লেখক: ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।
মাত্র ১১ দিনের মাথায় তালেবান যোদ্ধাদের হাতে সমগ্র আফগানিস্তান, এমনকি বিনা বাধায় কাবুল দখল ২০ বছর পূর্ণ শক্তিতে থাকা আমেরিকাকেও হতভম্ব করেছে। পেন্টাগন ও সিআইএ ধারণা করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের পর তালেবানের কাবুল দখল করতে অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে।
বিশ্বকে হতবাক করে ছয় দিনে কাবুল দখল করে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে তালেবান কার্যত মাটিতে নামিয়েছে। যেভাবে ৩০০ বছরে আরও দুই পরাশক্তি ব্রিটিশ-ভারত ঔপনিবেশিক শক্তি ও বিংশ শতাব্দীতে পরম বিক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়নকে নামানো হয়েছিল। এখানে একটি তথ্য লক্ষণীয়। তৃতীয় আফগান যুদ্ধের পর ৪০ বছরের মাথায় ব্রিটেন বিশ্বজুড়ে তার উপনিবেশ হারায়। আর আফগান যুদ্ধের পর মাত্র তিন বছরের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায় এবং বিশ্বব্যাপী তার শক্তি হারায়। সেই হিসাবে এবার যুক্তরাষ্ট্রের পালা।
পেন্টাগন ও আমেরিকান জেনারেলরা আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সেখানকার পশতুন জনগোষ্ঠীর বাইরে অ–পশতুন অঞ্চলের যুদ্ধবাজ নেতা ও তাঁদের অনুগত কথিত হাজার হাজার মিলিশিয়ার ওপর নির্ভর করেছিল। তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন হেরাতের ইসমাইল খান ও তাঁর পরের প্রজন্মের উত্তরসূরিরা, উত্তরে-পশ্চিমে বালখ প্রদেশের প্রচণ্ড তালেবানবিরোধী আবদুর রশিদ দোস্তাম ও আতা মোহাম্মদ নুর। উত্তরে তাজিক-অধ্যুষিত পাঞ্জশির উপত্যকায় প্রয়াত আহমেদ শাহ মাসুদের উত্তরসূরি পুত্র আহমেদ মাসুদকে তারা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। যুক্তরাজ্য তাঁকে রয়্যাল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্টে পাঠিয়েছিল। পরে লন্ডন কিংস কলেজ থেকে ‘ওয়ার স্টাডিজ’-এ স্নাতক ডিগ্রি গ্রহণ করেন।
যুদ্ধবাজ নেতাদের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো কত মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, তার পরিসংখ্যান হয়তো সামনে পাওয়া যাবে। তবে শুধু যুদ্ধ ও কথিত দেশ পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্র ২ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাজ্য ৩৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এই হিসাবের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও যুক্তরাজ্যের এমআই-৬–এর অপ্রদর্শিত খরচ অন্তর্ভুক্ত নয়।
আফগানিস্তানে এমন বিপর্যয়ের পর ন্যাটোসহ যুক্তরাষ্ট্রের ঘোর কাটতে সময় লাগবে। প্রশ্ন উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্র তথা পেন্টাগন কি আফগানিস্তানের ইতিহাস বা সমাজব্যবস্থা সম্বন্ধে ধারণা ও পূর্বজ্ঞান নিয়ে সেখানে অভিযানে নেমেছিল? নাকি শুধু গায়ের জোর দেখাতে গিয়ে তালেবানের রণকৌশলের কাছে পরাজিত হয়েছে? তালেবান যেখানে তাদের দেশের সামাজিক ব্যবস্থা, ইতিহাস, ভূমিবিন্যাস সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ওয়াকিবহাল, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী এসব বিষয়ে প্রায় অন্ধকারে ছিল। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বইয়ের কথা উল্লেখ করতে চাই এবং আফগানিস্তানের যুদ্ধ শুরুর আগে কৌশল তৈরির সঙ্গে যুক্ত পেন্টাগনের কমান্ডাররা সেসব পড়েছিলেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
এই বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে হিস্ট্রি অব আফগানিস্তান। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে গবেষণাধর্মী এ বই লিখেছেন ফরাসি জেনারেল জে পি ফেরিয়ার। লেখা হয়েছিল ১৮৩০ সালে। লেখক বইটিতে আফগানিস্তানের সমাজব্যবস্থা, বিদেশিদের প্রতি তাদের ঘৃণা, যুদ্ধবাজ সংস্কৃতি, অত্যন্ত রক্ষণশীল সমাজ, গর্বিত, বহু উপজাতি ও গোত্রভিত্তিক সমাজ, জাতি এবং তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা লিখে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকে সাবধান করেছিলেন।
আফগানিস্তান নিয়ে আরেকটি বিশ্বখ্যাত বই দ্য পাঠানস ৫৫০ বিসি-এডি ১৯৫৭। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত বইটির লেখক স্যার ওলেফ ক্যারোর। তিনি তাঁর জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কাটিয়েছেন। তিনি ছিলেন ওই প্রদেশেই শেষ ব্রিটিশ গভর্নর। তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পশতুনসহ অন্যদের সামাজিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিয়েছেন। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই ২০১৩ সালে প্রকাশিত ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল রচিত রিটার্ন অব আ কিং: দ্য ব্যাটল ফর আফগানিস্তান। এখানেও আফগানদের রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস এবং উপজাতি গোষ্ঠীর সামাজিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে (১৯ আগস্ট প্রথম আলোতে কামাল আহমেদের লেখায় এ বইয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে)। আরও বহু গবেষণা রয়েছে। এ কয়টি ঐতিহাসিক বইয়ের কথা বললাম এ কারণে যে কথায় বলে, ‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।’
তালেবানের রণকৌশল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলে রাখা ভালো যে আফগানিস্তান ১৭৪৭ সালের আগে কোনো একক রাষ্ট্র ছিল না। শত শত গোত্রে বিভক্ত ছিল। আজও তেমন রয়েছে। পশতুনদের মধ্যে ৬০টি প্রধান উপজাতি এবং ৪০০ গোষ্ঠী রয়েছে। রয়েছে ২৩ শতাংশ তাজিক, ৭ শতাংশ উজবেক ও বাকি অন্যরা। সব উপজাতির মধ্যেই অনুরূপ বিভাজন গোত্রের নেতাদের নেতৃত্ব। আজও কোনো পরিবর্তন হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অতীত থেকে শিক্ষা না নিলেও তালেবান ২০০১ সালে তাদের বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়েছে। বিধ্বস্ত তালেবান ২০০৫ সালে কোয়েটা সুরার মাধ্যমে পুনর্গঠিত হওয়া শুরু করে এক বছরের মাথায় দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু করে এবং ২০১৭ সালের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ আফগান ভূখণ্ডে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। বড় বড় শহর বাদে ৪২১টি জেলার ৬০ শতাংশে তারা নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ আফগানরা গনি সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি এবং দখলদারদের অত্যাচারের কারণে তালেবানকে সমর্থন দিতে থাকে।
ওই সব অঞ্চলে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি বিচারব্যবস্থার পরিবর্তে তালেবান বিনা মূল্যে ত্বরিতগতিতে ছোটখাটো মামলা, এমনকি হত্যা মামলা, ভূমি দখল এবং চুরি-ডাকাতির মতো ঘটনার বিচার করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছিল। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ গ্রামভিত্তিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমনকি পুলিশের মাসোহারার ব্যবস্থাও তারা করেছিল। এককথায় সামাজিক দুরবস্থা এবং সরকারের দুর্নীতি ও অপশাসনের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে তালেবান নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিল।
বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা মনে করেন, তালেবান চীনা সামরিক দার্শনিক শন জুর আর্ট অব ওয়ার সম্বন্ধে তেমন ওয়াকিবহাল না হলেও ‘জুয়ের তত্ত্ব’ কাজে লাগিয়েছে, যার প্রধানতম দিক হচ্ছে সামাজিক অবস্থাকে কাজে লাগানো ও সামরিক শক্তি ব্যবহার শত্রুশিবিরে আতঙ্ক ছড়ানো।
২০২১ সালের তালেবান ২০০১ সালের তালেবান নয়। বেশির ভাগ শীর্ষস্থানীয় পদ এখন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। যদিও ওই সময়কার (১৯৯৬) বেশ কিছু তরুণ সদস্য বর্তমানে পরিপক্ব ও অভিজ্ঞ নেতায় পরিণত হয়েছেন। এখনকার তালেবান আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। শুধু যোগাযোগব্যবস্থাই নয়, ‘জুয়ের তত্ত্বকে’ তারা সঠিকভাবে পালন করেছিল। সমাজের অব্যবস্থার কারণে নিজেদের পক্ষে কাজ করতে ও তথ্য আদান-প্রদানের জন্য জনগণকে ব্যবহার এবং সরকারের গোয়েন্দা ও দোভাষীদের অনেকে অর্থের বিনিময়ে নিজেদের দলভুক্ত করেছে, যাতে প্রতিপক্ষের সব বড় পদক্ষেপ জানতে পারে। সান জুর তত্ত্ব হচ্ছে, ‘শত্রুকে চিনতে হবে, জানতে হবে তার দুর্বলতা।’
পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল সরকার এবং সরকারি বাহিনী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা। তালেবান আইইডিতে দারুণ অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল, যার ব্যবহার সরকার এবং সরকারি বাহিনীকে দারুণ সমস্যায় ফেলেছিল। একইভাবে সামরিক সরবরাহ ও অভিযানের রাস্তায় স্থলমাইন দ্বারা আক্রমণ এবং আত্মঘাতী হামলা সবই ছিল আতঙ্কিত করার পদ্ধতি। এরই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সরকার-সমর্থিত অথবা সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গোপন হত্যা ছিল আতঙ্কের আরেক নাম। তাদের এ কৌশল খুবই কাজে দিয়েছে।
তালেবানের অন্যতম কৌশল ছিল ছোট ছোট দলে অ্যামবুশ এবং বিচ্ছিন্ন চেকপোস্টগুলোকে আক্রমণ ও নিষ্ক্রিয় করা এবং সরকারি বাহিনীর ক্যাম্পগুলোকে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারি বাহিনীর আত্মসমর্পণের চিত্র মুঠোফোনে আপলোড করে আত্মসমর্পণের আহ্বান করা। সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন করার ফলে সরকারি বাহিনীর অনেক ক্যাম্পে খাদ্য ও রসদ সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে। সময়মতো বেতন না পাওয়ায় তারা স্থানীয় জনগণের শরণাপন্ন হয়েছে। এসব কারণে আফগান বাহিনীর মনোবল ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে।
২০১৮ সাল থেকে দোহায় তালেবানের অফিস খোলা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি আলোচনাকে ব্যবহার করা হয়েছে এই বলে যে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার পথ খুঁজছে। এ খবর যে বার্তা দিয়েছে, তা হচ্ছে অবশেষে আফগানিস্তানে আবার তালেবানের শাসন কায়েম হতে যাচ্ছে এবং তালেবানই এখন শক্তিশালী শক্তি। আফগানিস্তানের ঐতিহ্য হচ্ছে সেখানকার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সব সময়েই শক্তিশালী শক্তির পক্ষে যোগ দিতে উন্মুখ থাকে। একই সঙ্গে তালেবান অনেক পুলিশ, এমনকি সেনাবাহিনীর সদস্যদের টাকাপয়সা দিয়ে নিজেদের পক্ষে টেনেছে।
এককথায়, বর্তমান তালেবান তাদের যুদ্ধের কৌশল যেভাবে পরিবর্তন করেছে, তা যেকোনো সমরবিদ ও গবেষকের জন্য জরুরি গবেষণা উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে। আর তালেবানের রণকৌশল সম্বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিল, তা পরিষ্কার। শত্রুকে অবজ্ঞা করা এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়ার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের এ পরাজয়।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ২৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,