নিখুঁত পরিকল্পনা, সাহসী নেতৃত্ব আর প্রতিপক্ষ শিবিরে ক্রমাগত ভাঙন। এই তিন ‘অস্ত্রে’ ভর করেই মাত্র তিন মাসের মধ্যে রাজধানী কাবুল-সহ প্রায় গোটা দেশ দখল করে নিয়েছে তালিবান বাহিনী। সোমবারের মানচিত্র বলছে, উত্তর এবং মধ্যাঞ্চলের কিছু দুর্গম এলাকায় স্থানীয় মিলিশিয়া এবং সরকার অনুগত বাহিনীর অস্তিত্ব থাকলেও মোটের উপর গোটা আফগানিস্তানই তালিবানের দখলে।
৬ লক্ষ ৫২ হাজার ৮৬৪ বর্গ কিলোমিটারের আফগানিস্তান আয়তনের নিরিখে বিশ্বে ৪০ তম। সামরিক ইতিহাস বলছে, কোনও অসরকারি বাহিনীর পক্ষে এত কম সময়ে এমন সাফল্য নজিরবিহীন। প্রসঙ্গত, ১৯৮৯ সালে আমুদরিয়া পেরিয়ে সোভিয়েত ফৌজ ফিরে যাওয়ার পরেও প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাজিবুল্লার সরকারের পতন ঘটাতে প্রায় তিন বিছর সময় লেগে গিয়েছিল আমেরিকার মদতে পুষ্ট মুজাহিদ বাহিনীর। এমনকী, এর আগে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত লাগাতার লড়াই চালিয়েও আফগানিস্তানের এত বেশি এলাকার দখল নিতে পারেননি পাক সহায়তাপ্রাপ্ত তালিবান যোদ্ধারা।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, গ্রামের ভিত্তি মজবুত করে শহরের দিকে ‘হাত’ কৌশল এ বার তালিব-বাহিনীর জয়ের অন্যতম কারণ। চল্লিশের দশকে চিনের গৃহযুদ্ধের সময় কতকটা এমন কৌশলেই বাজিমাত করেছিলেন, চেয়ারম্যান মাওয়ের বাহিনী।
চলতি বছরের মে মাসের গোড়া থেকে আমেরিকার সেনা আফগানিস্তান ছাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু প্রথমেই বড় শহর বা প্রাদেশিক রাজধানীগুলি দখলের পথে হাঁটেনি হিবাতুল্লা আখুন্দজাদার বাহিনী। বরং আফগান সেনার সঙ্গে সঙ্ঘাত এড়িয়ে ধীরে ধীরে পাকিস্তান ও ইরান সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলিতে আধিপত্য বাড়াতে শুরু করে তারা। সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আশরফ গনির সরকারের দুর্বলতার সুযোগ প্রত্যন্ত এলাকাগুলির উপজাতি সর্দারদের দলে টানার কাজও শুরু করে। এমনকি, ‘যোগাযোগ’ তৈরি করে আফগান সেনার অফিসারদের একাংশের সঙ্গেও।
জুলাইয়ের মধ্যপর্ব থেকে শুরু হওয়া এক মাসের পুরদস্তুর যুদ্ধে তালিবানের এই ‘রণনীতির’ সুফল দেখা গিয়েছে বারে বারেই। একের পর এক শহর ও সেনাঘাঁটি বিনাযুদ্ধে দখল করেছে তারা। সংখ্যা এবং সমরাস্ত্রের নিরিখে আফগান সেনা এগিয়ে থাকলেও যুদ্ধে তার কোনও প্রতিফলন দেখা যায়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে আফগান সেনার পাশতুন (তালিবান যোদ্ধারাও মূলত এই জনগোষ্ঠীর) জওয়ানেরা সরাসরি হাত মিলিয়েছে তালিবানের সঙ্গে।
সাতটি কোরে বিভিক্ত আফগান সেনার তিনটি কোর (কন্দহর, গরদেজ এবং কাবুল) বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেছে। যৎসামান্য বাধা এসেছে, অন্য তিনটি কোরের (মাজার-ই-শরিফ, লস্করগাহ এবং কুন্দুজ) তরফে। হেরাট কোরের জওয়ানেরা প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও তালিবান বাহিনীর উপর্যুপরি হামলার মুখে এঁটে ওঠেনি।
তালিবানের সামরিক সাফল্যের পিছনে মহম্মদ ইয়াকুবের ‘ভূমিকা’র কথা উঠে আসছে বারে বারেই। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মহম্মদ ওমরের ছেলে তাঁর বাবার মতোই প্রচার বিমুখ। কিন্তু নিজের বাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করা আর প্রতিপক্ষকে মানসিক চাপে ফেলতে তার কৌশলের জুড়ি নেই বলে আফগান সংবাদমাধ্যমের দাবি। পাশাপাশি, সিরাজুদ্দিন হক্কানির ‘নেটওয়ার্ক’ ধারাবাহিক ভাবে পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া এবং বালুচিস্তান সীমান্ত থেকে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ জারি রাখার ব্যবস্থা করায় শেষ বেলার যুদ্ধে দ্রুত গতিতে তিন দিক থেকে কাবুল ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয় তালিবরা।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা।
তারিখ: আগষ্ট ১৬,২০২১
রেটিং করুনঃ ,