লেখক: রিফাত মুনীর ইতি।
আচ্ছা, এই যে আমরা ‘স্বাধীনতা’, ‘স্বাধীনতা’ বলে নিয়ত চেঁচাচ্ছি; ‘স্বাধীনতা’ ব্যাপারটা আসলে কেমন? তার আগে আসুন একটু তাকাই দেশের দিকে। দেশ এখন সরগরম পরীমণি ইস্যুতে। চিত্রনায়িকার প্রতিমুহূর্তের আপডেট সরবরাহ করছে মিডিয়া। উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে, পাড়া-মহল্লা, চায়ের আড্ডা থেকে গৃহবধূদের নিত্য সংলাপে এখন একটাই নাম- পরীমণি। দেশের ইউটিউব সার্চ লিস্টে আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এ মুহূর্তের বাংলাদেশ সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করেছে অন্তত পরীমণির সঙ্গে যুক্ত কোনো ভিডিওকে।
কিন্তু পুরো ব্যাপারটা একটু ভালো করে দেখলে এক রকম প্রহসন বলে মনে হয় না? এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক খেলার মতো। ধরুন, চিত্রনায়িকা যখন ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ আনলেন একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে, ঠিক তার কয়েক দিন পর আবার তাকেই ধরা হলো মদের বোতল সমেত। এখন সত্য-মিথ্যা যাচাই করার জন্য কোর্ট আছেন। তা সত্ত্বেও কেমন যেন পরিকল্পিত ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না? ব্যাপারটা ভীষণ সন্দেহ উদ্রেককারী কিন্তু!
এখন যেভাবেই হোক, পরীমণি বিখ্যাত। পাঠক, অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়েও যদি আমি তার ‘বিশ্ব সুন্দরী’ ও ‘স্বপ্টম্নজাল’ ছবি দুটি নিয়ে মন্তব্য করি, তাহলে বলব, তিনি সত্যি সত্যি প্রতিভাবান। ব্যক্তিগতভাবে এটি পরিচালক নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া বলে, বিশেষত গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্টম্নজাল’-এ পরীমণি অভিনয়ে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল এ অভিনেত্রীকে নিয়ে স্বভাবতই দর্শকদের আগ্রহ থাকবে- এটাই স্বাভাবিক।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে পরীমণির পুরো খেলাটা, (দুঃখিত, এটাকে খেলাই বলব) যার নিয়ন্ত্রক পুরুষ, যার খেলোয়াড়রা পুরুষ এবং তার ভাগ্যের বিচারক পুরুষ, সেখানে তথাকথিত ভিকটিমের ভূমিকা কতটুকু? আর যদি থাকেও, তা আদৌ কতটা গ্রহণ করে সমাজ কিংবা আদৌ করে কি? এ প্রশ্ন মুখ্য হয়ে উঠেছে।
একটু ভালোভাবে ভেবেচিন্তে ঘটনাগুলো মিলিয়ে নিন। চিত্রনায়িকা ধরা পড়ার পরপরই শুরু হলো তার যাবতীয় অনৈতিক কাজের ভিডিও প্রদর্শনী, তার রিমান্ড নিয়ে টানাহ্যাঁচড়াসহ জেলে কিংবা গাড়িতে তোলার সময় তার নখ থেকে চুল পর্যন্ত সবকিছুর পর্যবেক্ষক কিন্তু আড়ালে পুরুষ। এর পর তাকে ঘিরে যত রকম আবেগ, রাগ, ঘৃণা, ভালোবাসা, সহানুভূতি, এমনকি ঈর্ষার সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে অনুভূতি প্রকাশক হচ্ছেন পুরুষ। কোনদিন কোন অবস্থায় পরীমণির বাসা, হোটেল কিংবা রেস্তোরাঁয় তার সঙ্গে দেখা হয়েছে- এ খবর প্রকাশ হয়ে পড়ার ভয়ে, এমনকি পুরো নাটকের এক দৃশ্যে কিছুটা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন যারা, তারাও কিন্তু পুরুষ!
এবার সিনেমার শেষ দৃশ্য! খুব পরিকল্পনামাফিক একজন নারীকে ভালোভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে তার প্রতি যে ক্ষোভটা ছিল, তা কিছুটা মিটেছে। কিন্তু তাকে তো আবার যেভাবেই হোক এই সমাজেই লাগবে। নায়িকা বলে কথা, তাতে আবার রূপে আক্ষরিক অর্থেই ‘ডানাকাটা পরী’। ঠিক এ কারণে ‘জাস্টিস ফর পরীমণি’ ব্যানার নিয়ে মানববন্ধন, তার সব মানবিক গুণ উপস্থাপন; তার ন্যায়বিচার যেন হয়, এ জন্য লম্বা লম্বা বক্তৃতা-বিবৃতি!
লেখাটা শুরু করেছিলাম স্বাধীনতা দিয়ে। একজন স্বাধীন দেশের নাগরিক; তার স্বাধীন চলাফেরা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, থাকবেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তার মাপকাঠি কতটা? একজন মানুষ যখন জনপ্রিয়তা পান, যেভাবেই হোক- খেলা, গান, অভিনয়, মডেলিং, নাচ, লেখা বা অন্য যে কোনো উপায়ে, তখন তিনি হয়ে যান ‘তারকা’। মানে ধরাছোঁয়ার বাইরের একজন। কাজেই তার প্রতি আগ্রহ ও প্রত্যাশার চাপ ঊর্ধ্বমুখী হওয়াটাই স্বাভাবিক। এবং তার জীবনের যে কোনো উত্থান-পতনে অন্তত ভক্তদের প্রতিক্রিয়া হবে তীব্র- এটাই স্বতঃসিদ্ধ। এ কারণেই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব মাঠে কোনো অশ্নীল অঙ্গভঙ্গি করলেন কিংবা তামিম কাকে গালি দিলেন, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের সেই ভিডিও নেট দুনিয়াকে তোলপাড় করে দেয়। ভক্তরা পর্যন্ত বিভক্ত হয়ে পড়ে পক্ষে-বিপক্ষে। সুতরাং, সবকিছুর বাইরেও ভক্তদের চাওয়া-পাওয়ার প্রতি তারকাদের কিছুটা দায় তো থেকেই যায়; কেউ তা মানুক আর নাইবা মেনে চলুক। আর আমরা, যারা আরও দূরে বসে এসব খেলা দেখি, মানে সাধারণ দর্শক, তাদের আসলে করার কিছু থাকে না, পুরুষতান্ত্রিক খেলায় ‘পরীমণি’র মতো ‘পাপেট’দের জেগে ওঠার প্রতীক্ষা করা ছাড়া!
শিক্ষক
সূত্র: সমকাল।
তারিখ: আগষ্ট ২৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,