২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২ টা ১ মিনিটে কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছড়ায় বাংলাদেশ–ভারতের ১৬২টি ছিটমহল বিলুপ্তির মুহূর্তে স্থানীয় বাসিন্দারা মোমবাতি প্রজ্জ্বালন করে উল্লাস প্রকাশ করেন।
সম্প্রতি পঞ্চগড়ের সদর উপজেলার গারাতি এবং কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার দাশিয়ারছড়ায় গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা বিলুপ্ত হওয়া বড় ছিটমহলগুলোর মধ্যে এ দুটি অন্যতম। বিলুপ্ত হওয়ার পূর্বে ছিটমহলগুলোয় গিয়েছিলাম অসংখ্যবার। বিলুপ্ত হওয়ার আগে আর পরের দৃশ্য একেবারেই আলাদা। ৬৮ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় সুবিধাবঞ্চিত ছিটমহলগুলোয় বইছে শান্তির হাওয়া। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন ‘ছিটমহলের মানুষ শেখ হাসিনাকে মা ডাকে। সন্তানের প্রতি মা যেমন দায়িত্ব পালন করেন, শেখ হাসিনা আমাদের জন্য সেই কাজই করছেন। শেখ হাসিনার প্রতি ছিটমহলবাসীর ভালোবাসার কোনো শেষ নেই। আমাদের প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি বিলুপ্ত ছিটমহলেও এসেছিলেন।’
ভারতীয় অংশে থাকা বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোয় ব্যাপক হারে উন্নয়ন কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। কিন্তু মাত্র ছয় বছরে বাংলাদেশ সরকার এ দেশের অংশ হওয়া ছিটমহলগুলোর চেহারা পাল্টে দিয়েছে। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি কার্যকর হয়। এর অল্প দিনের মধ্যেই সেগুলোয় বিনা খরচে সরকার বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ-সংযোগ স্থাপন করেছে। যেসব সড়কে দীর্ঘ ৬৮ বছরে রাষ্ট্রীয়ভাবে সামান্য মাটিও পড়েনি, সেসব সড়ক এখন পিচঢালা। শুধু পঞ্চগড়েই প্রায় ১০০ কিলোমিটার সড়ক পাকা হয়েছে। কুড়িগ্রামের ছিটমহলগুলোয়ও প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়ক পাকা হয়েছে। ছিটমহলগুলোর সড়ক প্রায় সবই পাকা হচ্ছে। অনেক ব্রিজ, কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে।
ছিটমহলে অনেক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পঞ্চগড়ের গারাতিতে ছিটমহল বিলুপ্ত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠা করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলিম মাদ্রাসা এবং কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছড়ায় একটি মাদ্রাসাকে সরকারি ঘোষণা করা হয়েছে। পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে দুটি ছিটমহলে দুটি স্কুলকে জাতীয়করণ করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী এবং পঞ্চগড়ের ছিটমহলগুলোয় এখন আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এমনকি স্নাতক পর্যায়ের কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রযুক্তিতে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কুড়িগ্রাম এবং পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহলে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের জন্য দুটি আইসিটি ভবন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
অনেক মসজিদ স্থাপন করা হয়েছে। বহুতল ভবনের ভিত্তি দিয়ে একতলা পর্যন্ত এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। অভিন্ন স্থাপত্য কাঠামোতে এগুলো নির্মাণ করা। এ রকম মসজিদের সংখ্যা অনেক। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য মন্দির নির্মাণ করা হচ্ছে। অনেক স্থানে বিষ্ণুমন্দিরও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অনেক কবরস্থান এবং শ্মশানও স্থাপন করেছে সরকার।
ছিটমহলবাসীর মধ্যে অনেক বড় সমস্যা ছিল, তাদের ভূমি ব্যবস্থাপনা। ছিটমহল বিনিময়ের সময় বাংলাদেশের ৭ হাজার ১ শত ১০ দশমিক ২০ একর জমি ভারতের হয়ে যায়। অন্যদিকে ভারতের ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর জমি বাংলাদেশ লাভ করে। পূর্বে যাঁরা মালিক ছিলেন, তাঁদের নামে এসব জমি রেকর্ড করার জন্য সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জরিপকাজ সম্পন্ন করেছে। সব ছিটমহলে সম্ভব না হলেও পঞ্চগড়ে সরকারিভাবে জমি কেনাবেচার কাজ চলছে। অন্যান্য ছিটমহলেও এ কার্যক্রম দ্রুতই শুরু হবে বলে আশা করা যায়।
ছিটমহলবাসীদের মধ্যে কেউ কেউ গোপনে নিজেদের ঠিকানা গোপন করে কিছুটা লেখাপড়া করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই সরকারি চাকরি পাচ্ছেন। ছিটমহলে থাকাকালীন সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার মতো কোনো উপায় যাঁদের ছিল না, সেই ছিটমহলের অনেকেই বিজিবির সদস্য হয়ে এখন সীমান্তরক্ষী হিসেবে যোগদান করেছেন। বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী বিজিবিসহ বেশ কিছু চাকরির নিয়োগে অগ্রাধিকার লাভ করছে।
অনেক ছিটমহলে পোস্ট অফিস স্থাপন করা হয়েছে। সরকারিভাবে কমিউনিটি সেন্টারও নির্মাণ করা হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রেও বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী। স্বাস্থ্যসেবায় পিছিয়ে থাকা বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার।
সামাজিক কার্যক্রমের আওতায় ছিটমহলগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি পরিবারই কোনো না কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আছে। শতভাগ মানুষ এই কর্মসূচির আওতায় এসেছে। ছিটমহলগুলোয় শত শত টিউবওয়েল এবং ল্যাট্রিন দিয়েছে সরকার। কোনো কোনো ছিটমহলে পুলিশ ফাঁড়িও স্থাপন করা হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র অল্প সময়ের মধ্যে করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে গৃহহীন মানুষের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহ উপহার কার্যক্রমে ছিটমহলগুলো অগ্রাধিকার পেয়েছে। পঞ্চগড়ে শুধু সদরের বিলুপ্ত ছিটমহলে ৯৮টি বাড়ি হস্তান্তর করা হয়েছে এবং ৪০টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিলুপ্ত সব ছিটমহলে অন্তত সহস্রাধিক বাড়ি দেওয়া হয়েছে। পঞ্চগড়ের সদর উপজেলার বিলুপ্ত গারাতি ছিটমহলের বাসিন্দা মফিজার রহমান। তিনি ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির গারাতি ছিটমহলের সভাপতি ছিলেন। ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনে তিনি অগ্রভাগে ছিলেন। আন্দোলনকালে তাঁর বিরুদ্ধে ২৪টি মামলা হয়েছিল। সেই সব মামলা খারিজ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর উন্নয়নে সরকারের চেষ্টার কোনো ঘাটতি নেই। আমাদের আশার চেয়ে বেশি কাজ করছে সরকার। ছিটমহলবাসীর এখন সুখের দিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা ঋণী।’
বাংলাদেশ-ভারতে ১৬২টি ছিটমহল কবে, কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে তাদের সংকট যে শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছিটমহল সমস্যা সমাধান করার জন্য একটি চুক্তি করলেও তা কার্যকর হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে সপরিবার হত্যা করার পর, তখন সেই চুক্তিও কার্যকর হয়নি। এরপর জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া কেউই ছিটমহল বিনিময় নিয়ে তেমন চেষ্টা করেননি। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আলোকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চেষ্টায় ছিটমহল বিনিময় সম্ভব হয়েছে। তবে মনেমোহন সিং যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তখনই ছিটমহল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছিল।
১৬২টি ছিটমহলে অর্ধলক্ষাধিক মানুষের বসবাস ছিল। মিথ্যায় মোড়ানো ছিল তাদের জীবন। সেই জীবনে সুখ-শান্তির লেশমাত্র ছিল না। ছয় বছর আগে ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে তারা একটি দেশ পেয়েছে, সেটাই তাদের কাছে সবচেয়ে বড় আনন্দের। তাদের চোখেমুখে সেদিন ছিল স্বাধীন হওয়ার আনন্দ। সেই আনন্দেই তারা আজও ভাসছে।
লেখক: তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: আগষ্ট ১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,