স্থাপিত হয়নি। ফলে সব সময় এক ব্যক্তির দল হয়েছে। যদি তারেক রহমানের বিষয়টি ধরি, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাকে তো সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নিয়োগের অধিকারই ছিল না খালেদা জিয়ার। গঠনতন্ত্র তাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১০ শতাংশ সদস্য মনোনীত করার ক্ষমতা দিয়েছে।
প্রশ্ন :তারেক রহমানের সবচেয়ে সমালোচক বোধ হয় আপনিই?
উত্তর :তারেক রহমানকে অনুপযুক্ত মনে করি না। তবে বড় সমস্যা হলো, তারেক দেশে নেই। তার দেশে আসা উচিতও না। এলে বোকামি হবে। তবে সমস্যা হলো, তিনি লন্ডন থেকে বসে দলের কলকাঠি নাড়েন। উনি (তারেক) যতটা না নিয়ন্ত্রণ করেন বা করতে চান, বিএনপি নেতারা তার হাতে তার চেয়ে বেশি দায়িত্ব দিয়ে দেন। বিএনপি এত বড় একটা দল, এত নেতা- তারা নিজেরা কিছু করতে পারেন না! আগে বলত, ‘ম্যাডাম, আপনি করেন।’ এখন তারেককে বলে। বিএনপি নেতাদের সমস্যা হলে সব তারেক রহমানের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়।
প্রশ্ন :আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধু পরিবার এবং বিএনপিতে জিয়া পরিবার ঐক্যের প্রতীক। তারা না থাকায় অতীতে দল ভেঙেছে। বিএনপি নেতারাই তো বলেন, জিয়া পরিবার ছাড়া কেউ নেই নেতৃত্ব দেওয়ার।
উত্তর :এটা ভুল কথা। পৃথিবীতে কারও জন্য কিছু আটকে থাকে না। আজ এত বছর বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। খালেদা জিয়া জেলে। এখনও তো বিএনপি ধ্বংস হয়ে যায়নি।
প্রশ্ন :খালেদা জিয়া তো আছেন।
উত্তর :কোথায় আছেন। খালেদা জিয়াকে কোনো ভূমিকাই রাখতে দেওয়া হচ্ছে না। উনি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরোজায় থেকে কী লাভ হচ্ছে? তাকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে (বিএনপি নেতারা)।
আমার চিন্তা হলো, দেশের রাজনীতির হচ্ছে কী। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে একের পর এক কূটকৌশল করছে। এখন আবার হঠাৎ নির্বাচনমুখী হয়েছে। ধরেই নিলাম, আওয়ামী লীগ একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে। জনগণ এসে ভোট দিল। তাতে বিএনপি নির্বাচিত হলো। তাতে কি দেশের রাজনীতির কোনো পরিবর্তন আসবে? আওয়ামী লীগ এখন যেসব কাজ করছে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে সেগুলো করা বন্ধ করবে?
প্রশ্ন :’বিএনপি বন্ধু’ পরিচিতি নিয়েও আপনি বলছেন বিএনপি ঠিক পথে নেই?
উত্তর :অবশ্যই সঠিক পথে নেই। আন্দোলনেও নেই। মাঠেও নেই। রাজনীতিতেও নেই। বিএনপি যদি সঠিক পথে থাকত, তাহলে কি খালেদা জিয়াকে জেলে থাকতে হয়?
প্রশ্ন :বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টাই করছেন। কিন্তু সরকারের দমনপীড়নের কারণে পেরে ওঠেননি।
উত্তর :বাজে কথা। পৃথিবীর সব ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী দলকে অত্যাচার-নির্যাতন করে। এটা নতুন নয়। তারা তাদের (বিএনপি) অযোগ্যতাকে ঢাকার জন্য দমনপীড়নের কথা বলে থাকে।
প্রশ্ন :কিন্তু বিএনপি নেতাদের ভাষ্য ও পত্রিকার খবর অনুযায়ী তো তারেক রহমান বিএনপির স্থায়ী কমিটিকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন।
উত্তর :স্বাধীনতা দিলেই কী। স্বাধীনতা ভোগ করার, স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বোধ তাদের নেই। তারেক এখনও এই কনফিডেন্স তৈরি করতে পারেনি, তার বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে। বিএনপি নেতারা তারেকের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে পারবেন- এই কনফিডেন্স নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত তারেক এটা সৃষ্টি করতে না পারবে- ততক্ষণ স্থায়ী কমিটি বলি আর কেন্দ্রীয় কমিটি, কেউ স্বাধীনভাবে কাজ করার সাহস করবে না। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই, গণস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠায় আমার সামান্য অবদান আছে। আমি চিন্তা করেছিলাম, গণস্বাস্থ্যের জন্য ধানমন্ডিতে একটা বাড়ি কিনব। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের অধিকাংশ আমার মনোনীত। কিন্তু ট্রাস্টিরা আমার বাড়ি কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেনি। তারেকের ব্যর্থতা হলো, মিটিংয়ে একজনও তার বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি। তারেক যা বলে, তাতে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে। তিনি কখনও বিএনপি নেতাদের জিজ্ঞাসা করেছেন, কেন খালেদা জিয়ার জামিন হয় না? তারেক বিএনপির সম্পদও, বোঝাও।
প্রশ্ন :খালেদা জিয়া তো দুটি মামলায় দণ্ডিত। নির্বাহী আদেশে তিনি কারাগারের বাইরে আছেন।
উত্তর :কেন তার জামিন হবে না। তিনি তো দেশে আছেন। কত লোক তো জজের চেম্বার থেকে জামিন নিয়ে যায়। আদালত খালেদা জিয়াকে জামিন দিতে পারেন না? আদালত তো স্বপ্রণোদিত হয়েও জামিন দিতে পারেন। এর জন্য বিএনপিকে আলাপটা তো সৃষ্টি করতে হবে।
প্রশ্ন :গত নির্বাচনের আগে বিএনপিকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের উদ্যোক্তাদের একজন আপনি। সুষ্ঠু ভোটের জন্য আলোচনা করে নির্বাচনে এলেন। আপনারা পরে বললেন, ভোট ডাকাতি হয়েছে। অনেকেই বলেন, আপনি ও ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে জেনেবুঝেই নির্বাচনে নিয়ে গিয়েছিলেন?
উত্তর :না, এটা আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা এত বুদ্ধিমান না। আমাদের কল্পনাতেই ছিল না, আওয়ামী লীগ আগের রাতেই ভোট ডাকাতি করে ফেলবে। আমাদের ধারণা ছিল, জনগণ কেন্দ্রে গেলে একটু-আধটু গণ্ডগোল হতে পারে। কিন্তু রাতের বেলায় ভোট হবে- এটা আমাদের চিন্তাতেও ছিল না। নির্বাচনের প্রচারে যেভাবে বিএনপির আসার কথা ছিল, বিএনপি সেভাবে আসেনি। এটা সত্যি, জনগণের মধ্যে বিএনপিকে ভোট দিতে জোয়ার ছিল। এটাই কাল হয়েছে। বিএনপি তখন ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে অতি আত্মবিশ্বাসী ছিল। আওয়ামী লীগ যে আগের রাতে ভোটের চাল চালবে, তা বিএনপি ধরতেই পারেনি। আমি ও ড. কামালের যে ভূমিকা পালনের ছিল, তা করেছি। ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছি। তবে অবশ্যই ব্যর্থ হচ্ছি। তার মাশুল পুরো জাতি দিচ্ছে।
প্রশ্ন :ভোটের আগে তো আপনাদের অনেক সিদ্ধান্ত ছিল।
উত্তর :ছিল তো। কিন্তু বিএনপি বাস্তবায়ন করেনি। সিদ্ধান্ত হলো, বোগাস ভোট ঠেকাতে ঐক্যজোটের প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনের সামনে অবস্থান নেবে। কিন্তু বিএনপি এলো না। পরে বললাম, নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। বিএনপির মাত্র ৭০ জন মামলা করল। তারা বলে, মামলা করে কী হবে! খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপি একই কাজ করেছে। আইনি লড়াই ও রাজপথে একসঙ্গে থাকা উচিত ছিল। যেদিন যেদিন খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি ছিল, সেদিন ১০ হাজার মানুষ নিয়ে আদালতের সামনে চুপচাপ হলেও বসে থাকা উচিত ছিল। তাতে বিচারপতিদের সাহস হতো।
এই জন্যই তো বলি, বিএনপি নেতারা কোনো সিদ্ধান্তই নিজেরা নিতে পারে না। তারেক বলে দেবে, তারপর তারা করবে। বিএনপিকে বোঝানো যায়নি, আমেরিকা-ইন্ডিয়া-চায়নার পেছনে ঘুরে লাভ নেই। আন্দোলন মাঠে না রাখলে কোনো রায় পাওয়া যাবে না। খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে গেলেন। বিএনপি তো অন্তত রিভিউয়ে যেত পারত।
প্রশ্ন :তাহলে কি বিএনপির কোনো আশাই দেখছেন না?
উত্তর :আরেকটা নির্বাচন আসছে। আওয়ামী লীগ পাঁয়তারা করছে- আরেক প্রতারণার নির্বাচন করার। বিএনপি তা আটকাতে কিছু কি করছে?
প্রশ্ন :আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ করছেন বারবার। আজকের আওয়ামী লীগকে কি বঙ্গবন্ধুর, সোহরাওয়ার্দীর উত্তরসূরি মনে করেন না?
উত্তর :আওয়ামী লীগ তো ব্যবসায়ীদের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার দল হয়ে গেছে। সেই আওয়ামী লীগ থাকলে আমলারা এত মাথায় উঠল কেমনে? আওয়ামী লীগ ডাকাতি করে হোক আর যেভাবেই হোক, ক্ষমতায় আছে। তারা আজ পর্যন্ত জামায়াত বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিল না। আওয়ামী লীগ হাইকোর্ট দেখায়। এগুলো সুবিধাবাদী রাজনীতি।
প্রশ্ন :জামায়াত প্রসঙ্গ যখন আনলেন, তখন মনে করিয়ে দিই আপনি কিন্তু অনেকবার বিএনপিকে উপদেশ দিয়েছিলেন জামায়াত ছাড়তে।
উত্তর :আমি মনে করি, জামায়াতের রাজনীতি করার অধিকার আছে। তবে তাদের বাপ-মা যে অপরাধ করেছে, তার জন্য ক্ষমা চেয়ে রাজনীতি করতে হবে। জামায়াত নেতাদের যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, মানুষ মেরেছিল তাদের ফাঁসি হয়ে গেছে। এখন যারা আছে, তারা তো মুক্তিযুদ্ধের পরের। তারা তো খারাপ কাজ করেনি। তাদের ক্ষমা চাইতে অসুবিধা কী? আমার বিশ্বাস, শেখ মুজিব যেহেতু ক্ষমা করেছেন, জামায়াত চাইলে ক্ষমা পাবে। বিএনপিরও পরিস্কার করে বলা উচিত, আপনারা ক্ষমা চেয়ে আসুন। বিএনপি এই বলে জামায়াত সঙ্গে নেই, এই বলে আছে। এমন চালাকি করে রাজনীতিতে টিকে থাকা যায় না।
প্রশ্ন :আপনি চিকিৎসক। করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের সমালোচনায় মুখর আপনি।
উত্তর :হাসপাতালের অবস্থা যেমন-তেমন হোক, সরকারকে আগে সত্য কথা বলা শিখতে হবে। আমলাদের চালাকির চক্করে না পড়ে মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। শেখ হাসিনা বুঝতে পারছেন না, ভবিষ্যতে যদি অন্য কোনো সরকার আসে, তাহলে করোনার টিকা নিয়ে উনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হবে। যদিও ওই টাকাটা তিনি নেননি। যেভাবে খালেদা জিয়া (দুর্নীতির মামলার) টাকা নেননি। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলাটা হবে, বাজারে সুলভ মূল্যের টিকা থাকার পরও রাশিয়ান টিকা ছিল; কিন্তু বেশি দাম দিয়ে অন্য দেশের টিকা কেনা হয়েছে।
প্রশ্ন :করোনা তো কমে যাচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, অবকাঠামো হচ্ছে, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু হচ্ছে- এরপরও সরকারকে ব্যর্থ বলা ঠিক হবে?
উত্তর :এতটা তো বিদ্যুতের মতো হয়েছে। সরকার বলে বিদ্যুৎ দিয়েছে। কিন্তু কী দামে দিয়েছে? এ জন্য আমাকে কী দিতে হয়েছে? অবকাঠামো করার নামে গার্মেন্টস শ্রমিকের রপ্তানির ডলার আর প্রবাসী শ্রমিকের রেমিট্যান্সের টাকা হরিলুট হচ্ছে। সরকারের লোকদের টাকা বিলানো হচ্ছে। শ্রমিকের ছেলে, সুইপারের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছে- সেটা উন্নয়ন। খালি বিল্ডিং উন্নয়ন না। এখনও হাসপাতালে ছেলের জন্য মাকে সিট ছেড়ে দিতে হয়। এটা উন্নয়ন না।
সূত্রঃ সমকাল।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ১৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,