মৈত্রেয়ী দেবী আর মির্চা এলিয়াদের প্রেম কি শরীরী প্রেম না স্বর্গীয় প্রেম ?
কে জানে মনের অন্দরের গোপন খবর?
শুধু মৈত্রেয়ী দেবীর সেই সাহসী উচ্চারণ পাওয়া যায় ” ন হন্যতে ” বইটিতে,
“MIRCEA ! MIRCEA! I HAVE TOLD MY MOTHER THAT YOU HAVE KISSED ME ON MY FOREHEAD.”
এবার সেই প্রেমকথা।
মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা ড. সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন একজন বিখ্যাত দার্শনিক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একজন ঘনিষ্ঠ মানুষও ছিলেন।
১৯৩০ সালে রোমানীয় মির্চা এলিয়াদ কলকাতায় ভবানীপুরের বাড়িতে প্রফেসর সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের এলেন দর্শন পড়তে।
মির্চা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকতে শুরু করেন।
সুরেন্দ্রমোহন একজন উদারমনা মানুষ ছিলেন।
তিনি মির্চাকেও খুব স্নেহ করতেন।
সুরেন্দ্রনাথের মেয়ে মৈত্রেয়ীর বয়েস তখন চোদ্দ।
অপরুপ সুন্দরী, বড় বড় দীঘল চোখের মেয়েটি তার বয়েসের তুলনায় সব বিষয়ে অনেকটাই পরিণত ছিল।
ঠিক হল মৈত্রেয়ীর কাছে মির্চা বাংলা ভাষা শিখবেন।
আর মৈত্রেয়ী শিখবেন মির্চার কাছে তাদের দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি।
সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত এটাই চাইছিলেন দু’জনের মধ্যে দুই দেশের সংস্কৃতির বিনিময় হোক।
এদিকে কিশোরী মৈত্রেয়ী ও একুশ বছরের মির্চার মধ্যে ভালবাসার জন্ম হল বাড়ির লাইব্রেরি ঘরে।
মৈত্রেয়ী দেবী দূরে থাকলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।
মির্চা আবার রবীন্দ্রনাথকে হিংসা করতেন।
মৈত্রেয়ী বললেন মির্চাকে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার জন।
প্রেমিক নন।
একদিন মির্চা প্রপোজ করল মৈত্রেয়ীকে,
আমাকে তুমি বিয়ে করবে?
সেই কথা মায়ের কানে চলে এল ছোট বোন চিত্রিতার মাধ্যমে।
মা কায়দা করে জিজ্ঞাসা করলেন মৈত্রেয়ীকে, তুমি কি মির্চাকে ভালবাসো?
মৈত্রেয়ী লাজুক ভঙ্গিতে জানালেন, হ্যাঁ মা।
মির্চাকে ছাড়া আমি জীবনে বাঁচবো না।
সুরেন্দ্রমোহন এই কথা শোনা মাত্রই মির্চাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বললেন।
মির্চা দেশে ফিরে গেলেন।
যাবার আগে অশ্রুসজল চোখে মৈত্রেয়ীর দিকে তাকিয়ে শুধু একবার হাত নাড়লেন মির্চা।
বিদায়, বন্ধু!
দেশে ফিরে মির্চা পড়াশোনা আর গবেষণায় ডুবে গেলেন মৈত্রেয়ীকে ভুলতে।
বিয়ে করলেন। কিন্তু সুখী হলেন না।
শয়নে স্বপনে তখন শুধু একটিই নামই ভাসছে,
মৈত্রেয়ী! মৈত্রেয়ী!
এর কয়েকবছর পরে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে তাঁর ভালবাসা নিয়ে দেশিয় ভাষায় একটি বই লিখলেন।
সেই বইয়ে মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে তাঁর গোপন ভালবাসার কথা সব লিখলেন মির্চা।
আরো লিখলেন মৈত্রেয়ী দেবী রোজ রাতে তার কাছে লাইব্রেরি ঘরে আসতেন।
সেখানে তাঁর সঙ্গে মৈত্রেয়ীর শারীরিক সম্পর্কও হ’ত।
ঐ উপন্যাস তখন বিশাল আলোড়ন ফেলে দিয়েছে।
ইতিমধ্যে মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে এক উদারমনা বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. মনোমোহন সেনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে।
তিনি মুংপুতে সিনকোনা ফ্যাক্টরীতে ম্যানেজার ছিলেন।
এই মুংপুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছেন মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে বেশ কয়েকবার।
মৈত্রেয়ী দেবীর একটি বইও আছে এই নিয়ে ” মুংপুতে রবীন্দ্রনাথ। ”
ইতিমধ্যে সাতের দশকে মৈত্রেয়ী দেবীর কানে এল মির্চার বইটির কথা।
মৈত্রেয়ী দেবী তখন আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভাষণ দিয়ে চলেছেন।
স্বামীর অনুমতি নিয়ে মির্চার সঙ্গে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা করতে এলেন মৈত্রেয়ী দেবী।
পুরনো ভালবাসার কথা দুজনের মনে জেগে উঠল আর একবার।
মৈত্রেয়ী দেবী ক্ষোভে ফেটে পড়ে মির্চাকে বললেন,
কেন তুমি আমাকে জড়িয়ে মিথ্যা করে শারীরিক সম্পর্কের কথা লিখেছো?
মির্চা স্বীকার করলেন, তোমাকে না পাওয়ার দুঃখ থেকে আমি এই কল্পনার আশ্রয় নিয়েছি।
তবে তোমাকে কথা দিলাম তোমার মৃত্যুর পর যদি আমি বেঁচে থাকি তখন এই বই আমি ইংরেজিতে লিখে প্রকাশ করবো।
মৈত্রেয়ী দেবী দেশে ফিরে এলেন।
মির্চার বইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে লিখলেন একটি বই,
“ন হন্যতে।”
সেই বই প্রকাশিত হওয়ার পর মৈত্রেয়ী দেবীর এতদিনের সাজানো সংসার তছনছ হওয়ার উপক্রম হল।
আত্মীয়স্বজনরা সব সম্পর্ক ছিন্ন করল।
লজ্জা, লজ্জা এসব কি লিখেছে মৈত্রেয়ী?
মনে আছে তখন এই বই নিয়ে মিডিয়া ও লোকের মুখে কত সরস আলোচনা।
সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হল এই বই।
পরের বছর মৈত্রেয়ী দেবী পদ্মশ্রীও পেলেন।
মৈত্রেয়ী দেবী তার বাকি জীবনটা সমাজসেবায় উৎসর্গ করে গেলেন।
১৯৯০ সালে মৈত্রেয়ী দেবী মারা গেলেন।
এর চার বছর পর মির্চা এলিয়েদ ইংরেজিতে প্রকাশ করলেন সেই প্রেম কাহিনি ” লা নুই বেঙ্গলী।”
” ন হন্যতে” যার অর্থ হল,
যা হনন করা যায় না।
মৈত্রেয়ী দেবী এই বইয়ের নামকরণের মাধ্যমে সেই চিরন্তন প্রশ্ন কি আর একবার উসকে দিলেন? যে সত্যিকারের ভালবাসা কখনও হনন করা যায় না?
আমার তো তাই মনে হল।
আজ মৈত্রেয়ী দেবীর জন্মদিনে ( ১৯১৪ – ১৯৯০) আমাদের শ্রদ্ধা রইল।
(সৌজন্যে: পীযুষ দত্ত)
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: সেপ্টম্বর ০১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,