বিবিসি অবলম্বনে প্রতিবেদন তৈরি করছেন মোজাহিদুল ইসলাম মণ্ডল
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে চলে যাওয়ার পর থেকে নতুন এক দৃশ্য দেখা যায় সেখানকার বিমানবন্দরে। কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আফগানদের ঢল নামে। রানওয়েতে উড়োজাহাজের পেছনেও ছুটতে দেখা যায় অনেককে। কারণ, তারা দেশ ছাড়তে চায়।
আফগানদের এই দেশ ছাড়ার ঘটনা নতুন নয়। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হামলা শুরুর পর থেকে শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিচ্ছে আফগানরা। তবে বর্তমানে এই প্রবণতা বেড়েছে। সব মিলিয়ে ২২ লাখ আফগান প্রতিবেশী দেশগুলোয় আশ্রয় নিয়েছে। তালেবানের সঙ্গে দেশটির সরকারি বাহিনী এবং বিদেশি বাহিনীগুলোর সংঘর্ষে ৩৫ লাখ আফগান গৃহহীন হয়ে পড়েছে। তবে কাবুল তালেবানের দখলে চলে যাওয়ার পর ঠিক এ পর্যন্ত কতজন আফগানিস্তান ছেড়েছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
এদিকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে আফগানিস্তানের সব সীমান্ত ক্রসিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান। সশস্ত্র এই গোষ্ঠী বলছে, তারা চায় না কোনো আফগান দেশ ছেড়ে চলে যাক। খবরে বলা হচ্ছে, যেসব আফগান ব্যবসা করেন এবং যাঁদের বৈধ কাগজপত্র রয়েছে, তাঁরা শুধু সীমান্ত পাড়ি দিতে পারছেন। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) বলছে, অধিকাংশ আফগান সীমান্ত পাড়ি দিতে পারছে না।
যারা আফগানিস্তান ছাড়ছে, তাদের একটি বড় অংশ যাচ্ছে পাকিস্তানে। তবে সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে চলে যাওয়ার পর পাকিস্তান যেতে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে অনেক আফগান। এ ছাড়া প্রায় দেড় হাজার মানুষ উজবেকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছে। সেখানে সীমান্তবর্তী এলাকায় তাঁবু টাঙিয়ে থাকছে তারা।
অনেকেই কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে আফগানিস্তান ছেড়েছে। তবে তাদের মধ্যে কতজন আফগান, সেটা নিশ্চিত নয়।
দেশ ছাড়ার পাশাপাশি অনেক আফগান বাড়ি ছাড়তেও বাধ্য হচ্ছে। ইউএনএইচসিআরের দেওয়া তথ্য অনুসারে, চলতি বছর আফগানিস্তানে সংঘর্ষে সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এর ফলে খাদ্যসংকটও দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির গত জুনে দেওয়া তথ্য অনুসারে, দেশটির ১ কোটি ৪০ লাখ ক্ষুধা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ।
আফগানিস্তানের শরণার্থীরা গত বছর যে দেশগুলোয় বেশি গেছে তার মধ্যে অন্যতম পাকিস্তান ও ইরান। ইউএনএইচসিআর বলছে, ২০২০ সালে শুধু পাকিস্তানে গেছে ১৫ লাখ আফগান। আর ইরানে গেছে ৭ লাখ ৮০ হাজার। এর পরের অবস্থানে রয়েছে জার্মানি। দেশটিতে গেছে ১ লাখ ৮০ হাজার আফগান। আর তুরস্ক নিয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার। এই আফগানদের মধ্যে শরণার্থী রয়েছে, আবার রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীও রয়েছে।
তবে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার সংখ্যা হিসাব করলে এই চিত্রটা একটু বদলে যাবে। হিসাব অনুসারে, যেসব দেশে আফগানরা রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে, সেই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে তুরস্ক, জার্মানি ও গ্রিস। তুরস্কে আশ্রয় চেয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার আফগান। আর জার্মানি ও তুরস্কে আশ্রয় চেয়েছে যথাক্রমে ৩৩ হাজার ও ২০ হাজার আফগান। ইরানে কেউ রাজনৈতিক আশ্রয় চায়নি। দেশটিতে যেসব আফগান শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পেয়েছে, তারা কেউ দেশটিতে স্বাস্থ্যসেবা কিংবা শিক্ষার সুযোগ পাবে না।
আফগানদের সাহায্যে বেশ কিছু দেশ এগিয়ে এসেছে। আবার অনেক দেশ বলছে তারা আফগানদের সাহায্য করবে না। এ নিয়ে কোন দেশের অবস্থান কেমন, তা দেখে নেওয়া যাক একনজরে।
কাবুল বিমানবন্দর থেকে মানুষ সরিয়ে নিতে ব্যবহার করা হবে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ
ইরান
আফগানদের সাহায্যে যারা এগিয়ে এসেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম ইরান। আফগানিস্তানের সঙ্গে লাগোয়া সীমান্তের তিনটি প্রদেশে শিবির স্থাপন করেছে ইরান। সেখানে তাঁবু স্থাপন করে আফগানদের থাকতে দেওয়া হচ্ছে। তবে ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবশ্য অন্য কথা বলছেন। তাঁরা বলেছেন, আফগানিস্তানের পরিস্থিতির উন্নতি হলে তাঁদের ফেরত পাঠানো হবে। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ইরানে রয়েছে প্রায় ৩৫ লাখ আফগান শরণার্থী।
পাকিস্তান
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত জুনে বলেছিলেন, তালেবান যদি আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তবে তিনি সীমান্ত বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু এটা আসলে সম্ভব হয়নি। কারণ, ইতিমধ্যে হাজারো আফগান দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছে। এ ছাড়া একটি সীমান্ত ক্রসিং খোলা রাখা হয়েছে। আর তালেবান বলছে, তারা সীমান্ত ক্রসিংয়ে কড়াকড়ি আরোপ করবে।
তাজিকিস্তান
তাজিকিস্তানে কতজন আফগান গেছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। ধারণা করা হচ্ছে, শত শত আফগান দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছে। তাদের মধ্যে আফগান সেনাবাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন। গত জুলাইয়ে তাজিকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তারা প্রায় এক লাখ আফগান শরণার্থী নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
উজবেকিস্তান
প্রায় দেড় হাজার আফগান দেশটিতে অবস্থান নিয়েছে। উজবেকিস্তান সীমান্তে শিবির স্থাপন করা হয়েছে। তবে এই সীমান্তে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছে তালেবান। তারা বলছে, যারা বৈধ কাগজপত্র নিয়ে সীমান্তে যাচ্ছে, তাদেরই শুধু যেতে দেওয়া হচ্ছে উজবেকিস্তানে।
যুক্তরাজ্য
প্রায় ২০ হাজার আফগানকে আশ্রয় দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যুক্তরাজ্য। প্রথম বছরে পাঁচ হাজার আফগানকে পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকারের। তবে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ও শিশুদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া যারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তাদেরও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে।
যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি তহবিল ছাড় দিয়েছেন। জরুরি অভিবাসন এবং শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য এই অর্থ ব্যয় করা হবে। এ ছাড়া আফগান সরকার ও তালেবানের সংঘর্ষে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, আফগানিস্তান সংকটের কারণে যারা ঝুঁকিতে এবং যারা বিশেষ ভিসা আবেদন করেছেন তাদের জন্য এই অর্থ ব্যয় হবে। তবে ঠিক কতসংখ্যক আফগান শরণার্থীকে যুক্তরাষ্ট্র আশ্রয় দেবে, এটা এখনো স্পষ্ট নয়।
কানাডা
শরণার্থী নেবে কানাডাও। দেশটির সরকার বলছে, তারা ২০ হাজার আফগানকে পুনর্বাসিত করবে। তালেবানের ক্ষমতা দখলের কারণে যারা ঝুঁকিতে রয়েছে, তারা এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে। এ ছাড়া আফগান সরকারের কর্মী ও নারীনেত্রীরা কানাডায় পুনর্বাসনে প্রাধান্য পাবেন।
ফ্রান্স
শরণার্থী নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানে ফ্রান্স। দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে অবৈধ অভিবাসীর যে ঢল আসছে, তা থেকে নিজ দেশকে রক্ষ করবেন তিনি। মাখোঁ বলেন, আফগানিস্তানে যারা সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তাদের রক্ষায় কাজ করবে ফ্রান্স। তিনি বলেন, বর্তমান যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার ফল একা ভোগ করবে না ইউরোপ।
এ ছাড়া জার্মানি বলেছে, তারাও কিছু শরণার্থী আশ্রয় দেবে। তবে ঠিক কতজনকে নেবে, সেটা নিশ্চিত নয়। কারণ, ২০১৫ সালে শরণার্থী আশ্রয় দিতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিল চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকার। অস্ট্রেলিয়া বলেছে, তারা আফগানিস্তান থেকে আসা তিন হাজার মানুষকে নেবে। মানবিক ভিসা কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই তিন হাজার আফগানকে নেবে তারা।
আফগান শরণার্থী নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। এই ইউনিয়নভুক্ত বেশ কয়েকটি দেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁরা ২০১৫ সালের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি করতে চান না। ওই বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ শরণার্থী নিয়েছিল। তবে এ নিয়ে কর্মসূচির জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছিল দেশগুলো।
এ ছাড়া অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড ও নর্থ মেসিডোনিয়া, আলবেনিয়া, কসোভো, তুরস্ক শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে খুব বেশি আগ্রহী নয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, তিনি নতুন শরণার্থী ঢুকতে দেবেন না। আর আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আনতে পাকিস্তানের সঙ্গে কাজ করবে তাঁর সরকার। এর বিপরীতে উগান্ডা দুই হাজার আফগান শরণার্থী নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
বিবিসি অবলম্বনে প্রতিবেদন তৈরি করছেন মোজাহিদুল ইসলাম মণ্ডল
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ২৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,