লেখক: মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক
বিশ্ববিদ্যালয় পাঠের প্রথম দিকে পড়েছিলাম মোরশেদ শফিউল হাসানের বই ‘অবাক নাম ভিয়েতনাম’। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি নিউইয়র্কের ব্রডওয়েতে দেখেছিলাম থিয়েটার ‘লে সায়গন’। পেশাগত কাজেও অনেকবার ভিয়েতনাম যেতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে, বিশেষ করে রপ্তানিবাণিজ্যে ভিয়েতনামের নাম বেশ প্রশংসিত। আমাকে দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংওয়ানের কর্ণধার কিহাক সুং বলেছিলেন, সেখানকার এক মেয়রের সঙ্গে যখন তাঁর কারখানার যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন, কীভাবে সেই মেয়র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেই অঞ্চলের রাস্তাটিকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে দিয়েছেন। অনেকে বলেন, রাজনৈতিক কারণ তথা নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা, দক্ষ জনবলের সহজলভ্যতা, রপ্তানিপণ্যের বৈচিত্র্য, চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রিয় দেশ (মোস্ট ফেবারড নেশন) হিসেবেও ভিয়েতনাম বেশ সুযোগ কাজে লাগাতে পেরেছে।
পত্রিকান্তরে আমরা জেনেছি, দীর্ঘদিনের বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানের তৈরি পোশাক রপ্তানির দেশের গর্বের মুকুট হারিয়ে বসেছে আমাদের তৈরি পোশাক খাত। চীনের পরে দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানটি বাংলাদেশের কাছ থেকে সম্প্রতি ছিনিয়ে নিয়েছে ভিয়েতনাম। অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার দৌড়ে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছিল বাংলাদেশ। করোনাকালে সেটি দ্রুত ত্বরান্বিত হয়েছে। গত বছরই দ্বিতীয় স্থানটি নিজের করে নেয় ভিয়েতনাম।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) পরিসংখ্যান বলছে, ভিয়েতনাম গত দুই দশকে বাংলাদেশের সঙ্গে ধীরে ধীরে ব্যবধান গড়ে নিয়েছে। ২০০০ সালে বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানিতে দেশটির হিস্যা ছিল দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। সে সময় বাংলাদেশের হাতে ছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ বাজার। পরের এক দশকে ভিয়েতনামের বাজার হিস্যা তিন গুণ বাড়লেও বাংলাদেশের মাত্র দেড় গুণের একটু বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক তৈরি পোশাকের বাজারে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হিস্যা ভিয়েতনামের দখলে। বাংলাদেশের হাতে রয়েছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। গত বছর ভিয়েতনাম ২ হাজার ৯০০ কোটি, আর বাংলাদেশ ২ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। গত ১০ বছরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম গড়ে ১১ শতাংশ ও বাংলাদেশ ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে।
বছর বছর সরকারের প্রণোদনা ও বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) অন্য অনেক বাজারে শুল্কমুক্ত বাজার-সুবিধা পাওয়ার পরও বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার অনেক কারণের বড়টি হচ্ছে, দশকের পর দশক ধরে বেসিক বা সস্তা পোশাকই রপ্তানি করে আসছেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক উদ্যোক্তারা। মোট পোশাক রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই টি-শার্ট, ট্রাউজার, শার্ট, সোয়েটার ও জ্যাকেট—এই পাঁচ পণ্য থেকে আসছে।
তা ছাড়া বিশ্বজুড়ে বর্তমানে কৃত্রিম তন্তুর পোশাকের চাহিদা থাকলেও এই জায়গায় পিছিয়ে বাংলাদেশ। বিশ্বে বিক্রি হওয়া ৭৮ শতাংশ পোশাকই কৃত্রিম তন্তুর। আর বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৭৪ শতাংশ তুলার। এই জায়গায় অনেক এগিয়ে রয়েছে ভিয়েতনাম। যেটি আগেই বলেছি, তারা বাংলাদেশের মতো পাঁচ পণ্যে আটকে না থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ পোশাক প্রস্তুত করছে। সেসব পণ্যের মধ্যে আবার কৃত্রিম তন্তুর পোশাকই বেশি।
পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারাই বলছেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের অনেকেই চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরিয়ে নিচ্ছেন। সরে আসা এসব ক্রয়াদেশের কিছু অংশ বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমারসহ অন্যান্য দেশ পেয়েছে। তবে বড় অংশ গেছে ভিয়েতনামে। কারণ, চীন থেকে যেসব ভ্যালু অ্যাডেড বা বেশি দামের বৈচিত্র্যপূর্ণ পোশাকের ক্রয়াদেশ সরেছে, তা করার সক্ষমতা কেবল ভিয়েতনামেরই রয়েছে। গত বছর করোনাকালে ভিয়েতনামের রপ্তানি মাত্র ৭ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশের কমেছে ১৫ শতাংশের মতো। গুজব আছে, চীনের উদ্যোক্তারাই ‘সাবমেরিন ট্রেডের’ (চীনে তৈরি করা শার্টের শুধু কলারটি ভিয়েতনামে তৈরি করে মেড ইন ভিয়েতনাম বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে) আড়ালে চীনের তৈরি পণ্যও ভিয়েতনাম থেকে রপ্তানি করছে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের নেতৃত্ব বরাবরই এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে আসছে। যদিও কয়েক বছর ধরে বস্ত্র খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আনার কথা বলছে তারা, তবে সেটিও দ্রুতলয়ে এগোচ্ছে না। ফলে কম দামি পোশাকের বাইরে বড় আকারে নতুন পণ্য উৎপাদনে যেতে পারছে না বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভিয়েতনাম বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। তাদের পোশাক ও বস্ত্র খাতের অধিকাংশ বিনিয়োগই বিদেশি।
ভিয়েতনামের ম্যাগাজিন ভিয়েতনাম ব্রিফিংয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের প্রথম ১১ মাসে সেই দেশে ১৮৪টি পোশাক ও বস্ত্র কারখানায় ১৫৫ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আসে। এর তিন ভাগের এক ভাগ বিনিয়োগ হংকং থেকে এসেছে। সরাসরি চীন থেকে এসেছে ২৭ কোটি ডলারের বিনিয়োগ। ওই বছর দেশটির মোট পোশাক ও বস্ত্র খাতের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই আয় করছে বিদেশি কোম্পানিগুলো। সব মিলিয়ে তাদের পোশাক ও বস্ত্র কারখানার সংখ্যা ৬ হাজারের বেশি।
করোনার কারণে গত বছর বাংলাদেশের পোশাক কারখানাভেদে তিন থেকে চার সপ্তাহ বন্ধ ছিল। সে কারণে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন সমস্যায় পড়েননি ভিয়েতনামের উদ্যোক্তারা। তবে চলতি বছর আবার ঘুরে দাঁড়ানোর আশা করছেন আমাদের পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। এদিকে করোনা চলে যাওয়ার পরও প্রায় জ্ঞাত এক নতুন বিপদ অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে বাংলাদেশ। তখন একে একে শুল্কমুক্ত সুবিধা উঠে যেতে থাকবে। অন্যদিকে গত বছর ভিয়েতনাম ইইউর সঙ্গে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সম্পন্ন করেছে। ফলে ইইউর বড় বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকে, যদি না আমরা জিএসপি প্লাস সুবিধা পাই।
পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও পর্যালোচকদের অনেকেই মনে করেন, ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে, সেটিই স্বাভাবিক। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা না থাকাই এর জন্য দায়ী। আবারও দ্বিতীয় স্থানে ফিরতে হলে বেশি দামের পোশাক উৎপাদনে যেতে হবে, যা ইতিমধ্যে কিছু উদ্যোক্তা শুরুও করছেন। তবে দ্রুত এগোতে হলে সংযোগশিল্প, বিশেষ করে কৃত্রিম তন্তুর কাপড় উৎপাদনে বিপুল বিনিয়োগ লাগবে। এ জন্য চীনসহ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। এমনকি বাংলাদেশ থেকেও ভিয়েতনামের পোশাকশিল্পে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ করা যায় কি না, তার কথাও বিশ্লেষকেরা বেশ কিছুদিন ধরে বলাবলি করছেন। আমরা অবশ্যই আমাদের হারানো স্থান ফিরে পেতে চাই, তবে এর জন্য সরকার, উদ্যোক্তা, আন্তর্জাতিক বন্ধুমহলকে সঙ্গে নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে।
লেখক: মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: আগষ্ট ০৮, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,