লেখক: পার্থ শঙ্কর সাহা।
পরপর দুটো ঘটনা। একটি হলো ১৭ আগস্ট। এদিন বিএনপির সদ্য গঠিত মহানগর কমিটি চন্দ্রিমা উদ্যানে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান ও সদস্যসচিব আমিনুল হকের নেতৃত্বে মিছিলটি চন্দ্রিমা উদ্যান এলাকায় মিছিলসহ ঢোকার মুখেই পুলিশ বাধা দেয়।
দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়। একপর্যায়ে পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিএনপির কর্মীদের মধ্য থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে পুলিশও মারমুখী হয়ে ওঠে। আমিনুল হকসহ বিএনপির কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হন। পুলিশ গ্রেপ্তারও করে কয়েকজনকে।
এর পরের ঘটনা চট্টগ্রামে, ২ সেপ্টেম্বরের। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সেদিন নগরীর কাজীর দেউড়ির নাসিমন ভবনে নগর বিএনপির অফিসে সভা ছিল। একটি মিছিল নগর বিএনপির ওই সভায় যোগ দিতে আসছিল। নাসিমন ভবনের কাছে মিছিলটি পৌঁছাতেই পুলিশ তাতে বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ বেধে যায়। ১০ থেকে ১৫ মিনিট পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে। এ সময় নগর বিএনপির সভাটিও বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ সেখান থেকেও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ দাবি করে, আগের মামলার কয়েক আসামিকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ দুই ঘটনার আগে সম্প্রতি বিএনপির এমন কর্মসূচিতে বাধা দিতে দেখা যায়নি। কিন্তু সম্প্রতি বিএনপির ওপর শাসকগোষ্ঠীর এমন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকার কি বিএনপিকে ঘরে তুলে রাখার আয়োজন শুরু করেছে? এটা কি নির্বাচনী তৎপরতার প্রারম্ভিক রূপ, নাকি অন্য কিছু? শাসক দলের একাধিক নেতা, রাজনীতির বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব ঘটনার মাধ্যমে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে একটি বার্তা দিতে চায়।
বিরোধী দলের ওপর চড়াও আচরণ আফগানিস্তানে তালেবানের দখলের প্রায় পরপরই শুরু হয়েছে। কাবুল দখলের পরপরই এ দেশে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে একধরনের উল্লাস ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এর বহিঃপ্রকাশ বিশেষত দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শাসক দলের অনেক নেতাই মনে করে করেন, এ দেশের কিছু দল ও সংগঠন বিশ্বের কোথাও কিছু ঘটলে উল্লাস দেখায়। বিএনপিও এদের পেছন থেকে মদদ দেয়।
অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের মতে, সরকার ভয় থেকে বিএনপিকে দমনের ইস্যু খোঁজে। সব সময় পতনের ভয়ে ভীত থাকায় বিএনপিকে দাঁড়াতে দিতে চায় না। বিএনপি উগ্রবাদিতাকে প্রশ্রয় দেয় না। তিনি বলেন, একের পর এক গুম-খুন হয়েছেন বিএনপির নেতারা। মামলা রয়েছে লাখ লাখ নেতার বিরুদ্ধে। এখন একটি ইস্যু সামনে এনে আরও নেতার বিরুদ্ধে মামলা, হামলা ও নির্যাতনের পথে হাঁটছে সরকার।
বিএনপির এই নেতা বলেন, বিএনপি নিজের শক্তিতে চলে। সেটা গণতান্ত্রিক পন্থা। বিএনপি চায় একটা সুষ্ঠু নির্বাচন। সেই লক্ষ্যেই আন্দোলন করছে।
শাসক দলের দুজন দায়িত্বশীল নেতার মত হচ্ছে, এসব গোষ্ঠীর কাছে বিএনপি মুরব্বি সমতুল্য দল। এ দলের শক্তি সঞ্চয়ের অর্থ হলো, এসব উগ্রবাদিতার পালে হাওয়া লাগা। সে হাওয়া লাগতে দিতে চায় না শাসক দল। পাশাপাশি শাসক দল শক্ত অবস্থান নিয়ে পশ্চিমাদেরও এ বার্তা দিতে চায় যে তারা এসব উগ্রপন্থার বিপক্ষে। উপমহাদেশের একটি দেশের উগ্রপন্থার ক্ষমতা দখলের যেন আর বিস্তার না ঘটে, সে জন্য তারা সজাগ আছে; এমন বার্তা ও অবস্থান আখেরে আওয়ামী লীগকে লাভবান করবে বলেই মনে করছেন তাঁরা।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন আসছে, পাশাপাশি তালেবানের উত্থানে দেশের অনেক দলের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। এটা আমরা লক্ষ করছি। দেশের বাইরে কিছু ঘটলে বিএনপি এভাবে আগেও উত্তেজিত হয়েছে। বিএনপির এসব তৎপরতায় সরকার সতর্ক অবস্থায় থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।’
তবে এ–ও ঠিক, আফগানিস্তানে তালেবানের দখলের পর বিএনপি প্রকাশ্যে কোনো বিবৃতি দেয়নি। কোনো নেতাও এ নিয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমর্থক নন, এমন অনেকে এ নিয়ে সরব হয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে একজন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, তালেবানদের বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। আজকে যদি তাদের স্বীকৃতি না দেয়, তারা ভারতের হিন্দুত্ববাদের দিকে যাবে। উদারপন্থী ইসলামিক রাষ্ট্র না হয়ে তারা কঠোর ধর্মান্ধ রাষ্ট্র হবে।
গত ১৭ আগস্ট ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যদি তাদের স্বীকৃতি দিই, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করি, তাদের আমরা প্রভাবিত করতে পারব। একটা উদার ইসলামিক রাষ্ট্র হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর দেশ ছাড়তে মরিয়া আফগানদের দেখিয়ে তিনি লেখেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে কাবুল বিমানবন্দর ধরনের দৃশ্য বাংলাদেশেও হতে পারে।’
এ ঘটনার পর ছাত্রলীগের সমর্থকেরা সায়েন্স এনেক্স ভবনে গিয়ে আসিফ নজরুলের তালাবদ্ধ কক্ষে আরও তিনটি তালা লাগিয়ে দেন।
অবশ্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, তালেবান সরকারকে এখনই স্বীকৃতি দেবে না বাংলাদেশ। আরও পর্যবেক্ষণ ও নীতি দেখে এ ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
তা ছাড়া দীর্ঘ বিরতির পর ২২ আগস্ট একই মঞ্চে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং জামায়াতের সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ার এক মঞ্চে বসেন। জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজী মুক্তি পরিষদ আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে দুই দলের শীর্ষ নেতাদের অনেক দিন পর একই মঞ্চে দেখা যায়। সভায় সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য দেন মিয়া গোলাম পরওয়ার।
এ ঘটনার পর ৬ সেপ্টেম্বর মিয়া গোলাম পরওয়ারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় দলটির আরও ৯ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়া জামায়াত নেতারা হলেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, সাবেক সাংসদ হামিদুর রহমান, দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য আবদুর রব, অধ্যক্ষ ইজ্জত উল্লাহ, ছাত্রশিবিরের সাবেক দুই কেন্দ্রীয় সভাপতি মোবারক হোসাইন ও ইয়াসিন আরাফাত।
পুলিশ বলছে, রাষ্ট্রদ্রোহের ষড়যন্ত্র এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতে তাঁরা গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। এ জন্যই এ গ্রেপ্তার। চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি এবং গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দুটি অনুষ্ঠানে দুই দলের নেতাদের একসঙ্গে দেখা যায়। তারপর দুই মহাসচিব একই অনুষ্ঠানে আসার পরই জামায়াতের মহাসচিবের গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটল।
জামায়াতে ইসলামী ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে সরকারে ছিল। যুদ্ধাপরাধের বিচারে বেশ কয়েকজন জামায়াত নেতা দণ্ডিত হওয়ার পর থেকেই রাজনীতির মাঠে একান্ত সঙ্গী জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সম্পর্কে দৃশ্যত ছেদ পড়ে।
শাসক দলের একাধিক নেতা মনে করেন, তালেবানি হাওয়া উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে উদ্দীপ্ত করেছে। এখন বিএনপির শক্তি সঞ্চয় এসব গোষ্ঠীকে আরও পুষ্ট করবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল বলছিলেন, বিএনপি যত সংগঠিত হবে, এসব শক্তির তত উত্থান হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, তালেবানের উত্থানে এ দেশে তাদের আদর্শের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আনন্দ ও উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক পর্যায়ে কিছু নড়াচড়া দেখা যেতে পারে। সমাজে একধরনের উগ্রবাদের প্রতি ঝোঁক বা আগ্রহ বাড়তে পারে। কিন্তু এর ফলে বাংলাদেশ শুধু নয়, পাকিস্তান বা উপমহাদেশের অন্যত্র রাজনীতির ভূদৃশ্য পাল্টে যাবে, এমন হবে না।
তারপরও হঠাৎ কঠোর হয়ে আওয়ামী লীগ কোন বার্তা দিচ্ছে, তা নিয়ে নিশ্চিত নন অধ্যাপক শান্তনু। তিনি বললেন, ‘ধারণা করতে পারি, আওয়ামী লীগ হয়তো আগ বাড়িয়ে কিছু ব্যাট করছে। তারা একটি বার্তা হয়তো পাঠাতে চায় যে তোমরা এ নিয়ে উত্তেজিত হয়ো না।’ তবে সরকার এ নিয়ে ভীত বলেও মনে করেন না তিনি। তাঁর কথা, এমন না হলে তারা ব্যাপক ধরপাকড়ে যেত। সরকারের কোনো হাইপার অ্যাকটিভ (অতি উৎসাহী) অংশ এ কাজ করে থাকতে পারে।
হেফাজতসহ একাধিক ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে নানা পর্যায়ে শাসক দল আওয়ামী লীগের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এসব সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী বা এক হয়ে মাঠের লড়াইয়ের রূপ নেয়নি। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিস্মম্ভ স্থাপন নিয়ে কিছু ইসলামপন্থী দলে তীব্র বিরোধিতা, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরে এসব দলের উগ্রবাদী আচরণ সরকারকে বেকায়দায় ফেলে। এরপর সোনারগাঁয়ের রিসোর্ট–কাণ্ডের পর হেফাজত নেতা মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হন আরও নেতা। কঠোর হয় সরকার। এবার তালেবানের উত্থানের পর আবারও কঠোরতায় আন্তর্জাতিক মহলকে শাসক দলের উগ্রবাদ প্রশ্নে তাদের শক্ত অবস্থান জানান দিতে চায়?
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, সরকার কঠোর হচ্ছে, ব্যাপারটা তা নয়। বিএনপি তাদের নানা কর্মসূচির নামে অরাজকতা করে। যেকোনো সরকারই এসবের বিরুদ্ধে কঠোর হবে, দায়িত্ব পালন করবে।
শাম্মী আহমেদ বলেন, আফগানিস্তানে তলেবানের উত্থানে এ দেশে নানা শক্তির উৎফুল্লতা আছে। তারা এই স্বপ্ন দেখতেই পারে। কিন্তু এ দেশের অসাম্প্রদায়িক মানুষ তালেবানি কাণ্ড এ দেশে হতে দেবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, দেশের বিভিন্ন ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক আছে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর একধরনের আনন্দ চোখে পড়েছে। রাজনৈতিক কারণে এবং করোনার কারণেও এসব নিয়ে উচ্চবাচ্য খুব বেশি দেখা যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই এ উল্লাস সীমাবদ্ধ থেকেছে। কিন্তু অনেকের মুখে এমন কথা আকারে–ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করছে, এবারের তালেবানরা একটু ‘মডারেট’ শক্তি। ঠিক আগের মতো নয়।
দেলোয়ার বলেন, মতাদর্শিক দিক থেকে এ দেশের কোনো কোনো গোষ্ঠী তালেবানের প্রতি টান অনুভব করে আবার এখান থেকে এসব গোষ্ঠী রাজনৈতিক ফায়দাও নিতে চায়। সরকারের কাছে দুই দিক থেকেই সতর্কতার ব্যাপার আছে। এই শক্তি যেভাবে ক্ষমতায় এসেছে, সেই শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশি গোষ্ঠীর সম্পর্ক ঝুঁকিপূর্ণ। সেটা এখন আওয়ামী বা যে–ই ক্ষমতায় থাকুক, সবার জন্যই এটি সত্য। উগ্রবাদিতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের মতাদর্শিক বিরোধিতা আছে। তাই এসব বিষয়ে তারা বেশি সচেতন।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ১২, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,