বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা কী ছিল, তা নিয়ে কোনো ঐতিহাসিক দলিল-প্রমাণ এখনও মেলেনি। যদিও এ দুটি দেশ এ ঘটনাপ্রবাহে কোন অবস্থান নিয়েছিল, তা জানতে রাজনীতি ও ইতিহাসের যে কোনো অনুসন্ধিৎসুরই আগ্রহী হওয়ার কথা। কারণ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছিল।
বিশেষত ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে, শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে, আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখে এবং শেষ পর্যায়ে মিত্রবাহিনীভুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখে। বিশ্ব তখন দুই পরাশক্তিতে বিভক্ত ছিল। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন- যার সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশ ছিল বর্তমান রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ভারত বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ সমর্থন দেওয়ায় রাশিয়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এবং গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ভূমিকা অনেকটাই স্পষ্ট। সিআইএর অবমুক্ত করা গোপন নথি এবং মার্কিন ও ব্রিটিশ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সময়ের লেখা থেকে এ হত্যাকাণ্ডে দেশটির পরোক্ষ ভূমিকার কথা উঠে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের তৎকালীন দুই ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত ও রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা কী ছিল, তা আজও স্পষ্ট নয়।
সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কমিটেট গোসুদরস্তভেনয় বেজোপাসনোস্তি বা কেজিবির ভূমিকার ব্যাপারে সাবেক একজন পেশাদার কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, ওই সময় ঢাকায় কেজিবি অত সক্রিয় ছিল না। রাশিয়ার ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের পর মূলত এই সদ্য স্বাধীন দেশ গঠনে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেওয়ার বিষয়টিতেই সীমিত ছিল। বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশেরই কয়েকজন সামরিক অফিসারের হাতে নিহত হতে পারেন, এমন ধারণাও সম্ভবত তখনকার সোভিয়েতের নীতিনির্ধারকরা করতে পারেননি।
এই কূটনীতিক বলেন, তবে এমন তথ্য নানাভাবে জানা যায় যে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (আরএডব্লিউ) পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছিল। যদিও এই সতর্কবার্তার বাইরে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার আর কোনো পদক্ষেপের কথা জানা যায় না। তিনি বলেন, ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। পাকিস্তানের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সম্ভবত এই দিনটিই তাদের তথাকথিত অভ্যুত্থানের জন্য বেছে নিয়েছিল। কারণ তারা জানতেন, এই দিন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাসহ তাদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থা ও নীতিনির্ধারকরা স্বাধীনতা দিবস নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাপ্রবাহের অন্যতম অনুসন্ধানকারী সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান। ২০১৮ সালে তার লেখা প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলেছেন, কেজিবির ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে সে সময় তাদের ২০ জন এজেন্ট সক্রিয় ছিলেন। তাদের দু’জন আবার সরাসরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায় ছিলেন। কেজিবি ১৯৭৫ সালে বলেছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সিআইএ সরাসরি জড়িত নয়। মিজানুর রহমান খান তার এ নিবন্ধে জানান, কেমব্রিজের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার অ্যান্ড্রু ও মিত্রোখিনের যৌথভাবে লেখা একটি বইয়ে বলা হয়েছে, ‘মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরই কেজিবি সিআইএর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমে পড়ে। এতে শুধু বাংলাদেশের নয়, বিদেশের গণমাধ্যমকেও তারা ব্যবহার করে।’
ভারতের সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত একটি নিবন্ধে তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর শোনার পর তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিক্রিয়া। তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী ও তার স্ত্রী মেনকা গান্ধীর সঙ্গে তার কথা হয় ১৯৭৭ সালে। তারা সুখরঞ্জন দাশগুপ্তকে জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর যখন আসে, ইন্দিরা গান্ধী তখনও রাতের পোশাকে। খবর শোনার পর তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে লনে এসে অস্থিরভাবে ছোটাছুটি করছিলেন আর কাঁদছিলেন। সঞ্জয় গান্ধী ও মেনকা গান্ধীকে দেখে তাদের জড়িয়ে ধরে তিনি বলেন, এখনই ধাওয়ানকে (ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব কে আর ধাওয়ান) ডাকো, মন্ত্রীদের ডাকো, মুজিব ভাই নাই। তাকে আমরা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু তিনি আমাদের সরিয়ে দিয়ে শুধু বলছিলেন, মুজিব ভাই নেই, মুজিব ভাই নেই। তিনি বলছিলেন, মুজিব ভাইকে বারবার সতর্ক করেছিলাম, উনি আমার কথা শোনেননি। তাকে (ইন্দিরা গান্ধী) আমরা থামাতে পারছিলাম না।
কিছুক্ষণ পর ধাওয়ান এসে পৌঁছান। আসেন বিদেশ সচিব জগৎ মেহতা ও সামরিক বাহিনীর প্রধান শ্যাম মানেকশ। ইন্দিরা গান্ধী তাদের বলেন, ‘আপনারা কী করেছেন? আপনারা তো জানতেন, এ ধরনের একটা খবর আমাদের কাছে ছিল।’ এরপর ‘র’-এর প্রধান রামনাথ কাউ এলে ইন্দিরা গান্ধী তাকে ধমক দিয়ে বলেন, তোমরা কী করেছো? কাউ উত্তরে জানান, ‘আমরা গতকালও বঙ্গবন্ধুকে বার্তা দিয়েছিলাম। তাকে ওই বাড়ি ছাড়তে বলেছিলাম, তিনি আমাদের কথা শোনেননি।’ ইন্দিরা গান্ধীকে দেখে তখন মনে হচ্ছিল, যেন তার সহোদর ভাইকে হত্যা করা হয়েছে।
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত সঞ্জয় গান্ধীকে উদ্ধৃত করে আরও লিখেছেন, ‘আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছি প্রবীণ মন্ত্রীরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তখন বিদেশমন্ত্রী ছিলেন ওয়াই বি চ্যাবন। তিনি ইন্দিরাকে বললেন, ‘কয়েক মাস আগে ঢাকায় গিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে এসেছিলাম। কিন্তু তিনি এতই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে আমাকে বলেছিলেন, জনগণ আমাকে জাতির পিতা হিসেবে মানে এবং শ্রদ্ধা করে, আমাকে কেউ মারবে না, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। তাকে মারার জন্য জিয়া-খন্দকার জুটি আমেরিকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে সব রকম নীলনকশা তৈরি করেছিলেন। এ কথাও আপনাকে ও বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়েছিল।’
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা আর কে যাদব তার ‘মিশন আরঅ্যান্ডডব্লিউ’তে লিখেছেন, ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি নিজে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্রের খবর দেন। কিন্তু শেখ মুজিব তা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওরা আমার সন্তান। আমার কোনো ক্ষতি ওরা করবে না।’
এই গ্রন্থে যাদব আরও লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকেই তিনি এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ঢাকায় পাঠান। ওই কর্মকর্তা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে তাকে জানান, ‘সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ অংশের দুটি ইউনিটে তার বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এসব সতর্কবার্তায় তিনি (বঙ্গবন্ধু) কান দেননি।’
সূত্র: সমকাল।
তারিখ: আগষ্ট ১৫,২০২১
রেটিং করুনঃ ,