লেখক: শিশির মোড়ল ঢাকা
সরকারের পর দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা দেয় বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো। স্বাধীনতার অনেক আগেই এই সমিতি তৈরি হয়েছিল। স্বাধীনতার পর সমিতির কাজের ক্ষেত্র অনেক বেড়েছে, গড়ে উঠেছে বিস্তৃত একটি নেটওয়ার্ক। দেশের ডায়াবেটিস রোগীদের বড় ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে এই সমিতি।
দেশের যেকোনো জেলা শহরে ডায়াবেটিক সমিতির ভবন বা সাইনবোর্ড চেখে পড়ে। মেহেরপুর ও শরীয়তপুরের সমিতি ছাড়া অন্য সব জেলার সমিতি ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অধিভুক্ত। ২০–২২টি উপজেলায় সমিতির আদলে সংগঠন আছে। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। জেলায় বা উপজেলার স্থানীয় মানুষ এই সমিতি গড়ে তুলছেন। অধিভুক্ত সমিতিগুলোকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় না।
বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা এমন সমাজসেবামূলক অলাভজনক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে খুব কমই আছে। সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমিতির অনন্যতা হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি এর মালিক নয়। এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মকর্তা–কর্মচারী, এখানে যাঁরা সেবা নেন, তাঁরা সমিতির মালিক। সমিতিকে জায়গা দিয়েছে সরকার, ভবন তুলে দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান পিডব্লিউডি। দেশে এমন নজির কম আছে।’
সমিতি গড়ে তোলার উদ্দেশ্য ছিল ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সব মানুষকে সেবার আওতায় আনা, কেউ যেন চিকিৎসার বাইরে না থাকে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ডায়াবেটিসের রোগী বাড়ছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (২০১৭–১৮) বলছে, দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ ১ কোটি ১০ লাখ। ১৮–৩৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এই সংখ্যা ২৬ লাখ। আর ৩৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সীদের মধ্যে ৮৪ লাখ।
জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৬০ শতাংশ নারী ও পুরুষ জানেই না যে তাঁরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। মাত্র ১৩ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী তাঁদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানেন। তাঁরা নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে। ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানেন এবং চিকিৎসাও নিচ্ছেন, অথচ ২২ শতাংশের বেশি নারী–পুরুষের তা নিয়ন্ত্রণে নেই। রোগটি শহরাঞ্চলে এবং উচ্চ আয়ের মানুষের মধ্যে বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। এই পরিস্থিতিতে ডায়াবেটিক সমিতির গুরুত্বও বেড়ে গেছে।
সমিতির যাত্রা শুরু
ডায়াবেটিস বড় ধরনের স্বাস্থ্যসমস্যা হয়ে উঠবে—এই ভাবনা থেকে কয়েকজন আগ্রহী মানুষকে নিয়ে ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম ডায়াবেটিক সমিতি তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠালগ্নে এর নাম ছিল ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন ফর পাকিস্তান। পরের বছর ৩১ জুলাই পর্যন্ত সমিতির কার্যালয় ছিল সেগুনবাগিচায় অধ্যাপক ইব্রাহিমের বাড়ির নিচতলায়। পরে একটি টিনের ঘরে ডায়াবেটিসের রোগীর চিকিৎসার আয়োজন করেন তিনি। প্রথম বছর ৩৯ জন রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। শুরু থেকেই সমিতি ডায়াবেটিস নিয়ে গবেষণায় গুরুত্ব দেয়। ১৯৫৯ সালে এই সমিতি আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের সদস্য হয়।
অলাভজনক সেবামূলক সংগঠন হওয়ায় সরকারি দান–অনুদান ও ব্যক্তিবিশেষের সহায়তা সমিতির বিকাশে ভূমিকা রাখে। স্বাধীনতার পর রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় সরকারি জমিতে ডায়াবেটিক সমিতির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন ইন ডায়াবেটিস, এন্ডোক্রাইন অ্যান্ড মেটাবলিক ডিজঅর্ডার (বারডেম) গড়ে ওঠে। ১৯৮২ সালে বারডেম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগী কেন্দ্রের স্বীকৃতি পায়।
এরপর একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। এতে সেবার আওতা বেড়েছে। বহু মানুষ সেবা পাচ্ছে। দেশের ৩০ শতাংশের বেশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি সমিতির অধীনে থাকা হাসপাতালগুলো থেকে চিকিৎসা পান। রোগীর আর্থিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৫, ৫০ বা ২৫ শতাংশ ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে বেশ কিছু সৃজনশীল কাজ করেছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। এর একটি হচ্ছে রোগী নিবন্ধন এবং রোগীকে দেওয়া একটি বই। কবে কী পরীক্ষা হয়েছে, কী চিকিৎসা, কী পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তা লেখা থাকে ওই বইয়ে। ব্যবস্থাপত্রের তুলনায় এই বই হারিয়ে ফেলার ঝুঁকি কম। অন্যদিকে এই বই নিয়ে সমিতির আওতাধীন দেশের যেকোনো ডায়াবেটিক হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া যায়।’
সমিতির প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে স্বতন্ত্র বেশ কটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো ও বড় হচ্ছে বারডেম। হাসপাতালের শয্যা ৭১৬টি। এর মধ্যে কিছু শয্যা দরিদ্র রোগীদের জন্য। প্রতিদিন এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে গড়ে যে তিন হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসে, তার একটি বড় অংশ আসে নিয়মিত চিকিৎসায়। হাসপাতালে নিবন্ধিত রোগী ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫২৬ জন। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ রোগী বিনা মূল্যে সেবা পান।
রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারটি করা হয়েছে দরিদ্র ও যুবক ডায়াবেটিস রোগীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য। সেন্টারের ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ আছে। অন্য প্রতিষ্ঠান ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ইতিমধ্যে হৃদ্রোগ চিকিৎসায় বেশ সুনাম অর্জন করেছে। অন্যদিকে ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের মান বেসরকারি খাতে পরিচালিত মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয়।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পের মধ্যে আছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেস, বারডেম নার্সিং কলেজ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস, হেলথকেয়ার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, ন্যাশনাল হেলথকেয়ার নেটওয়ার্ক। সুবিধাবঞ্চিত ডায়াবেটিক শিশুদের জন্য ‘চেঞ্জিং ডায়াবেটিস ইন চিলড্রেন’ নামের একটি প্রকল্প চালু আছে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে অনেক ধরনের কাজ আছে সমিতির।
ডায়াবেটিস বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে বছরের একটি দিনকে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে করেছিল সমিতি। সেই প্রস্তাব অনুমোদন করে ১৪ নভেম্বরকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে দিবসটি এখন পালিত হয়।
সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান তাঁর বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি: পথ–পরিক্রমা বইয়ে লিখেছেন, ‘এখন সরকারের পর বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতিই স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। বস্তুতপক্ষে, এখন এটি সারা পৃথিবীতেই সেবরকারি পর্যায়ে সবচেয়ে বড় অলাভজনক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থা।’
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ২৫, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,